সাম্প্রদায়িকতা
“কোনাে ধর্মই উদার ও অসাম্প্রদায়িক হতে এবং হৃদয় ও বােধের মহত্ব লাভে বাধা দেয় না। হজরত নিজামুদ্দিন আওলিয়া, মইন উদ্দিন চিশতী, শাহজালাল, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং তার প্রিয় শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ প্রভৃতি সাধককুলমনিগণ ধর্মভীরু ধার্মিক ছিলেন নিশ্চয়। কিন্তু এদের সাম্প্রদায়িক ও ভেদবুদ্ধির ঘৃণ্য ব্যাধি স্পর্শ করতে সাহস করেনি। অন্যদিকে হাজী মহসীন, স্যার সৈয়দ আহমদ, মৌলানা আজাদ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও রাজা রামমােহন রায় প্রভৃতি ধার্মিকগণ প্রগতির মশালবাহক ছিলেন। ধর্মই মানুষকে তার আদিম যুগ থেকে পথ দেখিয়ে আজ অ্যাটমিক যুগে পৌছে দিতে সক্ষম হয়েছে। যা ন্যায় ও সত্য তাই ধর্ম এবং যা অন্যায় ও মিথ্যা তাই অধর্ম।” ৭ জুলাই এর আনন্দবাজার পত্রিকার প্রকাশিত জনাব ওবায়েদুল হক লিখিত ‘ধর্ম ও বুদ্ধির মুক্তি’ শীর্ষক চিঠির অংশবিশেষ উপরে উদ্ধৃত হলাে। জনাব হক, আলােচ্য চিঠিখানি লিখেছেন পয়েলা জুনের আনন্দবাজারে প্রকাশিত আমার প্রবন্ধ ‘বুদ্ধির মুক্তি-আন্দোলন’-এর সমালােচনা করে।
কোনাে বিশেষ ধর্মের পক্ষে পত্রলেখক ওকালতি করেছেন, আপাতদৃষ্টিতে তা মনে হয়না। কিন্তু তার ইসলাম প্রীতি আহত হয়েছে, গােটা চিঠিটা পড়লে তা স্পষ্ট হয়। সেই আহত অনুভূতিকে ব্যক্ত করতে গিয়ে, যদিও ধর্মনিরপেক্ষতার একটা স্ট্যানট নিয়েছেন ওবায়েদুল হক, তার প্রবল সাম্প্রদায়িক মনােভাব প্রকট হয়ে উঠেছে। বস্তুত সরাসরি যিনি সাম্প্রদায়িক তাকে বােঝানাে সহজ; কিন্তু একটা ছদ্ম প্রগতিশীলতার মুখােস পরে যারা সাম্প্রদায়িকতার প্রচারে মুখর হন, সাম্প্রদায়িকতা উচ্ছেদ করার পথে তারাই সবচেয়ে বড়াে বাঁধা। কেননা, সুক্ষ্ম সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে তাঁরা যুক্তি দিয়ে গ্রহণযােগ্য করে তুলতে চান। যুক্তিযুক্ত বলে তারা বিবেককে চোখ ঠ্যারেন, যদিও ফকির উপর প্রতিষ্ঠিত থাকে সেই তথাকথিত যুক্তি।
এই জন্যে আমরা প্রায়শ শুনতে পাই, “কোনাে ধর্মই উদার ও অসাম্প্রদায়িক হবে এবং হৃদয় ও বােধের মহত্ব লাভে বাধা দেয়না।” অথবা “আপনি ভালাে মুসলমান হলে এবং আমি উত্তম হিন্দু হলে আমরা অনাবিল শান্তিতে সহাবস্থান করতে পারি।” এ জাতীয় উক্তির মধ্যে যে টুকু সত্য তা হলাে- এর ছদ্ম প্রগতিশীলতা, অন্য কিছু নয়। কেননা, কোনাে বিশেষ ধর্মের সংজ্ঞা দ্বারা বিশেষিত করার সঙ্গে সঙ্গে মানবতা তার সর্বজনীনতা হারায়। খ্রিস্টান, ইসলাম, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্ম জগৎ ও জীবন সম্পর্কে যে ধারণা দেয়, তাকি অভিন্ন। অথবা পরস্পর পরিপূরক? অনেকক্ষেত্রে তা বরং বিপ্রতীপ। যে মানবতার আদর্শ, সুতরাং বিভিন্ন ধর্ম দান করে, তা পূর্ণতার নয়, খণ্ডিত বােধের দ্যোতক। সেই কারণেই বহু শতাব্দী ধরে ধর্ম মানুষকে মানুষ করতে পারেনি, উপরন্তু অগণিত হানাহানি, রক্তারক্তির প্রত্যক্ষ প্রেরণা দান করেছে। | ইতিহাস এই অধর্মের অভ্রান্ত সাক্ষ্য দেয়। কোন দেশে দীর্ঘদিন দুই ধর্মাবলম্বীরা পাশাপাশি সুখে থেকেছে? মুসলমান ও খ্রিস্টানরা? খ্রিস্টান ও ইহুদিরা হিন্দু ও মুসলমানরা? হিন্দু ও বৌদ্ধরা? পৃথিবীর ইতিহাস- বহু শতকের ইতিহাস- ধর্মীয় সংকীর্ণতার অনিবার্য ফলাফল সম্পর্কে একান্ত সােচ্চার। শিক্ষা যদি নিতেই হয়, ইতিহাস থেকে নিতে হবে- তত্ত্ব থেকে নয়। সেই ইতিহাসে, ভিন্ন ধর্ম দূরে থাক, একই ধর্মের
বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর মধ্যে ফাটাফাটির নজির অসংখ্য ছড়িয়ে আছে। সুতরাং ধর্ম ঔদার্য, অসাম্প্রদায়িকতা আর মহত্বের প্রেরণা দান করে, এমন অবাস্তব দাবি অর্থহীন। বরং দেখতে পাই, ধর্ম মানবতাবােধকে সংকুচিত করে, মানুষে মানুষে ভেদের প্রাচীর গড়ে তােলে। | তা হলে, সেকুলার স্টেটগুলির ভবিষ্যৎ কী? ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করে সেখানে কি অনাগত কাল পর্যন্ত কেবলি ধর্মীয় সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে হানাহানি চলতে থাকবে? বলা যেতে পারে, মানসিকতার পরিবর্তন না হলে, ইতিহাসের গতি অন্যথা হওয়ার কারণ নেই। অর্থাৎ বর্তমান কালে ধর্ম সম্পর্কে নতুন প্রজন্মের মধ্যে যে সামগ্রিক ঔদাসীন্য জন্মেছে, তার পরিপূর্ণ বিজয়ই কেবল অতীতের পুনরাবৃত্তি রােধ করতে পারে। অন্যতায় প্রবাদকে সার্থক করে ইতিহাস বারবার তার শিক্ষাকে প্রচার করবে। ধর্মকে মেনে নিয়ে অসাম্প্রদায়িক হওয়ার চেষ্টার মধ্যে এটা বড়াে কন্ট্রাডিকশান হাঁ করে আছে। অতএব আনুষ্ঠানিক ধর্মকে অস্বীকার করে, মানুষকে শুদ্ধ মাত্র মানুষরূপে দেখতে সক্ষম হলেই, সকল ভেদবুদ্ধি ঘুচতে পারে। তার আগে নয়।
সাম্প্রদায়িকতা বর্তমানকালে অবশ্য কেবলমাত্র ধর্মকে কেন্দ্র করে বেঁচে নেই। উপবৃত্তের মতাে তার অন্য আর একটি কেন্দ্র হচ্ছে অর্থনৈতিক শােষণ। ধর্মীয় নেশা এবং অর্থনৈতিক শােষণ আবার উভয় উভয়কে শক্তি ও সহায়তা দান করে। ব্রিটিশ রাজত্বকালে শিক্ষিত বিত্তবান হিন্দুরা অশিক্ষিত বিত্তহীন মুসলমানদের শােষণ করেছেন এবং ধর্মীয় কারণেই হিন্দুরা শিক্ষা ও বিত্তলাভে তুলনামূলকভাবে বেশি সুযােগ লাভ করেছেন; সম্প্রদায় হিসেবেই তারা শােষণের পথকে সুগম করতে পেরেছেন। অপরপক্ষে, এ শতাব্দীর প্রথম পাদে, বাঙালি মুসলমানরা শুধু ধর্মীয় কারণেই শতকরা ৪৫ টি সরকারি চাকুরি পেয়েছেন (শিক্ষাগত যােগ্যতা যাই হােক না কেন!)। এবং এই ধর্মীয় কারণেই, আমাদের সহকর্মী রাজশাহীর অধ্যাপক অরুণ বসাক স্কলারশিপ পেয়েও গভরণরের অনুমতির অভাবে বিদেশে যেতে পাররেন না। অজিতকুমার ঘােষ সবগুলি বিষয়ের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মারকস পেয়েও স্কলারশিপ পেলেন না। এবং এই কারণেই কলকাতা, যাদবপুর, উত্তরবঙ্গ, বর্ধমান, বিশ্বভারতী ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদালয় সমূহে আরবি-ফারসি ও ইসলামের ইতিহাস বিভাগগুলি ছাড়া মুসলমান অধ্যাপক নেই।
ধর্মীয় কারণে যখন এভাবে একটি সম্প্রদায় অন্য একটি সম্প্রদায়ের তুলনায় বেশি অর্থনৈতিক সুযােগ সুবিধা ও সামাজিক প্রতিপত্তি লাভ করে, তখনই সম্প্রদায়ে সম্প্রদায়ে ভেদবুদ্ধি জেগে ওঠে। এক সম্প্রদায় অন্য সম্প্রদায়কে অবিশ্বাসের চোখে দেখতে শুরু করে। আপনার সাম্প্রদায়িক বুদ্ধির মধ্যে সান্ত্বনা খোজে। ব্যক্তি হিসেবে নয়, বরং সম্প্রদায় হিসাবে নিজেকে শক্তিশালী ও প্রবল করে তুলতে চায়। সম্মিলিত ভাবে স্বার্থের লড়াই-এ লিপ্ত হয়। এই অবস্থাতেই মুসলিম লীগের জন্ম হয়। অথবা বঙ্গদেশ দ্বিখণ্ডিত হয়। এবং পরিশেষে ভারতবর্ষ পর্যন্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়। এই কারণেই বিদেশী মুসলিম বাদশা ও সুলতানদের বিরুদ্ধে দেশীয় হিন্দুরা ঐক্যবদ্ধ হন। অতীতকালে বৌদ্ধরা হিন্দুদের বিরুদ্ধে কিংবা হিন্দুরা বৌদ্ধদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত হয়েছেন এই ধর্মভিত্তিক শােষণ ও শাসনের কারণেই। কিন্তু ভারতবর্ষীয় খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে হিন্দু অথবা মুসলমানদের কোনাে বড় অভিযােগ নেই। কেননা সম্প্রদায় হিসাবে দেশীয় খ্রিস্টানরা উল্লেখযােগ্য কোন অর্থনৈতিক শােষণের সুযােগ পাননি। অথবা বৌদ্ধদের অস্তিত্ব সম্পর্কে ও পূর্বোক্ত দুই সম্প্রদায় আপাত অসচেতন। সে-ও একই কারণে। প্রকৃতপক্ষে, উদার মানবতার্কে সঙ্কীর্ণ করে ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধি তথা ধর্মীয় শিক্ষা। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক শােষণ যদি মিলিত হয়, তা হলে মােলকলা পূর্ণ হয়।
এমনকি, ধর্মীয় একতা সত্ত্বেও শুধুমাত্র অর্থনৈতিক শােষণ সাম্প্রদায়িক বােধকে প্রবলভাবে জাগিয়ে তুলতে পারে। মানুষে মানুষে এবং গােষ্ঠীতে গােষ্ঠীতে শশাষণকে যদি এই দুই ভাগে বিভক্ত করা হয়, তাহলে গােষ্ঠীগত শােষণকে সাম্প্রদায়িকতার অন্যতম জনক বলে বিবেচনা করা যায়। এবং তেমন অবস্থায়, কেবল অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের ভিত্তিতেই সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটানাে সম্ভব। সমাজতত্ত্ববিদ নন, অর্থনীতিবিদ নন, রাজনৈতিক-দার্শনিক নন, নিতান্তই কবি রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত এই সত্যকে অর্ধশতাব্দীকাল আগে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বলেছিলেন, হিন্দু-মুসলমান বিবাদ মিটতে পারে একমাত্র অর্থনৈতিক সাম্যের ভিত্তিতে। তিনি বুঝেছিলেন, সামাজিক সাম্যের মুখে ধর্মীয় সংকীর্ণতা বিলুপ্ত হতে বাধ্য।
এই পথে অগ্রসর হলেই যথার্থই অর্থে সেকুলার স্টেট গড়ে উঠবে। এই পথ ধরেই যেটুকু হােকবাংলাদেশ সেকুলার চেহারা লাভ করেছে। উজান ঠেলে উল্টোপথে এগুতে চাইলে কিস্তি সামনে যাবে না, পণ্ডশ্রমের ঘাম ঝরবে রাশি রাশি। ধর্মের মহৎ শিক্ষার নামে কোনাে দেশে কোনাে কালে অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ গড়ে ওঠেনি। আর ধার্মিক মানে কী? নিজাম উদ্দীন আওলিয়া, মইনুদ্দীন চিশতী, শাহজালাল, রামকৃষ্ণ ও বিবেকানন্দ কি কোটিতে কোটিতে সারা দেশে ছড়িয়ে আছে। আমাদের কাজ তাে সেই লক্ষ, কোটি মানুষ নিয়ে, আঙ্গুলে গােনা কয়েক জনকে নিয়ে নয়। আর হাজী মহসীন অথবা স্যার সৈয়দ আহমেদ কী অর্থে প্রগতিশীল আমার জানা নেই। যদুর জানি, উভয়ের আপন সম্প্রদায়ের লােকদের উপকার করার চেষ্টা করেছেন। রামমােহন আর বিদ্যাসাগর যুগের তুলনায় নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল ছিলেন; কিন্তু আনুষ্ঠানিক ধর্মের প্রতি তাদের যে সামান্যতম বিশ্বাস বা সহানুভূতি ছিলাে না। এবং বিদ্যাসাগর মানুষকে একান্তভাবে মনুষ্যরুপে দেখতে পেরেছেন, তার সে মুক্ত দৃষ্টি হয়তাে লাভ করেছেন, তাঁর নাস্তিকের মধ্য দিয়েই এবং দৈবাৎ বিদ্যাসাগর এবং রবীন্দ্রনাথের মতাে আনুষ্ঠানিকভাবে ঠুলিমুক্ত মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করেন বলেই এখনাে। মানবধর্ম টিকে আছে- ধর্মের বুজরুকির মুখেও মানবতা বেঁচে আছে। এবং ধীরে ধীরে ধর্মের কুয়াশা কেটে যাচ্ছে। মানুষ অসাম্প্রদায়িক হচ্ছে, শিক্ষিত হচ্ছে- ওবায়দুল হকের ভাষায় অ্যাটমিক যুগে পৌছে যাচ্ছে। অন্য দিকে ধর্ম যদি তার প্রতাপ বজায় রাখতে পারতাে, তাহলে আজও বলতে হতাে পৃথিবী চ্যাপ্টা কিংবা সূর্য ঘােরে পৃথিবীর চারিদিকে। হাসান মুরশিদ কলকাতা-১৭
২৭ জুলাই, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা