You dont have javascript enabled! Please enable it!

ফিরলে বাংলাদেশে ফিরব

— শান্তিকুমার মিত্র

“ফিরলেও বাংলায়, না ফিরলেও বাংলায় বললেন শম্ভুনাথ মণ্ডল। যশােহরের ৯৬-গ্রামের মানুষ। সদলে মঙ্গলবার বনগাঁ মহকুমায় পৌঁছেছেন। তখনও পথেই অবস্থান। স্বগ্রামে রেভেনিউ ডিপারমেনটে পিয়নের কাজ করতেন। ধানী জমিও ছিল বেশ কিছুটা। শক্ত সমর্থ চেহারা। সরাসরি প্রশ্ন রেখেছিলাম, আবার ওপারে  ফিরবেন? সেই প্রশ্নে এই উত্তর। প্রশ্নোত্তর যদি কোনও নিরিখ হয়, বলতেই হবে ফেরা নিয়ে তিন রকমের মতামত আছে। এক হল ঃ স্বাধীন মুক্ত বাংলাদেশে ফেরার প্রত্যাশা, সােৎসাহ আগ্রহ, দুই, আবার ভাঙা ঘরবাড়ি গড়ে সেখানে গিয়ে থাকায় দ্বিধা-‘বার বার ভাগ্যের মার খাইছি; তিন, সবাই’ গেলে যাওয়ার ইচ্ছা, গুলি না চললে, ক্ষতি না করা হলে ফেরার বাসনা। অবশ্যই এসব মতামত খেটে খাওয়া চাষবাস সম্বল মানুষের, ছােটখাট দোকানীর, জনমজুরের নিশ্চয় কিছু সম্পন্ন চাষীরও যারা আগেই এসেছেন, বিভিন্ন শিবিরে রয়েছেন। সদ্য আসা মানুষের এখনও চোখে মুখে আতঙ্ক। তাঁরা অতশত ভাবতে পারছেন না। অভয় নগর থানার রাজপুর গ্রামের বৃদ্ধ কানাইলাল রায় চাদপাড়ার রাস্তার পাশে গরুর গাড়ির নিচে দু হাঁটুতে থুতনি ঠেকিয়ে বিশ্রাম করছেন, ‘সবে ত আলাম-।’ একটু থেমে ম্লান হেসে বললেন, আমি ত চললাম, তা ওরা যদি পেরে। কথা শেষ করেন নি, ১৪ জনের পরিবার পরিজনদের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েছেন অনেক পােড়খাওয়া ৮৫-বছরের মানুষটি। | পূর্ববঙ্গে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বলতে ওঁরা বেশির ভাগ বােঝেন ‘জয় বাংলা’। পেট্রাপােলে শরনার্থী শিবিরে সারসা থানার সামলাগাছির বাহার আলি মণ্ডল ঘাড় নেড়েছেন, জয় বাংলা হলে যাবাে। বেনাপােলের | ভবারবেড়ের ফরিদ গাইন ব্যাখ্যা করে দিয়েছন, শেখ মুজিবুর সাহেব গদি পেলে যাবাে। চট্টগ্রামের মীরেশ্বরী। 

