You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.06.09 | শরণার্থী সমস্যার সুষ্ঠু মােকাবিলা না হলে পশ্চিমবঙ্গ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে কেন্দ্রকে জরুরী অবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজেশ্বর রাওয়ের দাবি | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থী সমস্যার সুষ্ঠু মােকাবিলা না হলে পশ্চিমবঙ্গ বিধ্বস্ত হয়ে যাবে কেন্দ্রকে জরুরী অবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রাজেশ্বর রাওয়ের দাবি
(স্টাফ রিপাের্টার)

কলকাতা, ৮ জুন- বাঙলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সমস্যা যদি সুষ্ঠুভাবে মােকাবিলা করা না হয় তাহলে পশ্চিমবঙ্গও বিধ্বস্ত হয়ে যাবে। ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক শ্রীরাজেশ্বর রাও আজ এই ঘােষণা করে কেন্দ্রকে অবিলম্বে শরণার্থীজনিত সমস্যাকে জরুরী অবস্থার অনুরূপ মােকাবিলা করার দাবি করেছেন।
প্রতিটি রাজ্য যাতে নিজ নিজ এলাকায় বাঙলাদেশের শরণার্থীদের অস্থায়ীভাবে আশ্রয় দেবার ব্যবস্থা করে এবং শরণার্থীদের সাহায্যার্থে পশ্চিমবঙ্গে সব দিক থেকে সুসম্পূর্ণ একটি করে বড় হাসপাতাল স্থাপন করে সেই উদ্দেশ্যে রাজ্য সরকার গুলির উপরে চাপ সৃষ্টি করার জন্য শ্রীরাও সমস্ত রাজ্যের কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্ব ও পার্টি ইউনিটগুলির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
বাঙলাদেশের শরণার্থী সমস্যার মােকাবিলা করার দায়িত্ব পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে একযােগে সমগ্র দেশকে বহন করতে এগিয়ে আসতে হবে বলে শ্রীরাও মন্তব্য করেন।
তিনি এই মর্মে হুঁশিয়ারি দেন যে, মহামারী, বুভুক্ষা ও সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামার আবর্তে বাঙলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে ডুবিয়ে দেবার জন্য ইয়াহিয়া চক্রের ষড়যন্ত্র যেন সফল না হতে পারে। শ্রী রাও তাঁর বিবৃতিতে বলেছেন :
‘বাঙলাদেশ থেকে শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গে ব্যাপক আগমনে এক বিস্ফোরক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ৫০ লক্ষ শরণার্থী পশ্চিমবাংলায় এসেছেন। প্রত্যহ লক্ষ লক্ষ আসছেন, এখন পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গ সরকার মাত্র ৫ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় এবং শতকরা ২৫ ভাগকে সামান্য রেশন দিতে পেরেছেন। কলেরা এবং অন্যান্য মহামারী রােগ ছড়িয়ে পড়েছে। হাজার হাজার লােক ইতিমধ্যে মারা গেছেন। স্বল্প ঔষধ ও অপ্রতুল ময়লা নিষ্কাশনা ব্যবস্থা সমস্যার ক্ষুদ্রাংশও মােকাবিলা করতে পারে না। এখন আর কেবলমাত্র বাঙলাদেশের বীর এবং মন্দভাগ্য শরণার্থীরই মৃত্যুর মুখােমুখি হচ্ছে না, পশ্চিমবঙ্গের জনগণও মহামারী এবং ক্ষুধার শিকারের বিপদের সম্মুখীন হচ্ছে না। যদি সমস্যাকে দৃঢ়ভাবে মােকাবিলা না করা হয়, তবে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, সমগ্র পশ্চিমবঙ্গই বিধ্বস্ত হয়ে পড়বে।
“উপরন্তু স্থানীয় জনগণ এবং শরণার্থীদের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছেন। এবং যে কোন সময়ে ব্যাপক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধে যাবার বিপদ রয়েছে। নিজেদের রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার জন্য সাম্প্রদায়িক এবং বিভেদকামী শক্তি এই সুযােগ গ্রহণ করছে।
যে ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক চক্র সচেতনভাবে আমাদের দেশে বিপুল শরণার্থী সমস্যার সৃষ্টি করেছে। মনে হয় তাদের চক্রান্ত সফল হবে যদি বাঙলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে মহামারী, বুভূক্ষা এবং সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় ডুবিয়ে দেবার জন্য এইসব সায়িক এবং বিভেদপন্থী শক্তিগুলিকে তাদের ঈপ্সিত পথে চলতে দেওয়া হয়। এই জটিল সমস্যার সমাধান একা পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে করা সম্ভবপর নয়। এটা সমগ্র দেশের সমস্যা এবং এই সমস্যার সমাধান সম্ভব যদি সারা দেশ এটাকে যথােপযুক্ত গুরুত্ব দেয়।
“এই ব্যাপারে ভারত সরকারের নির্মম মনােভাব অমার্জনীয়। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আমি প্রধানমন্ত্রী এবং ভারত সরকারকে এই সমস্যা সম্পর্কে জরুরী অবস্থার অনুরূপ ব্যবস্থা নেবার জন্য দাবি করছি। শুধু যে ভারত সরকার অবশ্যই প্রয়ােজনীয় যাবতীয় সাহায্য দেবেন তাই নয়, তাদের প্রতিটি রাজ্য সরকারকে এ ব্যাপারে সবরকম সাহায্য দেবার জন্যও বাধ্য করতে হবে।
“বিপর্যয় এড়াবার জন্য আমি কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের কাছে নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলি অবলম্বন করার জন্য অনুরােধ জানাচ্ছি :
১. বাঙলাদেশের শরণার্থীদের বাঁচাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রয়ােজনীয় খাদ্য, ওষুধও তাঁবু পাঠাবেন। যতগুলি রাজ্যে সম্ভব শরণার্থীদের ছড়িয়ে দিতে হবে ।
২. প্রতিটি রাজ্য সরকারকে চিকিৎসক, অন্যান্য চিকিৎসা কর্মী ও পুরােপুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা সহ কমপক্ষে একটি করে বড় হাসপাতাল পশ্চিম বঙ্গে খুলতে হবে বাঙলাদেশ শরণার্থীদের সাহায্যার্থে।
“শরণার্থীদের গ্রহণ ও তাদের জন্য অস্থায়ীভাবে আশ্রয়, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিস জোগাবার ব্যবস্থা রাজ্য সরকারগুলিকে করতে হবে।
৩. সােভিয়েত ইউনিয়ন, হাঙ্গেরী, জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র এবং অন্যান্য দেশ ও বিশ্ব সংস্থাগুলি যে বিপুল সাহায্য পাঠাচ্ছে তা যাতে দ্রুত শরণার্থীদের কাছে পৌঁছায়, কেন্দ্রীয় সরকারের সে জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সমস্ত রাজ্য নেতৃত্বের কাছে এবং অন্যান্য পাটি ইউনিটের কাছে আমি অনুরােধ জানাচ্ছি, এই বিষয়টি যেন তারা সমূহ গুরুত্ব দিয়ে গ্রহণ করেন এবং পশ্চিমবঙ্গে বাঙলাদেশ শরণার্থীদের জন্য চিকিৎসা সাহায্য, হাসপাতালের যন্ত্রপাতি, ডাক্তার ও অন্য সব ধরণের সাহায্য পাঠাবার জন্য এবং সেই সঙ্গে রাজ্যগুলিতে শরণার্থীদের স্থান দেবার ব্যবস্থা করার জন্য নিজ নিজ রাজ্য সরকারের উপর চাপ দেন।
“এই সঙ্গে যে সব ডাক্তার পশ্চিমবঙ্গে শরণার্থীদের মধ্যে কাজ করার জন্য স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসবেন তাদের পাঠাবার ব্যবস্থা করার জন্য পার্টি ইউনিটগুলিকে অনুরােধ জানাচ্ছি।”

সূত্র: কালান্তর ৯.৬.১৯৭১