You dont have javascript enabled! Please enable it! বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়ােজন এখনই - পাক রাজনীতির ভাষ্যকার - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার প্রয়ােজন এখনই

— পাক রাজনীতির ভাষ্যকার

পূর্ববাংলা থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষের (যাদের মধ্যে অধিকাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের) বাস্তুত্যাগে পাকিস্তানের বিপর্যস্ত জঙ্গীশাহী নিঃসন্দেহে উল্লসিত। কারণ, | (ক) পূর্ববঙ্গ হিন্দুশুন্য হচ্ছে; পাকিস্তানের উৎপত্তি থেকেই যে হিন্দুদের করাচী/রাওয়ালপিনডি কোনদিন সহ্য করতে পারেনি। | (খ) পূর্ব-বাংলা থেকে নবুই লক্ষ হিন্দু সবাই এবং আরও কয়েক লক্ষ মুসলমান যদি দেশত্যাগী হন, তবে জনসংখ্যায় পূর্ব-বাংলার মেজরিটি আর থাকবে না। (গ) বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর চাপে ভারতের দুর্বল অর্থনীতি দুর্বলতর হয়ে উঠবে। জনস্বাস্থ্য, আইনশৃঙ্খলা প্রভৃতি প্রশ্নগুলি ক্রমে আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। | (ঘ) উদ্বাস্তু ও স্থানীয় অধিবাসীদের সঙ্গে স্বার্থের সংঘাত দেখা দেবে, ক্রমে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধবে, বাধবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাহাঙ্গামা ।  এই মতলবে ইয়াহিয়াশাহী যে উদ্বাস্তু দলগুলির সঙ্গে শরণার্থীর ছদ্মবেশে বহু এজেনট প্রােভােকেটরকে ভারতে পাঠাচ্ছে, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। এছাড়া তাদের প্রধান এজেনট মেহেদি মাসুদ ও তার পশ্চিম পাকিস্তানী চেলারা কলকাতায় বসে তাদের কুকীর্তি তাে চালিয়ে যাচ্ছেই।

ভারতে ইতিমধ্যেই ত্রিশ লক্ষ উদ্বাস্তু (জম্মু ও কাশ্মীরের জনসংখার প্রায় সমান) প্রবেশ করেছেন। এই সংখ্যা বেড়ে এক কোটিতে পৌছানাের সম্ভাবনা। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে পাকিস্তানের দিক থেকে আর কখনও এত বড় সমস্যা ভারতের উপর চাপানাে হয়নি। এর পিছনে রাওয়ালপিনডির সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা আছে বলেই পর্যবেক্ষকদের ধারণা। পাকিস্তান  জানে যে, বাংলাদেশ তাদের ছাড়তেই হবে, কিন্তু প্রতিহিংসাপরায়ণ রাওয়ালপিনডি এমন বিপর্যস্ত, এক পূর্ববাংলা রেখে যেতে চায়, যা পূর্ব ভারতের তথা সারা ভারতের পক্ষেও গভীর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকটের সৃষ্টি করবে। | ভারত সরকার হিসেব করে দেখেছেন যে, ত্রিশ লক্ষ মানুষের ভরণপােষণ করতে তাদের বছরে কম করেও ২৫০ কোটি টাকা খরচ হবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা চলতে থাকলে উদ্বাস্তু-সংখ্যা ত্রিশ লক্ষের চেয়ে অনেক বেশী হয়ে দাঁড়াবে নিঃসন্দেহে এবং তার ফলে ভারতের আর্থিক বুনিয়াদ ধসে পড়বে। | সুতরাং ভারতের পক্ষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে উদ্বাস্তুস্রোত বন্ধ করার জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করায় সর্বাধিক প্রয়ােজনীয়তা এখনই, এই মুহূর্তে।

এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, এবারের মত একাধারে এত বড় সামরিক, অর্থনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ সংকটে পাকিস্তান আগে কখনও পড়েনি। ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় রাওয়ালপিনডিকে শুধু ভারতের সঙ্গে লড়তে হয়েছে, যুগপৎ দ্বিতীয় একটি ফ্রনটে নিজেরই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ করতে হয়নি। সুতরাং ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা। করবে এমন সম্ভাবনা মনে হয় খুব বেশী নয়। যদিও মুখে তারা অহরহই যুদ্ধ বা জেহাদের জিগীর দিয়ে যাবে। পাকিস্তানের কাছে ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বর ও ১৯৭১ সালের মে মাসে রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতির মধ্যে ফারাক অনেক। অবস্থার এই গুরুত্বের দিকটা লক্ষ্য করেই সম্ভবত ভরতের প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি বলেছেন, বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি যদি বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের উপযুক্ত মর্যাদার সঙ্গে ফিরিয়ে নিতে পাকিস্তানকে বাধ্য না করে তাহলে ভারত কার্যকর পন্থা অবলম্বনে বাধ্য হবে। | কিন্তু সে কার্যকর পন্থা কতদিনে গৃহীত হবে আমাদের জানা নেই। বাংলাদেশের গণহত্যায় যে বিবেক অপদার্থের মত নিশ্ৰুপ সে বিশ্ববিবেকের উপরও আর ভরসা রাখা মুশকিল। কাজেই ভারত সরকার যদি প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ না করেন তাহলে অবস্থা হয়তাে একেবারেই আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।

২৯ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ -খন্ড ০৮, আনন্দবাজার পত্রিকা