থানার মিঠানালার তরুণ তপন দে দৃঢ়কণ্ঠ, জয় বাংলা হলে নিশ্চই ফিরে যাবাে। না হলে যাবাে না কিছুতেই। ওঁর নিজের রেডিও মেরামতির দোকান ছিল, মাসে শ তিনেক টাকা রােজগার হতাে। একান্নবর্তী পরিবার। বড় ভাই কাপড়ের দোকান করতেন। মেসিনগানের গুলিতে মারা গিয়েছেন। ছােট ভাই মরেছে টোটায়। সব হারিয়ে চারজনের পরিবার এখন এই শিবিরে। জলভরা চোখেই বলছেন ‘লড়াই করার ইচ্ছা আছে।’ | ওই শিবিরে বেশীর ভাগ শরণার্থী যশােহর জেলার। খুলনা, চট্টগ্রামেরও কটি পরিবার এসেছেন ঘুরপথে। হিন্দু, মুসলমান মিলিয়ে এক চালায়, সমব্যথী সবাই। নাভারণের মহম্মদ মহিউদ্দিন কুটিয়ালি অর্থাৎ ধান কিনে চাল করে বেচতেন। ‘তা মাসে দুশ আড়াইশ টাকা হতাে।’ বিঘে ৪ জমিতে চাষও করতেন। গােলপাতার ছাউনি ঘরও ছিল। সাড়ে তিনজনের পরিবার মিটমাট হয়ে গেলে ফিরে যাবাে।’ তবে ইয়াহিয়া থাকতে কিছুতেই যাবেন না। ওই নাভারণের কাছেই সামলাগাছি গ্রাম। সেখানকার জামসেদ আলি ৬০ বছরের বৃদ্ধা ফুফুকে হারিয়ে এসেছেন। আসতে পেরেছেন মাকে নিয়ে ৭ জুন। ১২ বিঘে জমি। দেওয়ালি ঘর। চাষে খােরাকি হােয়ে গিয়েও বেচার থাকত। জয় বাংলা হলে ফিরতে চান। যশােহরের মেঘনা গ্রামের আবুল হােসেন ২৫ বছরের ছেলেকে পাননি। এসেছেন ৭ জন। জনমজুরির কাজ ছিল । দিনে ২ থেকে ২.৫০ টাকা, তাছাড়া খাওয়া।

তা সেখানে ভালাে হবে, সেখানে থাকবাে; সকলে গেলে যাবাে।’ কুন্দীপুরের মেহের উন্নিসার সঙ্গে কথা হচ্ছিল। লাজুক বধূ। কাছেই স্বামী দাড়িয়ে। স্বামীর ভাই, মা, ভাইপাের কোনও খোজ নেই। কিছু জমি ছিল, বাকিটা পোেষাতে হতাে জনমজুরি করে। মৃদুস্বরে বলেছেন, মিটে গেলে যাবাে । ভবারবেড়ের জমিলা বিবির কথাবার্তা অপেক্ষাকৃত নিঃসঙ্কোচ, তবে উত্তর ভিন্ন ‘আল্লা যদি যাইতে দেন।’ ওঁরা পাঁচজন। কাঁচা মাল কেনা বেচার দোকান দিতেন। ওঁর এক মেয়ে গেছে ফরিদপুরের মাদারিপুরে- ওঁর মায়ের কাছে বেড়াতে; পালটা, বােন এসেছিল দিদির বাড়িতে, এখন সঙ্গে শিবিরে। রাজারহাটের চিত্তরঞ্জন হালদার ব্যাখ্যা করেননি, সংক্ষিপ্ত উত্তর দিয়েছেন, পরিস্থিতি ভাল হলে যাবাে। পুরাতন কসবার শান্তিরাম রায়ের স্পষ্ট জবাব, মােটেই যাব না। যশােহর পৌরসভায় ঝাড়দারদের সর্দারির কাজ করতেন। বেতন মাসিক ১৪০ টাকা। মাটির দেওয়াল, গােলের চাউনির ঘর ছিল। ৫ জনের পরিবার। অত্যন্ত তিক্ততা বােধ করছেন বাড়ি ছাড়তে হওয়ায়।  চট্টগ্রামের আর একটি পরিবার শিবিরে। আলাপ হচ্ছিল। ওঁরা আগরতলার দিক দিয়ে ভারতে ঢােকেন। ডবলমুরিং থানার কবিলারামে থাকতেন। প্রভাসচন্দ্র মিত্র, নিজের বাস ছিল একটা, চালাতেনও। ৮০ হাজার  টাকা দিয়ে কিনেছিলেন। কদিন ওই বাসে করে মুক্তিফৌজের জিনিসপত্র আনা নেওয়া, পৌছে দেওয়ার কাজ করতেন। পুরাে বাসই ছাই। ৮ জন নিয়ে শিবিরে। কণ্ঠে খেদ, ফিরে গিয়ে কী হবে? ওই পরিবারর আত্মীয়, সঙ্গী সাধনচন্দ্র দাশ চট্টগ্রামে ওঁদের সঙ্গে থেকে এক কারখানায় স্টোরকিপারের চাকরি করতেন, পৌণে তিন শ টাকার মত বেতন। বা শ্রীহট্টে। তিনি কিন্তু দ্বিধাহীন, ‘জয় বাংলা হলে নিশ্চয়ই যাবাে’। খুলনা জেলার তালা থানার বাইগনি গ্রামের অটলবিহারী সর্দার (৪৫) ভাল চাষী। ২০ বিঘে জমি। পানও বেচতেন। গরু লাঙ্গল ছিল। প্রায় মাস খানেক হল চলে এসেছেন ফেরার ইচ্ছা নাই, জমি যদি পায় করাইয়া নিয়া আসতে পারতাম।’ যশােহর জেলার কোতােয়ালি খানার শংকরপুরের বুদ্ধিমন্ত বিশ্বাসেরও তাই মত, গিয়ে কী করবাে? সারা জীবন খেটেখুটে যা করেছিলাম সব গেল।

যশােহর জেলার মণিরামপুর থানার কোড়ামারা গ্রামের সীতাকান্ত সরকারের ৮ জনের পরিবার। একটা গরুর গাড়ী সঙ্গে নিয়ে নদী পেরিয়ে সদ্য এসেছেন চাঁদপাড়ায়। চাষবাস ছিল, অ্যালােপেথিক চিকিৎসাও করতেন। বুধবার রাত দুটোয় বেরিয়েছিলেন। সােমবার সন্ধ্যেতে এখানে পৌঁছেছেন। এখন ফেরা, না ফেরা নিয়ে ভাবার সময় পাননি, তবে ভরসাও বেশি দেখছেন না, ফিরে কী হবে? নিরাপত্তা না থাকলে যাবাে না। হাটগাছার কাশীপদ বিশ্বাস ঘাড় নেড়েছেন, যাবার ইচ্ছে নেই। তবে একথাও বলেছেন। স্বাধীন বাংলা হলে। অনেকে যাবেন। ওই আর এক বিশ্বাস- ননীগােপাল বিশ্বাস। এঁরা সবাই সদ্য আগত ৮৬-গ্রামের মানুষ। গ্রাম সমসপুর, থানা অভয়নগর । পায়রাহাটে টেলারিং দোকান। দুটো সেলাই মেসিন, হাজার টাকার ছিট, সব ফেলে আসতে হয়েছে। না, ফিরবাে না, যেন ভেবেই রেখেছিলেন।  

স্টেশন প্ল্যাটফরমেও স্থান করে নিয়েছেন; চত্বরও। দুজন জোয়ান বলছিলেন, এই মাসেই ধান কাটা হতাে। তাও ভােগ করা সইল না। স্বাধীন বাংলা হলে যাবাে, জোর খাটব এমন অবস্থা যদি হয়।’ অভয়নগর থানার মানুষ ধীরেন্দ্রনাথ কবিরাজ। নামেই প্রকাশ কবিরাজী করেন। সানন্দলী গ্রাম। ১৩ জনের পরিবার নিয়ে সবে এলেন। ‘তা জন্মভূমির জন্য প্রাণ কাঁদে বৈকি। সুযােগ সুবিধা হলে ফেরার আশা আছে। তবে ইয়াহিয়া থাকলে কদাপি নয়- পরের বাড়ি যাবাে না।’ তা এ প্রশ্নও করেছি, এখানেও ত শতেক অভাব, অসুবিধা সমস্যা। তাত জানেন? স্টেশনের বাইরে একটি পরিবার সেই মাত্র সঙ্গে আনা চাল ফুটিয়ে ভাত করে খেয়ে উঠেছেন। কর্তা মণ্ডল রায় সায় দিয়েছেন, তা জানিত নিশ্চয়ই। রেডিও শুনি না? কলকাতার রেডিওই ত শুনতাম। কী জানেন, নিত্য জুলুম, মেয়েদের নিয়ে অনাসৃষ্টি হলে থাকি কী করে? আওয়ামী লীগের ছেলেরা ১ মাস ঠেকিয়ে রেখেছিল ওদের প্রাণপণে । আর পারল না। এক বৃদ্ধা বসেছিলেন, বিড় বিড় করে কী বলছিলেন বুঝতে পারিনি। খেয়াল করে শুনতে বুঝলাম- সেই এক হাহাকার- ‘কত রাজা বদল হল, এমন ভিটে ছাড়া হই নি, আর মাইয়াটাও।’

১৪ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!