প্রধানমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন
“দৈনিক এক কোটি টাকা খরচ করে যুদ্ধ চালাতে হলে পাকিস্তান ভেঙে পড়বে বলে আমরা উল্লসিত, আর যুদ্ধ না করেও ভারতকে দৈনিক তিন-কোটি টাকা শরণার্থী বাবদ খরচ করতে হলে যে, ভারতীয় অর্থনীতিই। ধ্বসে পড়বে, সে খেয়াল কারও নেই।” বাংলাদেশ ও নানা পন্থা (১) পান্নালাল দাশগুপ্ত বাংলাদেশে মুক্তিসংগ্রাম শুরু হবার প্রথম দিন থেকেই একটা ধারণা ছড়ানাে হচ্ছিল যে, পাকিস্তানী সামরিক | শক্তির বিরুদ্ধে মুক্তিফৌজের যে সশস্ত্র শক্তিগুলি আছে সেগুলি দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম চালাতে পারবে, পাকিস্তানী অর্থনীতি ভেঙে পড়বে। কারণ, এ যুদ্ধ চালাতে তাদের দৈনিক এক কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। উপরন্তু পূর্ব বাংলার বহিবাণিজ্যের আয় বন্ধ থাকছে। এতবড় বােঝা পশ্চিম পাকিস্তান বেশী দিন বহন করতে পারবে না। অতএব যদি মুক্তি ফৌজেরা তাদের সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী করতে পারে তবে পাক সামরিক বাহিনী পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হবে। এতটা আশাবাদী হিসেব একটু বেশী মাত্রায় কল্পনাবিলাসিতা। পশ্চিম পাকিস্তান অন্তত কয়েক মাস এই ধরনের খরচ যে করতে পারে সেটা ধরে নেওয়া উচিত। তাছাড়া প্রথমটায় ওদের যে ধরনের যুদ্ধ করতে হয়েছে, যত গুলিগােলা খরচ করতে হয়েছে, এখন সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের ছােটবড় শহরগুলি দখল করার পরে, মুক্তফৌজের সশস্ত্র অংশগুলিকে দেশের বাইরে ঠেলে ফেলে দেবার পরে আর সেই হারে তাদের তা খরচ করতে হবে না। সামরিকবাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্য সম্ভার বহনবহন করার স্বাভাবিক ব্যবস্থা চালু হতে নিশ্চয়ই সময় লাগবে, কিন্তু পি আই এ বােয়িং এবং সি-১৩০ বিমানবহরের সাহায্যে সামরিকবাহিনীর প্রয়ােজনীয় দ্রব্য ও খাদ্য যথাস্থানে পৌছানাের ক্ষমতা পাকিস্তানের আছে। তাছাড়া সমুদ্রপথে মালপত্র পৌছাবার পথও তার বন্ধ হয়নি। হেলিকপটারযােগে মাল নামিয়ে দেওয়া অথবা আকাশ থেকে মাল ফেলাও অব্যাহত।
একথা সর্বজনবিদিত যে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সুসংগঠিত মুক্তিফৌজ না থাকার দরুণ (মুক্তিফৌজ এখন সীমান্তেই সীমাবদ্ধ) সেখানকার জনসাধারণের মনােবল ভেঙে যায় ও সর্বগ্রাসী সন্ত্রাসে লক্ষ লক্ষ লােক ভারতে চলে আসে, এখনাে আসছে। মনে রাখা দরকার পাকিস্তানী আক্রমণের পরেও অন্তত দুই সপ্তাহ বা প্রায় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত শরণার্থীরা এমন ব্যাপকহারে ভারতে আসেনি। কিন্তু মুক্তিফৌজ যে হারে বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে বিতাড়িত হচ্ছে, সেই অনুপাতের সঙ্গে সমতা রেখেই বেসামরিক শরণার্থীরা বিপুল বেগে ভারতের উপর এসে পড়ছে। যদি যথাসময়ে মুক্তিফৌজের অভ্যন্তরীণ শক্তিগুলিকে প্রয়ােজনীয় অস্ত্রে সজ্জিত করা যেত ও তাদের যােগাযােগ ব্যবস্থা সুসংহত করা যেত তবে পাক সামরিক-বাহিনীকে ঠেকানাের ক্ষমতা তাদের থাকত ও এই শরণার্থী নিয়েও ভারত বিব্রত হতাে না। একথা সকলেই স্বীকার করবেন যে পাক আক্রমণ শুরু হবার পর অন্তত দশ দিন পর্যন্তও পাকবাহিনী সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ার ক্ষমতা রাখেনি, তারা মােটামােটি সাত-আটটা ক্যানটনমেনটের মধ্যেই নিজেদের সুরক্ষিত রাখার কাজে নিজেদের কার্যক্রম সীমিত রেখেছিল। অবশ্য ঢাকা ও তার আশেপাশের যাবতীয় প্রতিরােধ তারা প্রথম দু’দিনেই চুর্ণ করেছিল। কিন্তু সারা বাংলাদেশে প্রতিরােধশক্তি যা ছিল তাতে পাক সামরিক-বাহিনী অন্তত কয়েকটা দিন বেশ প্রতিহত ও হতচকিত হয়েছিল। একথা এখন সকলেই স্বীকার করছেন যে, যদি বাইরে থেকে সত্যিই সাহায্য আসতাে তবে দুয়েক দিনের মধ্যেই একটা বলিষ্ঠ আঘাতে পাকবাহিনীর ঘাঁটিগুলি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হতাে ও অতিদ্রুত বাংলাদেশের রাজনৈতিক ক্ষমতা গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণাধীন হতাে। পাক-বাহিনী ওখানে দুদিনের বেশী তিন দিন থাকতে পারতাে না।
সহজসাধ্য এ কাজটি যথাকালে না করার জন্যে মনে হবে আজ একাজ করা কয়েক গুণ বেশী কঠিন, ব্যয়সাধ্য ও ক্ষয়ক্ষতিসাপেক্ষ হয়েছে। মুক্তিফৌজের যে অবশিষ্টাংশ আজ বাংলাদেশের প্রত্যন্ত প্রদেশ বা ভারতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের পক্ষে আজ আবার পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে আনা এক্ষুণি অত্যন্ত দুঃসাধ্য; যদি অসাধ্য নাই হয়। আজ এই অবস্থাতে যদি বলা হয় যে, মুক্তিফৌজ প্রত্যক্ষ সংগ্রামের রণকৌশল ত্যাগ করে গেরিলাযুদ্ধের জন্য নিজেদের সংহত করে নিক, ভিয়েতনামের গেরিলাদের মত পাক-বাহিনীকে পিছন থেকে, পাশ থেকে আঘাত করে করে পর্যদস্ত করুক, দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের জন্য যাবতীয় কর্মপন্থা পরিবর্তিত করুক, থিয়ােরীর দিক থেকে হয়তাে তা অগ্রাহ্য নয়। এটাও হয়তাে বলা চলে যে, কোনাে দেশেরই কোনাে সাহায্য ততটা না পেরেও বাংলাদেশের মুক্তিফৌজ নির্বাপিত হবে না; পাঁচ, দশ, বিশবছর হলেও মুক্তিফৌজ থাকবেই। কিন্তু এ কথাগুলি এতাে নৈর্ব্যক্তিক যে, এর মধ্যে আমাদের কোন দায়দায়িত্ব বা কর্তব্য কিছুই স্পষ্টভাবে নির্ধারিত হয় না। বস্তুত ভারত এখনাে পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেবার অর্থ এই যে, ভারতের কোনাে Commitment বাংলাদেশের কাছে নেই, ভারতীয় সংসদ, বিধানসভায় যে প্রস্তাবগুলি পাশ হয়েছে সেগুলিকে কার্যকর করার কোনাে দায়দায়িত্ব নেই, সেগুলি শুধুই শুভেচ্ছাজ্ঞাপক। তাই কোনাে অবস্থায় যদি ভারত বেকায়দায় পড়ে বা হাত ধুয়ে ফেলে তাহলে কারাে কিছু বলার থাকবে না। কিন্তু সার্বিক পরিস্থিতিটা এমনই যে, শত চেষ্টা করলেও ভারত এই ব্যাপারে জড়িয়ে পড়া থেকে রেহাই পাবেনা। ইতিমধ্যে ৫০, লক্ষ শরণার্থী ভারতের ঘাড়ে এসে পড়েছে, আর তা খুব কম দিনের মধ্যেই এক বা দেড় কোটিতেও দাঁড়াবে। কারণ ৯০ লক্ষ হিন্দুই ছিল পূর্ব বাংলায়। প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি মুক্তিসংগ্রামকে সাম্প্রদায়িক রক্তারক্তিতে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। প্রগতিশীল শক্তিকে উৎখাত করার জন্য হিন্দুবিদ্বেষ বিশেষভাবে ছড়ানাে ওদের একটা মস্তবড় কৌশল। এটা ধরে নেওয়া উচিত যে, এভাবে সন্ত্রাসের রাজত্ব চললে বাংলাদেশে আগামী দু’-তিন মাসের মধ্যে একটি হিন্দুও থাকবে না। এই এক বা দেড় কোটি শরণার্থীর পেছনে মাথাপিছু দৈনিক দু’টাকা করে ধরলেও ভারতকে দৈনিক দু’-তিন কোটি টাকা খরচ করতে হবে। | দৈনিক এক কোটি টাকা খরচ করে যুদ্ধ চালাতে হলে পাকিস্তান ভেঙে পড়বে বলে আমরা উল্লসিত, আর যুদ্ধ না করেও ভারতকে দৈনিক তিন কোটি টাকা শরণার্থী বাবদ খরচ করতে হলে যে ভারতীয় অর্থনীতিই ধসে পড়বে সে খেয়াল কারাে নেই।
যদি প্রথম দু’-তিন দিনেই ভারত সক্রিয় ভাবে বড়দরের সাহায্য করতাে, তবে আজ তাকে প্রতিদিন দু’তিন কোটি টাকা খরচের বােঝা নিতে হতাে না। এতে ভারতের সব গঠনমুলক পরিকল্পনা বন্ধ হবে। গরিবী হঠাও’ কোথায় উড়ে যাবে ঠিক নেই শেষ পর্যন্ত ভারতের পক্ষে পাকিস্তানের যুদ্ধ এড়ানাে সম্ভব হবে না। যদি পাকিস্তানে একটি হিন্দুও না থাকে তবে এখানকার সাম্প্রদায়িক সমস্যা একটা বিস্ফোরক অবস্থা সৃষ্টি করবে। এদেশের মুসলমানদের জীবন বিপন্ন হওয়া অস্বাভাবিক নয় এবং প্রতিক্রিয়াশীল দলগুলি উন্মাদ দাঙ্গাহাঙ্গামা করতে প্রচুর সহায়তা পাবে। তদুপরি যে অর্থনৈতিক সংকট ও বিপর্যয় আসবে তা ভারতের রাজনৈতিক অবস্থঅকে বিপন্ন করে ছাড়বে। এই উভয় সংকট মােকাবিলার শক্তি ভারতের প্রগতিশীল উদারপন্থী দলগুলির হাতে নাও থাকতে পারে। ঘাের অরাজকতা দেখা দিতে পারে। তখন পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ অনিবার্য হতে পারে, অথচ সে যুদ্ধের কারণ হিসেবে বলার মত কোন উদার রাজনৈতিক যুক্তিও দেখানাে যাবে না। কোনাে দেশের মুক্তিসংগ্রামকে বলশালী করার জন্য সে যুদ্ধ নয়, গণতন্ত্রের জন্যও সে যুদ্ধ নয়, সে যুদ্ধ তখন হবে একটা ঘাের সাম্প্রদায়িক আবর্তের মধ্যে স্রেফ একটা দাঙ্গার রাজনৈতিক সংস্করণ।
যদি ধরা যায় যে, ভারতের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি এ ধাক্কা সামলাতে পারবে, ভারতের অভ্যন্তরীণ । দাঙ্গা বন্ধ রাখতে পারবে, অর্থনীতিকেও একদম ভেঙ্গে পড়া থেকে বাঁচাতে পারবে, আর যদি এটাও ধরে নেওয়া যায় যে, মুক্তিফৌজ তার লক্ষ্য আদর্শ অনুযায়ী গেরিলা সংগ্রাম চালু রাখতে পারবে আমরা পরােক্ষে বা গােপনে অস্ত্র দিয়ে তাকে সাহায্য করতে পারবাে, তাতে এটা ভাবার কারণ নেই যে, সেই সংগ্রামের নেতৃত্ব আমাদের কৃপণ ও গােপন সাহায্যের জন্য ভারতের নেতৃত্বের প্রতি অনুগত থাকবে। এই ধরনের দীর্ঘকালীন সশস্ত্র গেরিলা যুদ্ধ পরিচালনার নেতৃত্ব বহন করা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের পক্ষে হয়তাে সম্ভব হবে। ঐ জাতীয় কঠিন সংগ্রামের নেতৃত্ব ক্রমশ অধিকতর বামপন্থী নেতৃত্বের হাতে চলে যেতে বাধ্য। যদি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিফল ও ধিকৃত হয়, তাহলে ভারতের কোনাে সুবিধা নেই কারণ বাংলাদেশের সে সংগ্রামী নেতৃত্বের কাছে আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় নেতৃত্ব দুটোই একযােগে বর্জিত হবে। সেই সময় চীন হস্তক্ষেপ করতে অগ্রসর হবে এবং আওয়ামী লীগ বিরােধী এবং ভারতবিরােধী যে সংগ্রামী শক্তি দাঁড়াতে চাইবে তাকেই সাহায্য করবে। এখন চীন যদি হস্তক্ষেপ করে সে সংগ্রাম বাংলাদেশ সীমান্তের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তাকে তারা পূর্বভারতের মুক্তিসংগ্রামে পরিণত করবে অর্থাৎ পশ্চিম বাংলা সহ, আসাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, নেফা, মিজো, নেপাল, ভূটান, সিকিমও সেই সংগ্রামের আবর্তে পড়বে। তারপর গােটা ভারতবর্ষের অবস্থা অবর্ণনীয়। পশ্চিম পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্ব অর্থাৎ ইয়াহিয়া- ভুট্টো-কায়ুমের নেতৃত্ব সে ধরনের পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত নয় তা বলা যায় না। তারা যদি দেখে যে, পূর্ব পাকিস্তান হাতছাড়া হয়েই যাচ্ছে, তখন তারা “উড়া-খই-গেবিন্দায়’ মত পূর্ব পাকিস্তান এবং পূর্ব ভারতকে এমন এক জায়গায় ঠেলে নেবে, যেখান চীন এসে সেটা দখল করতে পারবে অর্থাৎ ভারত যেন এদিকে রেহাই না পায়, তা পশ্চিম পাকিস্তানের যত ক্ষতিই হােক।।
৫ জুন, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা