সম্পাদক সমীপেষু – বাংলাদেশের বামপন্থী
পশ্চিম বাংলার দৈনিক এবং সাপ্তাহিকে বাংলাদেশের বামপন্থীদের সম্পর্কে লেখায় অনেক বিভ্রান্তি আছে। বামপন্থী বলে কথিত নেতারাও কম ধূম্রজাল সৃষ্টি করেননি। পশ্চিম বাংলায় এমন একটি পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হয়েছে, যে বামপন্থীরা বাংলাদেশে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছে প্রায়। কলকাতার নকশালপন্থীরাও পূর্ব পাকিস্তান কম্যুনিস্ট পারটি মােহম্মদ তােয়াহাকে লাল সেলাম দিয়ে ফেলেছেন। যদিও বাংলাদেশের মানুষ একথা জানত না যে, তােয়াহা হক গ্রুপই আসল নকশাল। কারণ বাংলাদেশের মাওপন্থীদের চারিটি উপদলই নিজেদের নকশাল অর্থাৎ চারু মজুমদারের শিষ্য বলে দাবি করে। এদের মধ্যে কলকাতার নকশালদের বােমাবাজি করতে অভ্যস্ত একমাত্র মাওপন্থীদের সিরাজ শিকদার গ্রুপ। তােয়াহা-হক গ্রুপ সম্পর্কে এমন কথা বাংলাদেশে শােনা যায়নি। বাংলাদেশের এ চারিটি মাওপন্থী উপদলের মধ্যে তােয়াহা-হক গ্রুপের যশাের-খুলনা কৃষকদের মধ্যে ভালাে সংগঠন আছে, ছাত্র, শ্রমিকরা অন্য কোন ফ্ৰনটে ফ্রনট হিসাবে এঁরা কাজ করেন না। মাও পন্থীদের দ্বিতীয় গ্রুপ মতিন-আলাউদ্দীন যাদের প্রধান সংগঠন পাবনা জেলায় কৃষকদের মধ্যে। এছাড়া উত্তরবঙ্গের এবং যশােরে কোন কোন এলাকায় এদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংগঠন আছে। শ্রিমিক ফ্রনটে এদের চট্টগ্রামে খানিকটা প্রতিপত্তি ছিল। বাংলাদেশ প্রশ্নে দেবেন সিকদার-যশাের উপদলের সাথে এদের মতভেদ হওয়ায় সে সংগঠন আজ নেই। শেনা যায়, এদের ছাত্র সংগঠন পূর্ব বাংলা ছাত্র ইউনিয়ন ভেঙ্গে দেওয়া হয়েছে। এদের শ্রমিক সংগঠনের নাম পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন। মাওপন্থীদের তৃতীয় গ্রুপসিরাজ সিকদারের দলকে পূর্ব বাংলা শ্রমিক শ্রেণীর মধ্যে এমন কোন সংগঠন নেই। চট্টগ্রাম, বরিশাল ও খুলনায় তরুণদের মধ্যে এদের খানিকটা প্রতিপত্তি আছে।
মাওপন্থীদের চতুর্থ গ্রুপ-ঢাকার কাছে শিল্প এলাকা টঙ্গীতে জাফর-মেনন গ্রুপ। এদের টঙ্গীতে ভাল শ্রমিক সংগঠন। খুলনার বাগেরহাটে এদের কৃষকদের মধ্যে সংগঠন আছে। এদের ছাত্র প্রতিষ্ঠান বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন এবং শ্রমিক সংগঠন পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন। মাওপন্থীদের বাদ দিলে বাংলাদেশে আর দুটি বামপন্থী প্রতিষ্ঠান আছে। এদের মধ্যে একটি ১৯৬৯ সালে গঠিত, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, অপরটি ওয়ালী-ন্যাপ (যদিও ওয়ালী-ন্যাপ নেতৃবৃন্দ হঠাৎ কলকাতায় এসে নিজেদের বাংলাদেশ ক্যুনিস্ট পারটি হিসাবে পরিচয় দিতে শুরু করেছেন। ওয়ালী-ন্যাপ নেতৃবৃন্দকে ব্যক্তিগত আলাপে ইতিপূর্বে মসূকোপন্থী কম্যুনিস্ট বললে চটে যেতেন। অথচ কলকাতায় এসে এঁরা নিজেরাই কম্যুনিসট হয়ে গেছেন এবং শ্রী আবদুস সালাম নামে এক ব্যক্তিকে বাংলাদেশ কম্যুনিসট পারটির সম্পাদক বলে জানিয়েছেন- বাংলাদেশে মনিসিং ও ওয়ালী-ন্যাপের লােক বলে আমরা জানতাম তাদের পত্র-পত্রিকায় তা-ই বলা হত। এমনকি ওয়ালি-ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি অধ্যাপক মােজাফফর আহমদকে বাংলাদেশ কমুনিসট পারটির লােক বলা হলে তিনি আজও চটে যান। তবে তার দলীয় সদস্যরা এদেশে বাংলাদেশের কমুনিসট পারটির সদস্য হয়ে গেছেন। শ্রমিক-কৃষক সমাজবাদী দলের সাধারণ প্রভাব শ্রমিক এলাকায় এক সময় এঁরা বাংলাদেশের চটকল শ্রমিকদের একচ্ছত্র নেতা ছিলেন। এঁদের একজন নেতা বর্তমান আওয়ামী লীগের শ্রমিক সংগঠন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও এম এল এ জনাব আবদুল মান্নান আওয়ামী লীগে যােগ দিলে এঁরা খানিকটা বিপদে পড়েন। এদলের প্রভাব চাঁদপুর, ভৈরব শিল্প এলাকায়। এবং জিলা হিসাবে নােয়াখালি ও কুমিল্লার কোন কোন অঞ্চলে প্রভাব থাকলেও বরিশাল জেলায়ই এদের সব চাইতে শক্তিশালী সংগঠন।
এদের শ্রমিক সংগঠন সংযুক্ত শ্রমিক ফেডারেশন ও ছাত্র সংগঠন সাম্রাজ্যবাদী ছাত্র জোট। এদের মধ্যে এক যুগের আর এস পি-র কিছু সদস্য আছে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ওয়ালী ন্যাপ বা বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পারটি বা আওয়ামী লীগের কোন প্রভেদ নেই। বাংলাদেশে বাংলাদেশ কমুনিসট পারটির উল্লেখযােগ্য কোন শ্রমিক সংগঠন নেই। কৃষক ফ্রনটের ঢাকার একটি এলাকায় এদের প্রতিপত্তি আছে এবং ছাত্র ফ্রনটে এদের সংগঠন বাংলাদেশ (পূর্ব পাকিস্তান) ছাত্র ইউনিয়ন শক্তিশালী। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এদের সংগঠন মজবুত। এই বামপন্থী দলগুলির মধ্যে প্রথম পাঁচটি গত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। একমাত্র ওয়ালী ন্যাপ অংশ গ্রহণ করেছিল। এবং সারা বাংলাদেশে মাত্র সিলেটের একটি প্রাদেশিক পরিষদের আসনে জয়লাভ করেছে। ওয়ালী-ন্যাপ আজও সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। নির্বাচনের পূর্বে এঁরা আওয়ামী লীগের সাথে ঐক্যফ্রনট গঠনের চেষ্টা করেছে। শেখ মুজিবর রহমান রাজী হননি। কারণ নির্বাচনে উভয় দলেরই কর্মসূচী ছিল ১১ দফা এবং ছয় দফা। আর তাদের সাথে ঐক্যফ্রনট গঠন না করেই সব আসনেই জয়লাভ করে যাবে জেনে আওয়ামী লীগ কেন ঐক্যফ্রন্ট করবে তা বােধগম্য নয়। সম্প্রতি নাকি বাংলাদেশ কম্যুনিসট পারটি দাবী করেছেন সে মুক্তিফৌজের তরুণদের শতকরা ৫০ জন তাদের লােক। ঐ কথা সত্য হয়ে থাকলে আমি বর্ষীয়ান শ্রদ্ধেয় নেতাদের এ ধরনের উক্তি হতে বিরত থাকতে আহ্বান জানাব। কারণ শত শত হাজার হাজার তরুণ আজ মুক্তিফৌজে নাম লেখাচ্ছে। তাদের শতকরা ৯০ জনের প্রকৃত অর্থে কোন দলীয় সদস্যপদ নেই। দলাদলি করে আন্দোলনে তারা সর্বনাশের বীজ ঢােকাবেন।
আজ তারা দাবি করেছেন যে, বাংলাদেশের সকল আন্দোলনে তাঁরা পরীক্ষিত । কিন্তু তারা ভুলে গেছেন যে, সে আমলের অধিকাংশ সদস্যই আজ তাদের সঙ্গে নেই। আমরা পছন্দ করি বা না করি এ হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশের বামপন্থীদের অবস্থা। কোন একটি জেলাকে মুক্ত করার মত শক্তি আমাদের নেই। এছাড়া বাংলাদেশের আন্দোলনের প্রশ্নে মাওবাদী চারটি ও বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পারটিতে ভাঙ্গন দেখা দিয়েছে। হিসাব করলে দেখা যায়, নিজেদের ক্যুনিসট বলে দাবি করে এমনদের সংখ্যা বাঙলাদেশে ন-টি। আবার বাংলাদেশ প্রশ্নে তােয়াহা-হক, মতিন-আলাউদ্দীন আজ বিরােধিতা করলেও তাদের সাধারণ সদস্যরা তাদের কথা না মেনে সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ছে। ঐ কথা হয়ত কলকাতার নকশালপন্থীরা জানেন না যে, তােয়াহা হক গ্রুপের বিরাট সংখ্যক সদস্য নেতৃত্বকে উপেক্ষা করেছিল বাংলাদেশের প্রশ্নে। আমার একমাত্র আবেদন বাংলাদেশে বামপন্থীরা নিজেদের অবস্থা ভালােভাবে জানেন। কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গে এসে নিজেদের বড় করে দেখবার চেষ্টা না করা ভাল। তাতে একদিন নিজেদের ক্ষতি হবে। আর পশ্চিমবঙ্গের পত্র পত্রিকার প্রতি আমার আবেদন আপনারা যেন কোন কিছু শুনেই না লিখে বসেন। কারণ আপনারা বামপন্থীদের সম্পর্কে এমন সব কাহিনী লিখেছেন যেন বাংলাদেশের জুজুর ভয় আছে। এতে আমাদের আন্দোলনের ক্ষতি হয় মাত্র।
কাজী হাতেম আলী
১৯ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা