You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি

–পান্নালাল দাশগুপ্ত

  পূর্ববাংলা বা বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতার প্রতি সাধারণভাবে ভারতীয় জনতার সহানুভূতি খুবই প্রবল ও সােচ্চার। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হােক, এজাতীয় দাবি আজ প্রায় সর্বত্র। “প্রায় সর্বত্র” বললাম এজন্য যে, শােনা যায়, ভারতীয় মুসলমানদের মনে নাকি কোন সক্রিয় সহানুভুতি | জাগেনি। উপরন্তু কেউ কেউ নাকি বিরূপ মনােভাবাপন্ন। কত শতাংশ ভারতীয় (পশ্চিমবাংলা সহ) মুসলমানদের মধ্যে এজাতীয় বিরূপতা রয়েছে, আমরা তা বলতে পারবাে না। বলতে না পারার একটি কারণ এই যে, ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে যারা স্বাধীনতাকামী পূর্ববঙ্গবাসীদের সংগ্রামের সমর্থক তারাও খুব। একটা সােচ্চার ও সক্রিয় নন, আবার যারা এর বিরুদ্ধবাদী তারাও সােচ্চার নন, বরং নীরব। ফলে মুসলিম। জগতের ভিতরকার মতামত সত্যিই কী তা বােঝা মুশকিল। হয়তাে তাদের প্রতিটি পরিবারে আজ মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে, হয়তাে অনেকে কিছু বুঝে উঠতে পারছেন না | পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে গেলে ভারতীয় মুসলমানদের নিরাপত্তা ও নির্ভরতার শেষ সীমান্তটিও নষ্ট হয়ে যাবে, এজাতীয় ভয় থেকে নাকি অনেক মুসলমান (ভারতীয়) মুজিবর রহমানের আন্দোলনকে ভালাে চোখে দেখেন না। একথা হয়তাে তারা বােঝেন না যে, পূর্ব পাকিস্তান যদি বাংলাদেশ বলে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে বেরিয়ে আসে, তবে সেখানেও মুসলমানরাই প্রাধান্য করবেন বা রাজত্ব করবেন; যদি পাকিস্তানী হিসেবে নয়, দ্বিজাতিতত্বের ধারক হিসেবে নয়, আধুনিক গণতান্ত্রিক প্রগতিশলি রাষ্ট্র হিসেবেই তা বেঁচে বর্তে থাকবে, আর সে-দেশ ভারত কেড়ে নেবেনা। যে দেশের (বাংলাদেশের) লােক স্বাধীনতার জন্য  এত মূল্য দিতে পারেন, এত লক্ষ লক্ষ প্রাণ বলিদান হয়, সে দেশকে ভারত অথবা কোন্ দেশ দখল করতে  সাহস রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানেও যদি একটি এমনি ধরনের গণতান্ত্রিক বিপ্লব হয়, সে দেশও নিশ্চয় স্বাধীন। থাকবে, এবং সেটি সম্পূর্ণরূপেই মুসলমানদেরই রাজ্য থাকবে, একটিও হিন্দু সে দেশে নেই। মুসলমানদেরই দেশ থাকবে, পাকিস্তানী হিসেবে নয়।

মুসলমানকে কি পাকিস্তানী হতেই হবে, খাটি মুসলমান হতে হলে? পৃথিবীতে এত তাে মুসলমান আছে, তারাতাে পাকিস্তানী বলে নতুন কোন ধর্ম ইসলামের উপরে চাপিয়ে চলে  অতীতে এই ভারতবর্ষে পাঠান মােগলরা ৭/৮ শ’বছর রাজত্ব করেছেন, তারা পাকিস্তান সৃষ্টি করেননি,  তারাতাে ভারতীয় বা হিন্দুস্থানী মুসলমান হিসেবেই গােটা উপমহাদেশে রাজত্ব করে গেছেন। তারা কি | পাকিস্তানী মুসলমানদের চেয়ে কম মুসলমান ছিলেন? তারা কি হিন্দুদের ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে থাকতেন? | আসলে মুসলমানরা যখন সাহসী ছিলেন, বীর ছিলেন, শৌর্য বীর্য ছিল, তখন মুষ্টিমেয় মুসলমানও ভারত মহাদেশে নির্ভয়ে চলাফেরা ও রাজত্ব করেছেন। পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল, ভয় থেকে আত্মবিশ্বাসের অভাব থেকে। যারা সাধারণ মুসলমানদের ভয় দেখিয়ে, ভয় পাইয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল, তারা জানতাে এবং আজও জানে যে, যদি পাকিস্তান রাখতে হয় তবে মুসলমানদের মনে ও প্রাণে একটা চিরন্তন ভয় জাগিয়েই রাখতে হবে। ভয় থেকেই পাকিস্তানের জন্ম, এবং যতদিন মুসলমানদের প্রাণে তার (হিন্দুদের সম্বন্ধে) ভয় জাগিয়ে রাখতে পারবে, ততদিনই পাকিস্তান থাকবে। ফলে মুসলমানরা যাতে নির্ভর না হতে পারে, মুসলমানদের সর্বাদই বিপদাপন্ন (ইসলাম বিপন্ন’- এই জিগিরের অর্থও তাই) রাখা তাদের একটা কৌশল। দাঙ্গা এই জন্যই পাকিস্তানী নায়ক ও চিন্তাবিদদের একটা চিরন্তন হাতিয়ার। হিন্দু-মুসলমানে কোলাকুলি হােক এ দৃশ্য তারা অত্যন্ত ভয়ের চক্ষে দেখে। যদি হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা হয় তবেই তারা খুশি, কেননা তাতে। মুসলমান যতই মরুক, মুসলমানদের যত ক্ষয়ক্ষতিই হােক, পাকিস্তানের জিন্দাবাদ হয়।

ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও ভারত দুই দেশে খণ্ডিত হবার পরেও মুসলমানদের বিপদ কমেনি, শেষ পর্যন্ত। হয়তাে বেড়েছে। যা ছিল একদিন দাঙ্গা-কালে ভদ্রে সেটাকে একটা পাকাপাকি চিরন্তন সংগ্রামে পরিণত করা হয়েছে। আর সাধারণভাবে আজও ভারতের অধিবাসী কোটি কোটি মুসলমানদের ধোকা দিয়ে বােঝানাে হচ্ছে যে, যদি পাকিস্তান না থাকে, তবে তাদের শেষরক্ষার কবচটিও হরিয়ে যাবে। আর এই একটা সর্বগ্রাসী ভয় থেকে, ভারতীয় মুসলমানদের মনেও সমাজে রক্ষণশীল মনােবৃত্তিগুলিকেও জিইয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। নিজেদের সমাজ সংসার ও ধর্মকে আধুনিক প্রয়ােজনে প্রগতিশীল করা সম্ভব হচ্ছে না, কেননা ভয় যেখানে বাসা বাঁধে, রক্ষণশীলতা সেখানে অনিবার্য। ভারতীয় মুসলমানদের আপেক্ষিক পশ্চাদূবর্তিতার একটি প্রধান কারণও এই । ভয়ের জন্য কী হারাই কী হারাই একটা ভাব তাদের সর্বদা বর্তমান, ফলে যা আছে, যুগ যুগ। সঞ্চিত ঐতিহাসিক আবর্জনা আছে তাকেও আকড়ে পড়ে থাকার প্রবণতা।  এই ভয়ভীত সদ্যসন্ধিগ্ধ ভারতীয় মুসলমান আজ পূর্ব বাংলার পূর্ব দিগন্ত থেকে যে সূর্য উঠছে তার দিকে। | নির্ভয়ে তাকাতে পর্যন্ত পারছেন না, চোখ বুজে সেই সূর্যোদয়কে অস্বীকার করার চেষ্টা করছেন। তারা যদি | একটুও সাহসী হতেন, তবে দেখতে পারতেন, আজ যা পূর্বদিগন্তে দেখা দিয়েছে সেটি ভারতীয় মুসলমানদেরপক্ষেও কতবড় একটা মুক্তি- ভয় থেকে মুক্তির আহ্বান। পৃথিবীতে আজও পশ্চাদগামিতার প্রবণতা দূর হয়নি, আজও মুসলমান জগৎ প্রায় সর্বত্রই পিছিয়ে পড়ে আছে, কোথাও তারা জগৎসভায় সত্যিকার আসন লাভ করতে পারেনি। মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা, পূর্ব এশিয়া কোথাও তারা নিজেদের সত্যিকার আসন দখল করতে পারেনি, কোনও উল্লেখযােগ্য অবদান-সাহিত্য, বিজ্ঞান, ধর্ম, সমাজ-কোন ক্ষেত্রেই কিছু নেইএই বিংশ শতাব্দীতে, যদিও অতীতে তাদের দান অনেক ছিল। তারা আধুনিক বিজ্ঞান-বিপ্লবের যথাযথ ব্যবহার এখনও করতে পারেনি, অবশ্য সাম্রাজ্যবাদীদের কাছ থেকে ধার করা আধুনিক ট্যাঙ্ক, বােমারু বিমান ইত্যাদি মারণ-অস্ত্র সংগ্রহ করে নিজেদের খুবই শক্তিমান মনে করছেন। আবার সে সব আধুনিক যন্ত্রপাতিকে নিজেদের মুসলমান প্রজাদের ধ্বংস করার কাজেও নিয়ােজিত করছেন, যেমন করছে আজ পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের উপরে। কিসের জন্য সে সব আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহৃত হচ্ছে? পিছিয়ে পড়া ভীত মুসলমান সমাজের অন্ধ রক্ষণশীলতা গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। অর্থাৎ আধুনিক যন্ত্রপাতি ও বিজ্ঞানকে কাজে লাগানাে হচ্ছে অবৈজ্ঞানিক গোঁড়া মান্ধাতা আমলের সমাজকে রক্ষা করার কাজে। এর পরিণামে মুসলমান শিক্ষিত সমাজকেও আত্মপ্রতারিত করে রাখা সম্ভব হয়েছে। এই আত্মপ্রতারিত তথাকথিত শিক্ষিত মুসলমানেরা যে সত্যিই আধুনিক হননি, নিতান্ত কাঁটা চামচ প্যান্ট আর বিজাতীয় পানীয় ব্যবহার করেন বলে, একথা তাদেরও মনে আসেনা।

এতাে গেল সাধারণভাবে ভারত ও পাকিস্তানী মুসলমান নেতৃত্বের মনােভাবনার স্থিতিশীলতা ও মৌলিক | ভয়ভীত চিন্তাধারার কথা। কিন্তু এই নেতৃত্বের জন্য ভারতীয় মুসলমানদের যে অদূর ভবিষ্যতে কী ভয়ানক এক বিপদের মধ্যে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সে কথাটা বলাই এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য। | আজ বাংলাদেশে যে অমানুষিক নির্যাতন, হত্যাকাণ্ড, গৃহদাহ, লুঠতরাজের বিভীষিকা সৃষ্টি করা হয়েছে, এর পরিণাম কি ভারতীয় ও পশ্চিমবাংলার মুসলমানেরা একবার ভাল করে ভেবে দেখবেন? আপনারা শুনেছেন লক্ষ লক্ষ নরনারী আবাল-বৃদ্ধ-বণিতার প্রাণ নেওয়া হয়েছে। অবর্ণনীয় সে কাহিনী । মানুষের কলমে সে দৃশ্য ফুটিয়ে তােলা সম্ভব নয় । ৩০/৩৫ লক্ষ শরণার্থী প্রাণভয়ে একষ্ট্রে এদেশে পালিয়ে এসেছে, তাদের। অবস্থা যারা স্বচক্ষে দেখছেন, তাদের প্রশ্ন করেও জানতে পারেন সে দেশে কী হয়েছে ও কী হচ্ছে। যদি ইয়াহিয়া খানের এই সন্ত্রাসই জয়ী হয়, যদি গণতান্ত্রিক আন্দোলন সত্যিই খতম হয়ে যায়, তবে কী হবে? একবার একটু ভেবে দেখেছেন কি? | এক দেড় কোটি শরণার্থী ভারতে এসে পড়বে। ৯০ লক্ষ হিন্দু আজও পূর্ব পাকিস্তানে। তারা তাে আর কেউ সেখানে থাকতে পারবে না। আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য যে সব দল এই নির্যাতনের শিকার, তারা বুদ্ধিজীবী মধ্যবিত্ত মুসলমান বাঙালীরা ওখানে কেউ থাকতে পারবে না। এই দেড়-দুই কোটি শরণার্থী এদেশে এসে পড়লে, এদেশের অর্থনীতি, সামাজিক শান্তি ও সমাজের উপর যে প্রচণ্ড আঘাত পড়বে, এবং এখনই পড়ছে, তা থেকে আপনারা রক্ষা পাবেন? শুনতে খুবই খারাপ শােনায়, প্রশ্ন করতেও কুণ্ঠা আসে, যদি একটিও হিন্দু পূর্ব অথবা পশ্চিম পাকিস্তানে আর না থাকে, তবে এখানকার মুসলমানদের উপরে একটা সাম্প্রদায়িক আক্রোশ ছড়াবে না?

বিশেষ করে ঘাের সাম্প্রদায়িক দলও তাে এদেশে আছে? পূর্ব থেকেই লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থী আজও শিবিরে শিবিরে অব্যবস্থিত অবস্থায় পড়ে আছে। তার উপরে আরাে কোটি দেড়েক শরণার্থী যদি এসে পড়ে, তবে ভারতীয় অর্থনীতি ভেঙে পড়বে, সঙ্গে সঙ্গে আজ যেসব গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল অত্যন্ত উদারপন্থী রাজনৈতিক দলের হাতে এদেশের রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হয়, আজ যারা ক্ষমতায় আছেন, তাদের পক্ষে সে ভয়াবহ অসন্তোষের বিস্ফোরণের টাল সামলানাে সম্ভব হবে না। হয় ভারত সম্পূর্ণ প্রতিক্রিয়াশীল স্বেরাচারী কোন সামরিক গােষ্ঠির হাতে চলে যাবে, নয়তাে একটা ব্যাপক অরাজকতার যুগ। সৃষ্টি হবে। তখন ভারতীয় মুসলমানদের পাকিস্তানে তাড়িয়ে দেবার জিগিরও এদেশে উঠতে পারে । ভয়াবহ দাঙ্গা হাঙ্গামার সৃষ্টি হতে পারে। তার থেকে যুদ্ধও লেগে যেতে পারে, এক অর্থহীন অন্ধ সংগ্রামে পাকিস্তান। ও ভারতবর্ষ ডুবে যেতে পারে। সেদিন ভারতীয় মুসলমানদের আরাে বিপন্ন হতে হবে না? সেদিন কি সম্পূর্ণ হিন্দুহীন পাকিস্তান ভারতীয় সব মুসলমানদের রক্ষা করতে পারবে? | অতএব ভারত বিপন্ন হােক, ভারতীয় গণতান্ত্রিক সহনশীল ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ ও রাজনীতির শেষ হােক- এ ধরনের বাসনা যদি কারাে থাকে, সেটার তাৎপর্য তাদের ভাল করে বােঝা উচিত। এ যে কী আগুন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে, অথবা উটপাখীর মত আসন্ন বিপদে মাটিতে মুখ গুঁজে থাকা হচ্ছে তা আমাদের ভাবতেও অবাক লাগে। ভারতীয় রাজনীতির দুর্বলতা অনেক আছে, ভারতীয় ধর্মনিরপেক্ষতা গণতন্ত্র ও প্রগতির মধ্যে হয়তাে অনেক ফাক, ফাকি ও দুর্বলতা আছে, কিন্তু তারমধ্যে যেটুকুও আছে, সেটাও যদি ধ্বংস হয়ে যায়, উবে যায়, ভারতও যদি একটা একধর্মীয় রাষ্ট্র (Theocratic state) হয়ে যায়, তখন ভারতীয়রা, এবং ভারতীয় মুসলমানেরাও বুঝতে পারবেন, কী তারা হারালেন। কিন্তু তখন খুব দেরী হয়ে যাবে, সংশােধনের আর কোন পথ বা সময় থাকবে না। একটা মহতী বিনষ্টি ও সর্বনাশ থেকে কারাে কোন রক্ষা থাকবে না। রক্ষণশীল মুসলমানদেরও নয়, আর তথাকথিত প্রগতিশীল অমুসলমানদেরও নয়। মুসলমানই। হােক, অমুসলমানই হােক, প্রতিটি ভারতীয়ের কাছে বাংলাদেশে আজ যা ঘটছে তার অদূর সুদূর প্রসারী তাৎপর্য ভালাে করে বােঝা উচিত, এবং সময় থাকতেই বােঝা উচিত, সময় ফুরিয়ে গেলে নয়।

২৯ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!