সেই কালরাত্রি
–আবুল মনছুর
[পূর্বদেশের রিপোেরটার] বাংলাদেশে তখন চলছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে পূর্ণ অহিংস অসহযােগ আন্দেলন। কাজকর্ম, অফিস, আদালত বন্ধ। তবে খবরের কাগজের লােকেদের কাজের কমতি নেই এতটুকু। প্রতিদিন শেখ সাহেবের বাসায় সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ডিউটি। জনাব ইয়াহিয়া খান ঢাকায়, জনাব ভুট্টোও এসেছেন কয়েকদিন পরে। আলাপ আলােচনা হচ্ছে দফায় দফায়। আমরা দৌড়াচ্ছি একবার শেখ সাহেবের বাসায়। আবার প্রেসিডেন্ট ভবনের সামনে, কখনও বা হােটেল ইনটার-কনটিনেন্টালে, যেখান রয়েছেন জনাব ভুট্টো। বলা বাহুল্য খাকি পােশক ও মেসিনগানের বেষ্টনীর মধ্যে। বসন্তের শেষে চৈত্রের এক মধুমাখা বিকালে আমার ডিউটি ছিল শেখ সাহেবের বাসায়। শােনা গেছিলাে, এইদিন সন্ধ্যে সাতটার দিকে- শেখ সাহেব তার বাসভবনে কিছু বলতে পারেন। যখন তাঁর ধানমুনডির বাসভবনে পৌছেছি, দেখি লােক গিজগিজ করছে। স্থানীয় ও বিদেশী সব বাঘা বাঘা সাংবাদিকের দল এদিক ওদিকে সব পায়চারী করছেন, বিদেশী টেলিভিশন টিমও রয়েছে একাধিক। অপেক্ষা করতে করতে সময় উৎরে গেল। ঘড়িতে তখন বাজে প্রায় আটটা। আমাদের কাগজের একজন সিনিয়র রিপােরটার আমাকে এসে বললেন, তুমি এখন অফিস চলে যাও, মনে হচ্ছে একটু দেরি হবে। আমি থাকলাম। অফিসে গিয়ে ছােটখাট দরকারী নিউজগুলাে করে ফেলাে, আমি একটু পরে আসছি।
রাত সাড়ে নটা। অফিসে বসে বসে সবাই কাজ করছি। দিনের বেলায় গুজব ছিলাে যে, ভুট্টো সাহেব। আজ ঢাকা ত্যাগ করতে পারেন। আমাদের যে রিপােরটার শেখ সাহেবের বাসায় ছিলেন, তিনি ওখান থেকে এসে জানিয়েছেন যে, শেখ সাহেব কিছু বলেন নি, তবে হয়তাে, আগামীকাল কিছু বলবেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে নানা জল্পনা-কল্পনা চলছে, কী হবে। ঠিক এমনি সময়ে টেলিফোন বেজে উঠলাে। ধরলেন এক সহকর্মী। টেলিফোনে তিনি কথা বলছিলেন কার সঙ্গে, সেটি বােঝা না গেলেও, ভুট্টোর ঢাকা ছাড়ার গুজবটা যে ঠিক, তা এবার সঠিক প্রমাণিত হলাে। টেলিফোন এসেছিল হােটেল ইনটার কনটিনেনটাল থেকে। রাত দশটার প্লেনে ভুট্টো সাহেব করাচি চলে যাচ্ছে, আপনারা ইনটারসটেড হলে হােটেলে আসতে পারেন। কথাটা জানালেন হােটেলের জনৈক কর্মচারী। হােটেলে পৌঁছে দেখি, কড়াকড়ি আরও জোরদার করা হয়েছে। চারিদিকে থমথমে ভাব। একটু পরে ভুট্টো সাহেব চলে গেলেন। কিছু বললেন না। হােটেলের লবি ছেড়ে রাস্তায় এসে দেখি, তুমুল কাণ্ড শুরু হয়ে গেছে। রাস্তায় রাস্তায় লােকজন বেরিয়ে পড়েছে। ব্যারিকেড তৈরি হচ্ছে শহরময়। ইটপাথর, ভাঙা
মােটরগাড়ি, রাস্তার পাশের গাছ কেটে তৈরি হচ্ছে ব্যারিকেড। রিকসার জন্য এগিয়ে এলাম কিছুদূর । যারা ব্যারিকেড দিচ্ছিলেন তাদের মধ্যে একজন আমাকে বললেন, তাড়াতাড়ি বাসায় চলে যান। অফিসে এসে দেখি আমাদের অফিসের সামনেই কয়েক হাজার লােক ব্যারিকেড তৈরি করছে একটি। রাত এগারটার দিকে তৈরি হয়ে গেল ব্যারিকেড । সারা শহরময় একটা গুঞ্জন। শ্লোগান আর বিভিন্ন রকম আওয়াজে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঢাকা শহর । হাতের কাজ শেষ হয়েছে ঘণ্টাখানেক আগে। ভাবছিলাম বাসায় চলে যাবাে কিনা। বারান্দায় দাড়িয়ে দাড়িয়ে সবাই আমরা দেখছিলাম। রাত সাড়ে এগারটা। লােকজন জয় বাংলা ধ্বনি দিচ্ছে। ভাবছি কি হবে। এমন সময় প্রচণ্ড গর্জন করে উপস্থিত হলাে যমদুতের মত চারটে মিলিটারি ট্রাক।
দরজা বন্ধ করে সবাই চলে এলাম ভেতরে। ট্রাক চারটে দাঁড়ালাে অফিসের সামনে। এর বেশি সােজা এগুবার উপায় নেই। সামনে ইট আর বিরাট বিরাট গাছ দিয়ে ব্যারিকেড। রাত বারােটার দিকে আমাদের টেলিফোন হয়ে গলে অচল বুঝলাম ব্যাপার খুব ভালাে নয়; একটু পরে শুরু হলাে গুলির আওয়াজ। প্রথমে রাইফেল তারপরে মেসিনগানের গুলি। আর মাঝেমাঝে প্রচণ্ড বিস্ফোরণের আওয়াজ। মনে হচ্ছিলাে সারা দালানটা ভেঙে পড়বে। কেঁপে উঠছে ঘরের দরজা জানালা।। রাত বেড়ে চলেছে। আওয়াজ আসছে শহরের চারিদিক থেকে। কান্না, চিৎকার, গােলাগুলি আর আগুন। মন হচ্ছিলাে শহরের চারিদিকে আগুন। আমাদের অফিস থেকে মাইল দেড়েক দূরে রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক। গােলাগুলির আওয়াজ ওদিক থেকেই আসছিলাে বেশি। সারারাত চললাে এভাবে। কাটলাে একটি দুঃস্বপ্নের রাত। ভাের হলাে, গোলাগুলি কিন্তু তখনও থামেনি। টেলিফোন চলছে না। যােগাযােগ করার কোনাে উপায় নেই। কারাে সঙ্গে। কাগজ বেরােয়নি। খাওয়া দাওয়া নেই রাত থেকে। সকাল গড়িয়ে দুপুর হলাে। বেরুবার কোনাে উপায় নেই। মাঝে মাঝে পরদা ফাক করে জানালা দিয়ে উকি মেরে দেখছি। খাঁ-খাঁ করছে পথঘাট। এখনও আগুন জ্বলছে শহরের এখানে ওখানে।
বেলা সাড়ে তিনটার দিকে বিকট আওয়াজ পেয়ে জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি তিনটে ট্যাঙ্ক আর তার সঙ্গে কয়েকটি ট্রাক বােঝাই মিলিটারি। ওরা. এসে দাঁড়িয়েছে অফিসের সামনে। ভাবলাম ট্যাঙ্ক দিয়ে গােলাবর্ষণ করবে। দেখলাম তা নয়, ট্রাক থেকে নেমে খান সৈন্য এগিয়ে গেল বস্তির দিকে। চললাে বেশ কিছুক্ষণ গােলাগুলি। প্রচণ্ডভাবে গােলাবর্ষণ শুরু হলাে ট্যাঙ্ক থেকেও। আধঘণ্টা খানেক পর তারা চলে গেলাে। | রেডিওতে বলা হলাে, আজ সারাদিন-কারফিউ। এদিনও-শুক্রবার খাওয়া দাওয়া হলাে না। যেন নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে আছি। মাঝে মাঝে মনে হয় ঘুমিয়ে আছি, যা ঘটছে, সবই স্বপ্ন। শুক্রবার রাত কাটলাে গােলাগুলি আর অগ্নৎসবের মধ্য দিয়ে। বাইরে কোথায় কি ঘটছে বােঝার কোন উপায় নেই। শনিবার সকাল আটটা থেকে বারােটা পর্যন্ত কারফু শিথিল করা হয়েছে। বেরিয়ে পড়লাম অফিস থেকে। বাসায় আসার পথে দেখলাম বস্তির পর বস্তি তখনও দাউ দাউ করে জ্বলছে। মৃতদেহ পড়ে আছে রাস্তায়। রাজারবাগ ঘুরে বাসায় গেলাম। দেখলাম, সেনাবাহিনী পুলিশ ফাড়ি দখল করে আছে। আগুন তখনাে নেভেনি, ধোঁয়া উঠছে।
১৬ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা