পরদেশে ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি
কয়েকখানি ইংরেজি ও একখানি বাংলা বইয়ের লেখক শ্রীনীরদচন্দ্র চৌধুরী অধুনা বিলাতে থাকেন। সেখানে তার প্রকাশ্য জীবিকা কি তা জানা যায় না। অনুমান করি, বিলাতি পত্র পত্রিকায় লেখালেখি করেই তাকে সংসার নির্বাহ করতে হয় ভিন্ন দেশে গিয়ে সম্পাদকদের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভর করা এক প্রকার বিড়ম্বনা বিশেষ। বিবেকের কাছে অনেক কুযুক্তি দিতে হয়, আমড়াকে আম বলে চালাতে হয়, ভাবের ঘরে পুকুর চুরি করতে হয়। কিন্তু নামতে নামতে চৌধুরী মশাই এ কোথায় নেমেছেন? এখন যে তাকে শুধু বাঙালী যা ভারতীয় বলে চিনতে অসুবিধে হবে তাই-ই নয়, এখন তাকে মানুষ বলেই যেন ঠিক চেনা যায় না। সাহেবদের তােষামুদি করারও তাে একটা সীমা আছে। গত ২১ ডিসেম্বর লন্ডনের ‘দি টাইমস’ পত্রে শ্রীনীরদ চৌধুরী মহাশয় একটি মস্তবড় প্রবন্ধ লিখেছেন। বিষয়, পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ার আশীর্বাদপ্রাপ্ত ব্যক্তির মতন উদাসীন! আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামে রাশিয়ার সাহায্য গ্রহণে দোষ কোথায়-সে সম্পর্কেও তিনি মুক, প্রকারান্তরে বলতে চান, ভারত কেন মারকিন হুমকির কাছে নতি স্বীকার করলাে না।
বেশি দুঃখ বাজলাে একটি কারণে। নীরদ চৌধুরী প্রায়ই উল্লেখ করেন, পূর্ববঙ্গে তাঁর জন্ম। এই পূর্ববঙ্গ থেকে যে কোটি, আবার বলছি, এক কোটি মানুষ অত্যাচরিত হয়ে গৃহহারা হয়েছিল-সে কথা তিনি একবারও উল্লেখ করলেন না! ভারতের বুঝি উচিত ছিল ঐ এক কোটি নিরাশ্রয় অসহায় মানুষকে সীমান্ত থেকে গুলি মেরে তাড়িয়ে দেওয়া? কিছুদিন আগেকার পূর্ববাংলা যা পূর্ব পাকিস্তান যে শত সহস্র বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হলাে-তাও তাঁর বিবেককে একবারও নাড়া দিল না? একি বিস্মৃতি না বিভ্রম, না মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ বস্তুত, এসব কাজে লেখার ওপর কোনাে গুরুত্ব দেওয়া একটি মস্তবড় প্রবন্ধ লিখেছেন। বিষয়, পাকিস্তান ভারত যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারত ও বাংলাদেশ বিজয়ী হওয়ায় তিনি খুব চটে গেছেন। কি কারণে জানি না, তিনি গােড়া থেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ঘােরতর বিরােধী, অবিকল ইংরেজ ও আমেরিকানদের মতন। তিনি নিজেকে একজন মস্তবড় সমর বিশেষজ্ঞ মনে করেন যদিও স্পারটা কিংবা থারমাপলির যুদ্ধের ইতিহাস অবলম্বনে আধুনিক যুদ্ধের বিচার করেন-এবং বার বার বলেছেন, এই যুদ্ধে পাকিস্তানের জয় অবশ্যম্ভাবী। যুদ্ধের ফলাফল বিপরীত হওয়ায় তিনি মারকিন সরকারের চেয়েও বেশি হতবুদ্ধি এবং ক্ষুব্ধ। তিনি বলেছেন, প্রথম মহাযুদ্ধে অসট্রিয়া হঠাৎ সারবিয়া আক্রমণ করে কিংবা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে নাৎসী জারমানি হঠাৎ পােল্যান্ড আক্রমণ করে যে হঠকারিতা করেছিল-এই যুদ্ধে ভারতের হঠকারিতা তার দ্বিগুণেরও বেশি। অর্থাৎ ভারতের অপরাধ হিটলারের চেয়েও বেশি। প্রবন্ধটির শিরােনামায় নীরদ চৌধুরীর পরিচয় দেওয়া হয়েছে বাঙালী, হিন্দু ও ভারতীয় হিসেবে। এই পরিচয় দিয়ে সাহেবরা নিশ্চয়ই খুব মজা পেয়েছে, প্রেস ক্লাবে হেসে নিয়েছে একচোট। বিলেত-প্রবাসী দৃষ্টিতে চৌধুরী মশাই পুরাে যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতটাই দেখেছেন হিন্দু মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের ভিত্তিতে। ভারত ও বাংলাদেশে যখন সাম্প্রদায়িকতা মুছে ফেলার আন্তরিক প্রয়াস চলছে, তখন পুরােনাে বৃটিশ কায়দায় তিনি সাম্প্রদায়িক বিষ উসকে দেবার চেষ্টা করছেন। উদাহরণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করতে ভােলেন নি যে অষ্টম শতাব্দীতে আলবেরুনির সময়েও হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ ছিল! একেই বােধহয় ক্রিশচিয়ানরা বলে ‘ক্যোজুইসট্রি।’
দু’ কলমব্যাপী প্রবন্ধে তিনি পাকিস্তানের কোনাে দোষের কথা একবারও উল্লেখ করেননি। তিনি বলেছেন, পাকিস্তান ভেঙে দেবার জন্য ভারতে হিন্দু নেতারা আগাগােড়া চক্রান্ত করেছেন এমনকি পাকিস্তানকে কাশ্মীরও না-দেওয়ার মতন অপরাধ করা হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতি ভারত সরকারের কোনাে সহানুভূতি তাে নেই, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীদেরও ভারত সরকার ঘৃণা করে। এই সব পড়ে কেউ হয়তাে হঠাৎ নীরদ চৌধুরীকে পাকিস্তানের চর মনে করে ফেলতে পারে; আমরা অবশ্য সে-রকম কোনাে সিদ্ধান্তে আসতে চাই না। শুধু এইটুকুই বলা যায়, এইসব কথা আমরা পশ্চিম দিক থেকে আগেও কয়েকবার শুনেছি ও পড়েছি। টাইমস এ রকম বস্তাপচা। পুরােনাে কথাও ছাড়ে? আশ্চর্য! এই যুদ্ধে ভারত সফল হওয়ায় নীরদ চৌধুরীর সবচেয়ে বেশি ক্রোধের কারণ, তিনি জানেন, ভারত এবার রাশিয়ার কাছে নাকি স্বাধীনতা বিসর্জন করলাে সম্পূর্ণভাবে। তিনি জেনে গেলেন? গােপনসূত্র আছে নাকি? যথারীতি এই প্রসঙ্গেও তিনি ১৯২২ সালের একখানা চোখা বিষয়ের উল্লেখ করছেন। ৫০ বছরের ইতিহাস কতখানি বদলে যায় বা গেছে, সে সম্পর্কে তিনি বিস্মৃতি না বিভ্রম, না মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষণ? বস্তুত, এসব কাজে লেখার ওপর কোনাে গুরুত্ব দেওয়াই উচিত নয়। কিন্তু সাহেবদের নামকরা কাগজে এইসব ছাপা হয় কিনা-সেইটাই চিন্তার বিষয়।
-সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কলকাতা
২৯ ডিসেম্বর, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা