You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজধানী রাজনীতি ইয়াহিয়া এখন হন্যে হয়ে তাঁবেদার খুঁজছেন -রণজিৎ রায় - সংগ্রামের নোটবুক

রাজধানী রাজনীতি ইয়াহিয়া এখন হন্যে হয়ে তাঁবেদার খুঁজছেন

–রণজিৎ রায়

বাংলাদেশের বিদ্রোহ গুঁড়িয়ে দেওয়া গিয়াছে, সেখানে পুনরায় শান্তি বিরাজ করছে ইত্যাকার কথা জেনারেল ইয়াহিয়া দুনিয়ার মগজে ঢুকিয়ে দেওয়ার মরীয়া চেষ্টা করছেন। কিন্তু ওর অসুবিধা হল- ইতিহাসে তুলনাবিহীন গণহত্যা ও অত্যাচার শুরু করার আড়াই মাস পরেও তিনি বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন ফিরিয়ে আনতে পারেননি। আর তা যতদিন না পারছেন তত দিন যত গলা ফুলিয়েই ইয়হিয়া অপপ্রচার চালান না কেন, পৃথিবীর গুরুত্বপুর্ণ রাজধানীগুলি তার কথাকে আমল দেবেনা। বাংলাদেশের আর্থিক জীবন সম্পূর্ণ বিদ্ধস্ত। চট্টগ্রাম এবং খুলনা বন্দরে যৎসমান্য কাজ হচ্ছে; তাও কেবল সামরিক প্রয়ােজন মেটানাের জন্য। অসংখ্য কারখানা বন্ধ। শিল্পোৎপাদনের পরিমাণ স্বাভাবিকের ১০ শতাংশের বেশি নয়। ধান এবং পাট চাষ কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে তা খন্দ এলে বােঝা যাবে। বাংলাদেশের আর্থিক বিপর্যয় পশ্চিম পাকিস্তানের হাড়ে বাতাস ধরিয়ে দিচ্ছে। কারণ বিদেশী মুদ্রার উৎস এবং সম্পূর্ণ প্রস্তুত দ্রব্যের বাজার হিসাবে তাকে যে বাংলাদেশের উপরেই নির্ভর করতে হয়।  সুতরাং পাকিস্তানী জঙ্গী শাসকরা বাংলাদেশে যে হন্যে হয়ে তাঁবেদার খুঁজে বেড়াবে তাতে দুর্বোধ্য কিছুই নেই। প্রথমে এ কাস্ত্রের জন্য শ্রীনুরুল আমিনকে ধরা হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশের বর্তমান মুডটা তিনি ভালােই বােঝেন; তাই ও প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন। শ্রীআমিন করাচিতে বলেছেন- ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেবার মত লােক বাংলাদেশে এখন একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না।

জেনারেল ইয়াহিয়া এবার খাজা খায়েরুদ্দিন মৌলভি ফরিদ এবং বেগম সুলেমানের দিকে মুখ ফিরিয়েছেন। ওদের সাহায্য তিনি বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন গড়তে চান। খাজা খায়েরুদ্দিন ঢাকার উর্দুভাষী নবাব পরিবারের লােক। আয়ুব খানের আমলেও তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওর রাজনীতিক প্রভাব ঢাকার অঙ্গুলিমেয় অবাঙালী মুসলমানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। নিজাম-ই-ইসলামী দলের সদস্য মৌলভি ফরিদ গত ডিসেমবরের নির্বাচনে নিদারুণভাবে পরাস্ত হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের কক্সবাজার হল তার নির্বাচন কেন্দ্র; কিন্তু সেখানেও তার কোন প্রভাব আছে কিনা সন্দেহ। বেগম সুলেমানের একমাত্র পরিচয় তিনি সুরাবর্দির কন্যা। তিনি কোনদিন রাজনীতি করেননি বা নেতৃত্ব করার ভানও করেননি।  এদের সাহায্যে জেনারেল ইয়াহিয়া তার সামরিক শাসনের উপর অসামরিক প্রশাসনের মুখােশ পরিয়ে দিতে সক্ষম হবেন না। অন্তত এ প্রয়াসের দ্বারা কাউকে বােকা বানানাে তার পক্ষে কঠিন হবে। ওর হুকুম তামিল করার জন্যে এখন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল বাহিনী কিংবা পুলিশ বাহিনী হুজুরে হাজির হয়ে নেই। সেনা বাহিনীকে বড় বড় শহরে এবং ভারতের সঙ্গে সীমান্ত এলাকায় মােতায়েন করে রাখতে হয়েছে। বর্ষা নামলে পাকিস্তানী সৈন্যদের স্থানান্তর কাজ অসম্ভব হয়ে পড়বে।

এ অবস্থায় অসামরিক প্রশাসনের কথা বলার অর্থ নগ্ন সামরিক শাসনকেই মিষ্টি নামে ডাকা । ইয়াহিয়া বাংলাদেশে সাড়ে চার ডিভিশন সৈন্য নামিয়েছেন; কিন্তু যেখানে তারা রয়েছে সেখানে তাদের দুষ্ণর সময় কাটাতে হচ্ছে। মুক্তিফৌজের সঙ্গে সম্মুখ সমর এখন ঘটছে না। মুক্তিফৌঃ এখন সেনাবাহিনীকে হঠাৎ আক্রমণে নাস্তানাবুদ করার কৌশল গ্রহণ করেছে। ওরা ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আগামী কয়েক মাসে গেরিলা আক্রমণ তীব্রতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে তীব্র কুটনৈতিক লড়াই শুরু হয়েছে। ইয়াহিয়া অর্থ ভিক্ষা চেয়ে নানা দেশে দূত পাঠিয়েছেন। তার অবিলম্বে ৪০ থেকে ৫০ কোটি আমেরিকান ডলার পরিমাণ সাহায্য দরকার। অন্যদিকে নয়াদিললি তার কূটনৈতিক সূত্রের মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশকে বােঝাতে চেষ্টা করছে যে, ইয়াহিয়াকে সামরিক বা আর্থিক যে কোন ধরনের সাহায্য দিলেই তা বাংলাদেশে পাকবাহিনীর জন্যই কাজে লাগানাে হবে, ফলে বাংলাদেশের যন্ত্রণা দীর্ঘতর হবে মাত্র। নভেম্বর মাসের সাইক্লোন- বিধ্বস্ত এলাকার জন্য  সাহায্য হিসাবে যে সব স্পীড বােট পাওয়া গিয়েছিল, ইয়াহিয়া সেগুলি সেনাবহনের কাজেই লাগাচ্ছেন। ওই কারণে পাওয়া ত্রাণসামগ্রীও অবন্টিত পড়ে আছে। ইয়াহিয়া বিদেশ থেকে আরও অনুরূপ জলযান চেয়েছেন। স্পষ্টতই তিনি বর্ষার সময় তার সেনাদের চলাচলের জন্য ওগুলি ব্যবহার করতে চান।

বাংলাদেশের বিষয়ে কথা বলার জন্য শ্রী স্বর্ণ সিং মসকো, প্যারিস, লন্ডন এবং ওয়াশিংটনে যাচ্ছেন। ইসলামাবাদের সঙ্গে কূটনীতিক যুদ্ধকে দিললি কতটা গুরুত্ব দিচ্ছে তা এর থেকেই বােঝা যাবে। শ্রীসিং কুয়ােমিনটাং চীন বাদে নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্রগুলির রাজধানীতেই যাচ্ছেন। ভারত হয়তাে বাংলাদেশের যুদ্ধ এবং ভারতে তার বিরুপ ফলের ব্যাপারে নিরাপত্তা পরিষদকে তৎপর করে তােলার চেষ্টা জেনারেল ইয়াহিয়া বর্তমান সংকট কাটিয়ে উঠতে পারবেন কিনা তা নির্ভর করছে তিনি পাশ্চাত্যের।  দেশগুলি থেকে সাহায্য পাচ্ছেন কিনা তার উপর। চীন তাকে বৈতরণী পার করে দিতে পারবে না। তবে পাশ্চাত্ত্য দেশগুলিও ইসলামাবাদকে সাহায্যের ব্যাপারে একেবারে নারাজ নয়। আমেরিকা পাকিস্তানের সামরিক শক্তি গড়ে তােলার ব্যাপারে আগে কোটি কেটি টাকা ঢেলেছে। পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে হয়ে যাক সে তা এখন চাইবে না। ব্রিটেনের মনােভাবও একই রকম। তবে নয়াদিললি মনে করে যে মসকো বাংলাদেশের সংগ্রামের তাৎপর্য উপলব্ধি করতে পেরেছে। কিন্তু তাই বলে সে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়াটা সমর্থন করবে- এমন কথা ভাবলে বােধ হয় ভুলই করা হবে। সেরকম কোন আশা। লক্ষণ আদৌ দেখা যাচ্ছে না। | পাশ্চাত্ত্যর দেশগুলি সাহায্যের বিনিময়ে ইয়াহিয়ার উপর রাজনীতিক সমাধানের উপর চাপ দিচ্ছে বলে মনে হয়।

ইয়াহিয়া বােধহয় ভাবছেন যে তিনি যেন-তেন একটা প্রশাসন ব্যবস্থা বাংলাদেশে খাড়া করতে পারলে বিদেশ থেকে সাহায্য পাওয়ার পথটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। সেই জন্যেই তিনি এমন হন্যে হয়ে বাংলাদেশে মীরজাফর খুঁজে বেড়াচ্ছেন। | তবে পশ্চিমি দেশগুলি তথা সােভিয়েত ইউনিয়ন রাজনীতিক সমাধান বলতে যে ঠিক কী বােঝাতে চাইছে তা স্পষ্ট নয়। বাংলাদেশ থেকে সব পাকিস্তানী সৈন্য সরিয়ে নেওয়ার পরেই রাজনীতিক সমাধানের কথা আসতে পারে। অর্থাৎ ইসলামাবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কী হবে সে সম্পর্কে কথা বলার স্বাধীনতা  বাংলাদেশের থাকা দরকার। আওয়ামী লীগের নেতারা এবং মৌলানা ভাসানি প্রকাশ্যেই এই মনােভাব ব্যক্ত করেছেন।  ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত হল- অখণ্ড পাকিস্তান আর সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা চিরকাল । বাংলাদেশের টুটি চেপে রাখতে পারবে না। স্বাধীন দেশ হিসাবে বাংলাদেশে অ্যুদয়ের দ্বারা পাকিস্তান। | টুকরাে হয়ে যাবে কিনা- সে প্রশ্নের ফয়সালাও পাকিস্তানকেই করতে হবে। | বাংলাদেশের ঘটনাকে ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মনে করে না। লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু । আগমন এবং অন্যান্য বিষয় একে ভারতের পক্ষে এক বিরাট সমস্যা করে তুলেছে। ভারত বাংলাদেশের। পাশবিকতায় নীরব দর্শক হয়ে থাকবে এবং তারই ফল ভুগবে-কোন দেশই নিশ্চয় এটা আশা করে না। বর্ষাকালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে বড় রকম সংঘর্ষ বাধবে না-এমন চিন্তা যুক্তিসঙ্গত । কিন্তু বাংলাদেশ। থেকে বর্ষা বিদায় নিলে, বানের জল নেমে গেলে এবং মাস ছয়েক পরে আকাশ আবার নীলাভ হয়ে উঠলে । অবস্থা কী দাঁড়াবে তা ভবিষ্যৎই বলতে পারে।

৩ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা