You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে জীবনের ধারা

— অরুণ চক্রবর্তী

বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধারই একদিন তাদের দেশকে স্বাধীন করতে পারবে; এই প্রত্যয়ের প্রকাশ বর্তমান বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের কাছে ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের উত্তরের ৪০০ বর্গ মাইলের মুক্তাঞ্চলের বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে কেউ এই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারছেন।  গত সপ্তাহে বাংলাদেশের একজন ডাক্তার এবং তেঁতুলিয়া, বােদা ও রাগড় এই তিনটি থানার মুক্তাঞ্চলের সহকারী সাব-জোনাল এ্যাডমিনিসট্রেটারের সঙ্গে বাংলাদেশের ৪০০ বর্গমাইলের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুক্তাঞ্চল ঘুরে এসে আমার ও সেই অভিজ্ঞতা হল। একটি জীপে আমরা প্রথমে সীমান্ত থেকে ১০ মাইল দূরে হেড কোয়ারটার তেঁতুলিয়ায় গিয়ে পৌছুলাম। ছােট শহর। একটা বাজার, হাইস্কুল, প্রাইমারী স্কুল আর সুরক্ষিত থানাকে ঘিরে প্রায় ৪/৫ হাজার লােকের ব্লক ডেভলেপমেন্ট ট্রেনিং সেন্টারটি এখন হাসপাতাল। সর্বক্ষণের একজন ডাক্তার, তিনজন নারস এবং তিনজন ভিজিটিং ডাক্তার এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থা পরিচালনা করেন। মুক্তাঞ্চলের সাধারণ মানুষের চিকিৎসা। এবং আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসা হয় এখানে। হাসপাতালের সামনের বাঁধানাে পুকুরটির পাশে একটি রেডক্রশের এবং একটি বাংলাদেশের পতাকা উড়ছিল। হাসপাতালের ডাক্তার ২৫ বেডের হাসপাতালটি দেখিয়ে বললেন, বর্তমানে দশ জনের চিকিৎসা। চলছে। তিনজন মুক্তিযােদ্ধা, বাকী সাতজন সাধারণ মানুষ।” অবিশ্বাস্য হলেও একজন আহত মুক্তিযােদ্ধা আমায় বললেন, “জানি না কেন, তবে হয়ত আল্লা আমাদের সহায়। দুশ’ গজ দূরে দাঁড়িয়ে মুখােমুখী সংঘৰ্ষতেও আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা মরে না। শত্রুরাই জখম হচ্ছে বেশী।”

 আমি লক্ষ্য করেছি, সারাদিনে তেঁতুলিয়ায় একটি দশ বছরের মেয়েকে কাঁধের কাছে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভরতি করা হয়েছে। যুদ্ধের সময় মেয়েটির আচমকা গুলি লেগেছিল। অথচ ভজনপুরে যাবার সময় এবং তেঁতুলিয়ায় রাত কাটাবার সময় আমি ১২ মাইল দূরের জগদ্দলের যুদ্ধক্ষেত্রের গােলার আওয়াজ প্রায় সবক্ষণই শুনেছি। যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। অমনি অসামরিক সরকারী ব্যবস্থা এখানে সম্পূর্ণভাবে চালু আছে। বাংলাদেশের পাট বর্তমানে ভারতে চালান যাচ্ছে। সীমান্তে মণ প্রতি দুটাকা শুল্ক নিচ্ছে বাংলাদেশ সরকার। এই অঞ্চলের সিভিল ডিফেনসের। সম্পাদক ডাঃ ফরিদ বললেন, “কিছুদিন পরে তেঁতুলিয়ার ব্যবসায়ীর ধান-চালের ব্যবসা করবেন ভারতের সঙ্গে। তার মতে, এই বিরাট মুক্তাঞ্চলে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ আগের মতই চলছে। বাজারে ঘুরে আমি এই সত্যকেই উপলব্ধি করলাম । চায়ের দোকানে চা প্রতি কাপ ১২ পয়সা, সন্দেশ ১৫ পয়সা। সিগারেটের দোকানে দামটা চড়া। বাংলাদেশের ‘স্টার সিগারেটের বর্তমান দাম ১২ আনা। আগে ছিল ৩০ পয়সা। চালের দর বর্তমানে প্রতি সের ১.২৫ পয়সা। কেরােসিন তেল, লবণ এবং   মশলাপাতি সবই পাওয়া যাচ্ছে দেখলাম। কাপড়ের দোকানে বিভিন্ন কাপড়, লুঙ্গি এবং গেঞ্জি সাজানাে। ঠাকুরগাঁ কলজের রসায়নের একজন অধ্যাপক বললেন, কাপড়ের দরটা একটু বেশী, তবে ধরাছোঁয়ার বাইরে নয়। বাংলাদেশ সরকার অতি প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের দর বেঁধে দেবার কথা ভাবছেন বলে তিনি জানালেন।

দর্জির দল বাজারের এক কোণে তাদের সেলাইয়ের কলে সশব্দে জামা-প্যান্ট সেলাই করছে। বাজারের প্রান্তে গরু-ছাগল আর মুরগী কেনা-বেচা চলছে। বাজারের এক প্রান্তে রাস্তা বেয়ে একদল সাঁওতাল নরনারীকে চলতে দেখলাম। জিজ্ঞেস করে জানলাম, ওরা দুরে আলু-খুড়তে গিয়েছিল। এখন বাড়ি ফিরছে। একজনের কাধের লাঠিতে একটা লণ্ঠন কুলছিল। | তেঁতুলিয়ার দক্ষিণ দিকে তেঁতুলিয়ার সাপ্তাহিক “সংগ্রামী বাংলা”র অফিস। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যয়ের নানা পােস্টার অফিস ঘরের ভেতরে এবং বাইরে। সামনেই টেলিফোন একসচেনজ। একজন। অপারেটর সেটা কনট্রোল করছেন। সেখান থেকেই ১৪ মাইল দূরের জগদ্দলের যুদ্ধের গতি প্রকৃতির খবর পাচ্ছে তেঁতুলিয়ার মানুষ। মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন জনের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা করে তাদের মধ্যে আত্মপ্রত্যয় লক্ষ্য করলাম । আমাকে একজন বললেন, “রাজনৈতিক সমাধানের কথা আমরা মানব না। আমরা রক্ত দিয়েছি। আমরা। স্বাধীনতা চাই।” 

সন্ধ্যের খাবার তারা খেলেন। সুন্দর শৃঙ্খলা । দেখে মনে হল, খাদ্যটা তাদের প্রাসঙ্গিক, প্রাথমিক কাজ যুদ্ধ। কেউ কেউ পা মেলে ঘাসে শুয়ে পড়লেন। একজনকে প্রশ্ন করতে উত্তর দিলেন, “আমার মা বেঁচে আছেন। কালিয়াগঞ্জের চান্দোল ক্যামপে আছেন তিনি। ছােট ভাই আর বােনও আছে। আমার কেউই মারা যায়নি। কিন্তু মারা গেছে আমার দেশের অসংখ্য মানুষ। প্রতিহিংসা নয়, আমি যুদ্ধ করছি অন্যায়ের বিরুদ্ধে। ইমানের জন্য লড়াই করছি। আল্লা আমার সহায়।” আর কিছু বলবেন না। মুক্তিফৌজেরা বর্তমানে চাষী, কুলি, রিকসাওয়ালা ইত্যাদির বেশে পঁচাগড় এবং ঠাকুরগাঁয়ে তাঁদের আক্রমণ অব্যহত রেখেছে। এই মুক্ত এলাকার সাব-জোনার এ্যাডমিনিসট্রেটর মিঃ এস এম এ রেজা বললেন, “আমরা বর্তমানে ৮ মাইল দুরের পঁচাগরে পতন ঘটাতে বদ্ধপরিকর। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে তাতে আমরা সফলও হব।”

দু’ সপ্তাহ আগে ফল-মূল বিক্রী করতে গিয়ে মুক্তিফৌজ ঠাকুরগাঁ ক্যানটনমেনটে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে বেশ কয়েকজন শত্রুকে নিহত করেছে। ঠাকুরগাঁর গেরিলার দল এখন ঠাকুরগার পাবলিক পারকের বাঘটিকে নিহত করার চেষ্টায় আছে। মারচএপ্রিল মাসে পাকিস্তানী সৈন্যরা এই বাঘের খাঁচায় অনেক জ্যান্ত মানুষকে প্রবেশ করিয়ে হত্যা করেছে। এখনও কিছু কিছু লােককে বাঘটির খাচায় নাকি পুরে দেয়া হয়। জানলাম, ঠাকুরগার এগ্রিকাচারাল অফিসার। ডালি সাহেবকে পাকফৌজের লােকেরা এইভাবে হত্য করেছে। | রাতে তেঁতুলিয়ায় ফিরে এসে আমরা মুক্তিফৌজের মেসে ডাল, ভাত আর মাছ খেলাম। ঠকুরগীর। আদালতের মুহুরী জব্বার সাহেব এই মেসের কর্মকর্তা। মুক্তিযােদ্ধা এবং অনাহারী সাধারণ মানুষের জন্য এই মেস। শােবার বন্দোবস্ত নেই। তেঁতুলিয়ার লােকেরা অতিথিদের নিজেদের আশ্রয়ে রাখেন। | মুক্তিফৌজের ছেলেরা বাজারের কাছে এক দোতলা ঘরে থাকে। আমি তাদের সঙ্গেই এক রাত কাটালাম। ঢালাও বিছানা। যুবকরা সেখানে শুয়ে যুদ্ধের গল্প করে। ঘুমিয়ে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে সদ্য। ফিরে আসা যােদ্ধা তার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে। তাতে থাকে সফলতা আর ভুল-ত্রুটির কথা। ক্লাস নয়। নিবু নিবু লণ্ঠনের আলােয় রাতের খােশগল্পে মধ্য দিয়েই তাদের শিক্ষা চলে।

সিভিল ডিফেনসের সম্পাদক ডাঃ ফরিদও ওদের সঙ্গে শুয়ে থাকেন। বলেন, নানা উদ্দীপক কথা। স্বাধীন বাংলার ছবি এঁকে দেন মুক্তিযােদ্ধাদের মনে। আলােচিত হয় বিশ্ববিবেকের কথা। সমালােচনা চলে। খােলাখুলি। একটি ছেলে পরিবেশকে হাল্কা করবার জন্য বারে বারে অনুরােধ করছিল, গান হােক। সিনেমার গল্প হােক। কিন্তু দেখা গেল, গান থেমে যায় যুদ্ধের গল্পে। সিনেমার গলপ থেমে চলে আসে যুদ্ধের প্রসঙ্গ।  ওরা সবাই আমায় পশ্চিমবঙ্গের গল্প করতে বলল। ভারতের কথা। কিন্তু যুদ্ধ ছাড়া কোন গল্পই চলল । দেখলাম, যুদ্ধ ওদের রক্তে মিশে গেছে। লক্ষ্য করলাম, বাঙ্গালী যােদ্ধার জাত হতে চলেছে। পরদিন সকালে শিলিগুড়িতে ফিরবার আগে দেখলাম তেঁতুলিয়া থানার কাছে প্যারেড হচ্ছে। গতকাল রাতের অনেকেই ছিল। অন্ধকারে তাদের মুখ দেখতে পাইনি। তাই চিনলাম না। কিন্তু দেখলাম, ১৫ বছর থেকে ২৭/২৮ বছর বয়সের কিশাের আর যুবক। কারাে মুখ খুবই সরল, বােকা বােকা। ভাবলাম, একটা পাখিকে মারতে বললেও হয়ত এরা আঁৎকে উঠবে।

মুক্তিযােদ্ধা সারজেনট বললেন, “আমরাও আগে এমনটাই ভাবতাম। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে এদের বিক্রম দেখলে আপনাকে বিস্মিত হতে হবে। আমরা এদের প্রত্যেককে বাছাই করে নিয়েছি।” এই কেন্দ্রের আওয়ামী লীগ প্রার্থী তেঁতুলিয়া থেকে এক শ’র কিছু বেশী ভােট পেয়েছিলেন। বর্তমানে মুক্তিফৌজের হেড কোয়ারটার ভজনপুর থেকে তিনি পেয়েছিলেন মাত্র এগারটি ভােট। একমাত্র বােদা অঞ্চলের ব্যাপক ভােট তাকে জিতিয়ে দিয়েছিল। মিঃ রেজা বললেন “অথচ, এখন এদেরকে নিয়ে আমাদের অসামরিক শাসনব্যবস্থা কায়েম রাখতে কোনই অসুবিধা হচ্ছে না।” তেঁতুলিয়ার কিছু মানুষ রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে। তাদের মত, স্বাধীনতা সংগ্রামের ব্যাপক প্রস্তুতির  জন্য বর্তমানে একটা সমাধান প্রয়ােজন। তবে তারা আত্মবিক্রয়ের বিনিময়ে সেই সমাধান মানতে রাজী নন। বাজারের কয়েকজন মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি এই মতামত ব্যক্ত করলেন। তবে তেঁতুলিয়ার সাধারণ দোকানদার, ব্যবসায়ী, দর্জি কিংবা ভজনপুর এবং চাঁদমারীর কৃষকের মুখে অন্য কথা। মুক্তিফৌজ তাদের মনে বিরাট আশা এনে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য, এখন মুক্তিফৌজ বাংলাদেশের ২৪ মাইল ভেতরে যুদ্ধ করছে। সেখান থেকে ৬০ মাইল এগিয়ে দিনাজপুর শহর দখল করতে বেশী দিন লাগতেই পারে না। জয় আমাদের হবেই।

২০ অক্টোবর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা