অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দুই বাংলা
পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইয়াহিয়া ও মুজিবর রহমানের বর্তমান সম্পর্কটাকে এ বাংলার হিন্দু ও মুসলমানরা সবাই একভাবে দেখতে পারছে না। এই সত্যটা স্বীকার করতে হয়। বিরাট অংশের মুসলমান পাকিস্তান টুকরাে হয়ে যাক এটা চায় না। শেখ মুজিবর রহমানের জয় এবং তাঁর নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা এই উপমহাদেশে অনেক সম্ভাবনায় জন্ম দিতে পারে-এই প্রত্যাশায় অভিনন্দন জানাতে কারাে কুণ্ঠা ছিল না।
কিন্তু পরবর্তী ঘটনা একটা আপাত দ্বন্দ্বের জন্ম দিয়েছে। ঠিক সময়ে তা কেটে যাবে। এই মুহূর্তে ভাবা দরকার আছে কেন এত দ্বন্দ্ব এবং কাদের মধ্যে? | সব মুসলমান এই দ্বন্দ্বে ভুগছেন না একথা সবাই জানি। অসংখ্য মুসলমান এ দেশে আছেন যারা পাকিস্তান ব্যাপারটিকে খুব ভাল মনে মেনে নেননি। তাঁদের ধারণা-পাক-ভারত সীমানায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বীজ পােতা আছে। পাকিস্তান সাম্প্রদায়িকতায় প্রতিমূর্তি। ওদেশে ধর্ম রাষ্ট্রের ধুয়া এদেশে হিন্দুদের সাম্প্রদায়িক করে তােলে। এখানে কোন কোন রাজনৈতিক দলের নীতির ভিত্তি পাকিস্তান বিদ্বেষ এবং তা থেকে মুসলিম বিদ্বেষ। এই পাকিস্তান ও ভারতের মােট ষােল-সতের কোটি মুসলমানের মধ্যে ভারত ও পাকিস্তানের মিলিত এপার-বার কোটি মুসলমান নানানভাবে ভুগছে দেশ ভাগ হওয়ার ফলে এখানেই প্রমাণিত হয় পাকিস্তান মুসলমানদের স্বার্থে কোন কল্যাণ আনতে পারেনি। অন্য দিকে অসংখ্য হিন্দুর জীবনে অনেক সংকট এনেছে।
দেশভাগকে যারা মুসলিম স্বার্থে এবং বৃহত্তর স্বার্থের অনুকূল ভাবেননি তেমন মুসলমানও অনেক। কাজী আবদুল ওয়াদুদ, কবিররা দুই ভাই, মামুদরা দুই ভাই এবং আরও অনেক মুসলমান যাদের বাড়ি ওবাংলার কোন গ্রামে তারা ওদেশে ফিরে যাননি শুধু দেশবিভাগ মেনে নেননি বলে । চাগলাজিন্নার বিরােধ, মামাভাগনার বিরােধ হিসেবে পরিচিত। এও দেশভাগকে কেন্দ্র করে। এমনকি জামায়াৎ-ই-উলেমা-ই-হিন্দ দেশভাগের বিরােধিতা করেছিলেন। আরও অনেক নাম করলাম না যারা সহ বহু মুসলমান দেশ ভাগ চাননি। তাদের ভুলে গেলে তা চলবে না। এইজন্য সমস্ত মুসলমানকে বিভ্রান্ত বা বিচলিত মনে করার কোন হেতু নেই। পাকিস্তানে গিয়ে মুসলমানরা কিছু সুযােগ পেলেও তা কতটুকু? একথা সবাই জানে মুসলমানদের একটা বড় অংশ সংকীর্ণতায় ভুগছে। এই সমাজের বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল অংশকে তারা অবিশ্বাস করে, হিন্দুঘেঁষা বলে সন্দেহ করে। অন্য দিকে তাদের সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় দেয় ধনী মুসলমান, রাজনীতিক দল ইত্যাদি। সরকারও এর বিরুদ্ধে দৃঢ়তা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই বিদ্যায়তনের বা রাজনৈতিক দলের বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানের নামের সঙ্গে মুসলিম কথাটি বিবেচনার ভিত্তি হয়ে দাঁড়ায়। সংবিধান ও সরকার তা স্বীকার করে। আর এজন্য অপরাধী হয় সমস্ত মুসলমান সমাজ।’ বিষয়গুলাে গভীর চিন্তার দাবি করে।
অন্য দিকে বাঙালী মুসলমান করুণার পাত্র কার কাছে নয়? নিজ দেশে উপহাসের পাত্র সে। ‘চাচা’ নেড়ে মােছলা শুনতে হয় না কোন্ মুসলমানকে? অসতর্ক মুহূর্তে বক্তা বলে ফেলেন, শ্রোতা জনতার অংশ। | হিসাবে মনে ক্ষোভ চেপে ফিরে যায়। শহরে শুনতে হয়-“তুই কী করে বাঙলা শিখলি’ কবে পাকিস্তান থেকে এলি। তােকে মাইরী ভদ্রলােকের মতাে দেখাচ্ছে তােকে বাঙালীর মতাে মনে হয়, মুসলমান বলে বােঝা যায় না’ ইত্যাদি। ঐ কথাগুলির জন্ম কোথা থেকে? মুসলমান যারা পৃথিবীর উন্নত কোন জাত থেকে কিছুমাত্র পশ্চাৎপদ নয় তাদের সচেতন মনে উপরােক্ত কথাগুলাে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি না করে পারে না। মুসলমানদের সম্বন্ধে হিন্দুদের অনেক ভুল ধারণা আছে বলে অনেক বিরােধও টিকে আছে। ওদিকে পাঠানরা। বাঙালীকে মুসলমান ভাবতে পারে না, এদিকে হিন্দুরা মুসলমানদের বাঙালী মনে করতে পারে না। উভয় দিকে স্বীকৃতির অভাব ওবাংলার ‘বিদ্রোহী’ এবং এ বাংলায় নীরব’ করে রেখেছে মুসলমানদের।
আরও একটা অংশ ক্ষুব্ধ হচ্ছে কিছু কিছু কারণে। মুসলিম ইনসটিটিউটের সভার মুসলমানরা যে আন্তরিকতা দেখিয়েছে তা তাে বিচ্ছিন্নভাবে তারা অন্যত্র দেখাচ্ছিল। তাহলে আবার এক জায়গায় ঠেলে দেওয়া কেন? এদের কথা বলেছেন তার জন্য তাকে ধন্যবাদ। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সূত্রপাতে, পাকিস্তানের বুনিয়াদ টলে যাওয়ার পশ্চিম বাংলা তথা সারা ভারতের হিন্দুরা যে উল্লসিত। এ ধরনের অযৌক্তিক অভিপ্রায় আরােপ কতটুকু বেগম আয়ুবের স্বীয় মনের সৃষ্টি বা কতটা এ দেশের মুসলমানদের মনােভাবের যথার্থ অভিব্যক্তি, তা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়। সত্য হিন্দুরা পাকিস্তানকে গ্রহণ করেনি, কিন্তু কখনাে তারা মনেপ্রাণে পাকিস্তানের ধ্বংস কামনা করেনি। পাকিস্তান সম্বন্ধে তারা নির্বিকার উদাসীন থাকতে চেয়েছেন, কারণ ওই রাষ্ট্র সম্বন্ধে তাদের কোনাে মােহ ছিল না। পাকিস্তান ধ্বংসের সূত্রপাত হয়েছে। নিজের দেশের মাটিতে-আপন নাগরিকদের দ্বারাই।
হিন্দুরা যে মনােভাব থেকে পাকিস্তানকে গ্রহণ করেছেন, পশ্চিমবঙ্গ তথা সারা ভারতের অধিকাংশ মুসলমান নাগরিকেরা কিন্তু অনুরূপ মনােভাব নিয়ে পাকিস্তানকে গ্রহণ করেননি। তাদের মনের নিভৃত কোণে, ওই কল্পিত স্বর্গরাজ্যটি সম্বন্ধে যথেষ্ট মােহ থেকে গিয়েছে। ধর্ম, সম্প্রদায় ও ওই রাষ্ট্রটির অস্তিত্বের পটভূমিকার যখন এখানকার মুসলমানেরা চাপ সৃষ্টি করে সুবিধা আদায় করতে চেয়েছেন, ঠিক অনুরূপভাবে এপারে রাষ্ট্রের দিকে চেয়ে ওপারের হিন্দুরা কখনাে সুবিধা আদায় করতে চাননি। দৃষ্টান্ত ১৯৭১ সালে এখানকার সেকুলার রাষ্ট্রে মুসলিম লীগের অস্তিত্ব সম্ভব হলেও ওপারে হিন্দুমহাসভার অস্তিত্ব অকল্পনীয়। সংকীর্ণ স্বার্থ নয়। মনুষ্যত্বের চরম অবমাননায় যখন এপারের হিন্দুরা এবং গত তেইশ বছরের ধর্মীয় রাষ্ট্রের অনুশাসনের তিক্ত অভিজ্ঞতার পটভূমিকায় ওপরের মুসলমানেরা জঙ্গীশাহীর বিরুদ্ধে চরম সংগ্রামের অসম্প্রদায়িক হয়ে মিলিত হতে পেরেছেন, তখন এ দেশের মুসলমানেরা যদি বিচলিত বিভ্রান্ত যা বিক্ষুব্ধ হন, তবে আগামী ইতিহাস তাদের ক্ষমা করবে না। -গুরুপ্রসাদ দত্ত কলকাতা-৫৬।
বদরুদ্দীন উমর
কদিন আগে (১৬ বৈশাখ) আপনাদের কাগজে বদরুদ্দিন উমর সম্পর্কে একটি চিঠি পড়লাম। পত্ৰলেখক শুনেছেন ঃ উমর মারা গিয়েছেন। উমর সাহেব মারা গিয়েছেন, এমন কোন সংবাদ আমরা বাংলাদেশে পাইনি তাকে যদি পাক ফৌজ মেরে ফেলে থাকে, তবে সেটা নিত্যন্তই অপঘাত। কারণ উমর সাহেব গোড়া মাওপন্থী। গোড়া মাওবাদীরা আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের কোন অংশই গ্রহণ করছেন না। জানি না, পত্রলেখক এ-সব কথা জানেন কী না। তবে এপার বাংলার মানুষের জানা দরকার, জামাতে ইসলাম ও মুসলিম লীগ ইসলামের নামে সমর্থন করছে সামন্ততান্ত্রিক জঙ্গীশাহীকে। অন্য দিকে চীনের কল্যাণে কার্যত সমর্থন করছেন সেই একই গণহত্যা কারীদের উগ্রবামের ভক্তবৃন্দও। উমর যদি সত্য মারা গিয়ে থাকেন, তবে ব্যক্তিগতভাবে আমিও দুঃখিত। দুঃখিত আরাে এই কারণে, তিনি কোন আদর্শের জন্য মারা যাননি। মারা গিয়েছেন অপঘাতে।
-সফিক চৌধুরী।
১০ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা