You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.09.10 | অত্যাচারের অভিযােগ একটি জবাব - সংগ্রামের নোটবুক

অত্যাচারের অভিযােগ ঃ একটি জবাব

গত ২৩.৮,৭১ তারিখে আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীনিরঞ্জন হালদার ও বামনগাছির শেখ আজিজুর রহমানের বক্তব্যের প্রতিবাদে আমার কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভারতবর্ষের মুসলমানেরা অন্যান্য অনেকের সঙ্গে সমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকার ভােগ করে। চলেছেন। স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর থেকে তাদের সঙ্গে এতকাল যেভাবে বসবাস করে এসেছি ভবিষ্যতেও সেভাবে চলবার আশা রাখি । উপরােক্ত দুজনেই অভিযােগ করেছেন পুলিশী অত্যাচারের বিরুদ্ধে, কিন্তু কেন হঠাৎ পুলিশ তাদের উপর নিপীড়ন চালাতে গেল, তার উল্লেখ তাে কোথাও নেই। নিশ্চয়ই কোন সঙ্গত কারণ ছিল। সমাজবিরােধীদেরও ওপরও তাদের অভিযােগ কম নয়। কথাটা ভালই কিন্তু সমাজ-বিরােধী কারা তা একবার ভেবে দেখা যায় না কী? ঘটনাস্থল মন্ডলগাছি বিধায় আমাদের বক্তব্যের দুটো পৃথক সম্প্রদায়ের উল্লেখ থাকবে, কেন না সম্প্রদায়গতভাবে সেখানে একচেটিয়া মুসলমানের বাস। এতে কেউ ভুল না বুঝলেও কৃতজ্ঞ থাকবাে।

আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ বিধায় মুসলমান ও অন্যান্য সম্প্রদায় আমাদের সঙ্গে সৎ প্রতিবেশীর মতাে বসবাস করবেন এটা আমরা প্রত্যেকের কাছে আশা করি। কিন্তু তারা যদি মনে করে থাকেন যে যেহেতু তারা গণতন্ত্রের সব সুযােগ সুবিধাদি পেয়ে থাকেন এবং সেই ধর্মনিরপেক্ষর ধুয়াে তুলে অন্যায় কাজ করেও জনসাধারণের সহানুভূতি আদায় করতে পারবেন তাহলে তারা ভুল করবেন। এক্ষেত্রে আমি একটি সাম্প্রতিক ঘটনার কথা উল্লেখ করবাে। গত মার্চ মাসের দ্বিতীয় পক্ষের মাঝামাঝি মণ্ডলগাছিতে একজন হিন্দু ভদ্রলােক স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্যে আসেন। তাঁর এখানকার সম্পত্তিতে অধিকার বিনিময়সূত্রে । যদিও চারিদিককার মুসলমান পরিবারের মধ্যে তিনি একা একমাত্র হিন্দু তবুও ব্যক্তিগতভাবে তিনি বিশেষ অসুবিধা বােধ করেননি, কারণ পূর্ব বাংলায়ও তিনি তার মুসলমান প্রতিবেশীদের মধ্যে এতকাল কাটিয়ে এসেছেন। এখানে তার মুদিখানার দোকান আছে যা সম্প্রদায় নির্বিশেষে প্রত্যেকের প্রয়ােজনে লাগে।

তিনি ২৫ মার্চের আগে এখানে আসতে পারায় প্রয়ােজনীয় ব্যক্তিগত জিনিষপত্র পূর্ব বাংলা থেকে নিয়ে আসতে পেরেছিলেন। গত ৩০.৭.৭১ তারিখে রাত আনুমানিক ৯-৩০ মিনিট সময় উক্ত ভদ্রলােকের বাড়িতে একদল সশস্ত্র লােক এসে পাইপ গান ও বােমা দেখিয়ে তাদের সর্বস্ব লুঠ করে নিয়ে যায় যার আনুমানিক মূল্য হবে দশ হাজার  টাকার মতাে। লুটেরা লুট করে চলে যবার সময় বােমা ফাটিয়ে চলে যায়। সৌভাগ্যক্রমে ঘটনাস্থলে একজন। যুবককে তাঁরা চিনতে পারেন। পাশের প্রতিবেশীরা তখন বােধহয় জেগে জেগে ঘুমােচ্ছিলেন। যথেষ্ট চিঙ্কার ও বােমা ফাটানাের শব্দের পরেও যদি তারা বলতে পারেন যে আমরা কিছুই জানি না তাহলে এ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। এমন কী পরদিন সকালেও তারা কোন সহানুভূতি দেখাবার প্রয়ােজন বােধ করেননি। আর কোন সহানুভূতি না আশা করে ভদ্রলােক আর একজনের সঙ্গে থানাতে গিয়ে সব জানালেন। যথাসময়ে এজাহারে উল্লিখিত যুবককে পুলিশে ধরে নিয়ে যায়। অভিযুক্ত যুবককে ধরে নিয়ে যাবার পর থেকেই আরম্ভ হলাে আমাদের তথাকথিত অসাম্প্রদায়িকদের হিন্দু ভদ্রলােকটির উপর তাদের অসাম্প্রদায়িক মনােভাবের সূচনা। স্থানীয় মুসলমানদের উপর তাদের প্রথম নির্দেশ হলাে হিন্দু ভদ্রলােকটির মুদিখানার দোকান বয়কট করা ও দ্বিতীয়ত তার জমাজমিতে কোন রকম কৃষিকাজ না করা।

আসল কথা হলাে কেন তারা এভাবে একটা মনােভাব সৃষ্টি করতে গেলেন। দোষীর শাস্তি দেওয়ার ভার কী তাদের হাতে? পুলিশ যদি নির্দোষ ব্যক্তিদের উপর অত্যাচার করে তাহলে শুধু আমি কেন প্রত্যেকেই তার প্রতিবাদ করবাে, কিন্তু যারা এইভাবে সাম্প্রদায়িক মনােভাবের সৃষ্টি করতে পারে তাদের উপর পুলিশী অভিযােগ কী  উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে না? সুধীরবাবুর সঙ্গে আমার জানাশােনা বেশি দিনের নয়। তবু কেন ভদ্র ও শিক্ষিত লােকের বিরুদ্ধে উদ্দেশ্যমূলক মিথ্যা প্রচারণা চালিয়ে তার সামাজিক সম্মান নষ্ট ও লােকচক্ষে তাকে হেয় প্রতিপন্ন করার ব্যাপারে নিরঞ্জনবাবুর অধিকার কতখানি রয়েছে তা তিনি একবার ভেবে দেখবেন কী? এমন একটা ভয়ঙ্কর ঘটনার পরও যারা নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধির এবং জনমতকে বিভ্রান্ত করার জন্য এইসব অপকীর্তি করে চলেছে তাদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করা উচিত।

-শান্তিপদ ঘােষ, গ্রাঃ পােঃ বাণীপুর (হাবড়া) ২৪ পরগণা।

১০ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা