You dont have javascript enabled! Please enable it!

রবীন্দ্রনাথই দায়ী

এ মাসের গােড়াতে নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার এক প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের ঘটনার জন্য রবীন্দ্রনাথই দায়ী। প্রবন্ধটি লিখেছেন ওই পত্রিকার সম্পাদকীয় বিভাগের লেখক জেমস পি ব্রাউন। যার একটি বিরাট যােগ্যতা এই যে, তিনি কলকাতায় কোনাে সময় দু বছর কাটিয়ে গেছেন। অল্প বিদ্যা ভয়ংকরী কথাটা হয়তাে এখানে ঠিক প্রযােজ্য নয়, কিন্তু সাহেবদের ধারণা উড়াে কথা বা শােনা কথার ওপর নির্ভর করেই প্রাচ্য দেশীয়দের সম্পর্কে যা খুশি মন্তব্য করা যায়। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে এঁর জ্ঞানগর্ভ বক্তব্যটি এই : কবি রবীন্দ্রনাথ যদিও মানুষের মধ্যে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের কথা প্রচার করেছিলেন কিন্তু পরিহাস এই তার জন্যই বাঙালীদের মধ্যে উগ্র জাতীয়তাবােধ জেগে উঠেছে এবং তার ফল হিসেবেই পাকিস্তান ভেঙে দেয়ার হিংস্র লড়াই এবং ক্রমশ ভারতের ঐক্যও নষ্ট হয়ে যাবে।

দু’ বছর উভয় বাংলায় ঘােরাঘুরি করেও শ্রীযুক্ত ব্রাউন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্য শশাষণ ও নিপীড়নের কথা কিছুই বুঝতে পারেন নি! তিনি পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার এগারাে কোটি বাঙালীর চরিত্র সম্পর্কে নিন্দা-প্রশংসা মিলিয়ে টিপ্পনি কেটেছেন অনেক। যদিও এঁর ধারণা পশ্চিম বাংলার সবাই হিন্দু এবং পূর্ব বাংলার সব মুসলমান। এই বাঙালীরা ভাবপ্রবণ, হঠাৎ রেগে যায়-যদিও দেখতে সুন্দর সূক্ষ্ম ধরনের এবং ভদ্র-এরা তীব্রভাবে ভালােবাসে কবিতা আর রাজনীতি। একজন বাঙালী থাকলে কবি হবে। দু’জন হলে সাহিত্য পত্রিকা বার করবে এবং তিনজন হলেই রাজনীতি। বাঙালীর প্রধান বসন আড়া। কলকাতা এবং ঢাকার কফি হাউসে এবং গ্রামের বটগাছতলায় বাঙালীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট করে। ভারত ও পাকিস্তানের পশ্চিমের অধিবাসীরা মনে করে বাঙালীরা বাক্যবাগীশ আর অলস । বাঙালীরাও অবশ্য অন্যদের গ্রাহ্য করে না।

বাঙালী চরিত্রের বিশ্লেষণের হঠাৎ নতুন করে ধুম পড়ে গেছে পাশ্চাত্যে। নিউজ উইক সাপ্তাহিক লিখেছিল, বাঙালীদের প্রধান অস্ত্র ছাতা। শ্রীযুক্ত জেমস ব্রাউন বাংলার প্রকৃতি ও উর্বরতা সম্পর্কে প্রশংসা করলেও তিনি বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে গভীর অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। তার ধারণা, কিছুকাল আগেও বাংলাদেশ ছিল কুঁড়েমি ও সম্ভোগের পক্ষে আদর্শ জায়গা, লােটোস ইটারদের দ্বীপের মতন, বাইরে থেকে লােকেরা এসে এখানে ভিড় করেছে-তাই এখানে এত ঘনবসতি এত দারিদ্র ও সমস্যা। গণতন্ত্রের ধারক ও বাহক দেশের মানুষ হয়েও ইনি পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে বলেছেন বিচ্ছিন্নতাবাদী। বাংলাদেশে শতকরা কত জনের অক্ষরজ্ঞান আছে, তাও জানেন না এই লেখক। এর ধারণা, হিন্দুমুসলমান-নির্বিশেষে সমস্ত বাঙালীই রবীন্দ্রনাথের ভক্ত এবং তাঁর রচনা মুখস্থ বলতে পারে। ব্যাপারটা সত্যি হলে অবশ্য মন্দ হতাে না, আমরা গর্ব করতে পারতুম কিন্তু কোটি কোটি নিরন্ন শিক্ষাহীন গ্রামের মানুষের কথা আমাদের ভােলার উপায় নেই। এঁর লেখা পড়লে যে-কোনাে অ-বাঙালীর মনে হবে, রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাঙালীদের মধ্যে এমন এক প্রেরণা এনে দিয়েছে যা পাকিস্তান ও ভারতের পক্ষে ক্ষতিকর-দু’দেশের মধ্যে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে, এমনকি বিশ্বযুদ্ধ । রবীন্দ্রনাথের রচনা যে বাঙালীকে মানুষের মতন মানুষ হতে শিখিয়েছে সে সম্পর্কে এর কোনাে বােধই নেই।

রবীন্দ্রনাথের প্রসঙ্গ টেনে তিনি দু’-একটা গল্পও ছেড়েছেন। তার মধ্যে একটি এইরকম ঃ পূর্ব বাংলায়। কয়েক মাস আগে একজন মুসলমান শিক্ষকের ঘরে ঢুকে পড়েছে একদল পাঞ্জাবী সৈন্য। ছবি দেখে তারা। জিজ্ঞেস করলাে কার? ভাসানীর? -না। রবীন্দ্রনাথের। ওই নাম এমন কিছু বিপজ্জনক নয় ভেবে চলে গিয়েছিল সৈন্যরা। এই প্রসঙ্গে সাহেববরের মন্তব্য হায়, তারা বুঝতে পারেনি ভাসানীর চেয়ে রবীন্দ্রনাথ আরও কত বেশি বিপদ ডেকে আনবেন। -নীল উপাধ্যায়।  স্বাধীন বাংলার স্বীকৃতি চাই ঢাকা বেতারকেন্দ্র খুলেই কানে মধুকণ্ঠের প্রাণঢালা সংগীত-দেশাত্মবােধক সংগীত । বক্তব্য তার মধ্যে একটি-বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি। নানা সুরে ছন্দে ও কথায় একই উপলব্ধি ঝংকৃত ততই বাংলার মুখ দেখেছেন ওরা, প্রাণভরে বাংলাকে ভালবেসেছেন, দুঃখদহন মৃত্যুভয় একেবারে তুচ্ছ। ২৬ মার্চ সকালবেলা সংগীত-মুঞ্ছনা অকস্মাৎ স্তব্ধ। ঘােষিকার নিরুদ্ধ কণ্ঠ কানে এলাে ঃ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দমন করবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী ফৌজ পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যায় মেতেছে । এ কোরবানি কিছুতেই আমরা ভুলব না। | বন্দুক বেয়নেটে বেতারের পিককণ্ঠ সেই থেকে নিঃশব্দ করে দিয়েছে। এখন শুনতে পাই, পানজাবি গােলামরা ফৌজি নায়কদের হুকুম পড়ে যাচ্ছে একের পর এক এবং করাচির যত মনগড়া খবর। শুনতে পেলাম, মুজিবর রহমান দেশদ্রোহী। বলছে এক ইয়াহিয়া খান, চক্রান্ত করে যে লােক ক্ষমতা দখল করে। আছে, গণতান্ত্রিক বা নৈতিক অধিকার এক-বিন্দু যার নেই। বলছে যে মুজিবের বিরুদ্ধে-বাংলাদেশের জনগণমন-অধিনায়ক যিনি, গণতান্ত্রিক নির্বাচন এই সেদিনও যার শিরে সর্ব পাকিস্তানের শিরােপা চড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের ঘরের অদূরে ওপার বাংলায় এক আশ্চর্য সংগ্রাম, চিরকালের ইতিহাসে যা জীবন্ত হয়ে থাকবে।  

একপক্ষ আধুনিকতম মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত-রাস্তায় ট্যাঙ্ক, আকাশে বােমারু বিমান, জলে ফৌজি জাহাজ। অন্যপক্ষ সেই তুলনার প্রায় শূন্যহস্ত। লাঠি, দা, শড়কি ইত্যাদি নিয়েও ঝাপিয়ে পড়ে হাজারে হাজারে প্রাণ দিচ্ছেন। সংগ্রামী জনতার সকলের বড় হাতিয়ার আদর্শনিষ্ঠা ও বাংলারপ্রেম। বিরুদ্ধপক্ষ সেখানে হিংস্র পেশাদার সৈনিক মাত্র। জনশক্তি তাই অপরাজেয়। রক্তস্রোতে সবুজ বাংলাদেশ রাঙা হয়ে গেছে। সঠিক খবর পাবার উপায় নেই, পাশবিকতা বাইরে চাউর না হয় সেজন্য সরকম সতর্ক ব্যবস্থা। ইতিমধ্যেই লক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছেন শুনতে পাচ্ছি, আরও কত লক্ষ বলি হবে, জানি না। # সভ্যতা ও মনুষ্যত্বের সংকটক্ষণে বিবেকবান লেখক-শিল্পীরা চুপচাপ গৃহকোণে নির্বিকার হয়ে থাকতে পারেন না।

আমাদের প্রস্তাব ও দাবি ! !  (১) স্বাধীন বাংলাদেশকে অবিলম্বে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দান করা হােক। ঐ দেশের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন এবং তাদের সর্ববিধ সাহায্যদানের ব্যবস্থা হােক যেহেতু ভারত স্বাধীন বাংলাদেশের নিকটতম প্রতিবেশি ভারতকেই সকলের আগে এই ব্যবস্থায় এগিয়ে যেতে হবে।’ (২) কাশ্মীরের এক অংশ পানজাবি সামরিকচক্র অধিকার করে আছে। ফাসিসট নাগপাশ থেকে কাশ্মিরী ভাইদের মুক্তি জন্য ভারত এই মুহুর্তে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। ( (৩) পশুশক্তির তাণ্ডব বাইরে প্রকাশ না পায়, সেজন্য পানজাবি সামরিক চক্র কড়া সেনসর ব্যবস্থা ছাড়াও বাইরে সাংবাদিকদের বাংলা দেশ থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। সংবাদের জন্য উদ্বিগ্ন লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য আমাদের আকাশবাণী বি বি সি, ভয়েস অব আমেরিকা, অসট্রেলিয়া রেডিও ইত্যাদি নানাসূত্র থেকে সংবাদের উদ্ধৃতি দেন। এই সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রের প্রচারিত যাবতীয় সংবাদের ব্যাপক উদ্ধৃতির যেন বিশেষ রূপ ব্যবস্থা হয়। | (৪) পানজাবি সামরিক চক্র সম্পূর্ণ বিতাড়িত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যতদিন না পূর্ণ রাহুমুক্তি ঘটছে, ততদিন আমরা কালাে ব্যজ ধারণ করব, ভবন-শীর্ষে কালাে পতাকা ওড়াব। জয় বাংলা!

মনােজ বসু কলকাতা-২৯

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!