You dont have javascript enabled! Please enable it!

স্বাধীনতা নয় মৃত্যু ঢাকা ক্যানটনমেনটে অনশনরত বঙ্গবন্ধু

–তুষার পণ্ডিত

করিডরে অস্থির পায়ে একবার যাচ্ছিলেন আবার ফিরে আসছিলেন। ৫১ বছরের মানুষটিকে খুবই বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আওয়ামি লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিমর্ষ বিপর্যস্ত-কারণ, বাংলাদেশের মানুষকে মুক্ত করার জন্য তার প্রয়াস ব্যর্থ হয়েছে। পিনডির পিনডারিদের সঙ্গে সংঘর্ষ- সেই অনিবার্য অবস্থার জন্য তিনি  তৈরি হচ্ছিলেন। সবচেয়ে ছােট ছেলে রাসেলকে চুমু খেয়ে বিদায় দিলেন। ৬ বছরের রাসেল বাবার কোল থেকে কিছুতেই নামবে না। কিন্তু তাকে যেতেই হবে স্ত্রী বেগম ফজিলতেন্নেসাকে মুজিব বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বললেন। রাসেলের মা কাদছিলেন। রাসেলও কাদছে। কিন্তু মুজিবরের আদেশ ‘তােমাদের যেতেই হবে- এখুনি।’ বঙ্গবন্ধু বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন পাক সেনাদের হাতে তার স্ত্রী ও কন্যাদের যাতে কোন অমর্যাদা না হয়। প্রখ্যাত পদার্থবিদ ডঃ ওয়াজেদের সঙ্গে বড় মেয়ে হাসিনার (২১) বিয়ে হয়েছে। অন্য মেয়ে রেহানা (১৪) ধানমনডি গারলস স্কুলের ছাত্রী। দুজনকেই মুজিবুর চলে যেতে বললেন।

রাসেল বাদে তার অন্য ছেলেদের জন্যে বঙ্গবন্ধুর বিশেষ কোন উদ্বেগ্ন ছিল না। ১৯ বছরের শেখ কামাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বি-এ ক্লাসের ছাত্র। নিজে একজন ছাত্র নেতা। আন্দোলনের ঝড়ের মাথায় মাথায় সে ফিরছিল। কলেজের ছাত্র ১৭ বছরের শেখ জামালও সবসময় মুক্তি আন্দোলনের মাঝখানে। ঢাকার শহরতলী ধানমুনডির দোতলা বাড়ির জানালা দিয়ে বিকেলের আলাে টিমে হয়ে ভেতরে এসে পড়েছে। সামনের লনে একটু পরেই সন্ধ্যার আঁধার নেমে এল। বেগম ফজিলতেন্নেসা ছেলেমেয়েদের নিয়ে অনিশ্চিতের পথে পা বাড়ালেন। ৩২ নমবর ধানমুনডি রােডে মুজিবের বাড়িটা মারচ মাস থেকেই বাংলাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। এই বাড়ি থেকে যে নির্দেশ আসত-সাড়ে সাত কোটি বাঙালী ইসলামাবাদের আদেশ তুচ্ছ করে তা মেনে নিত। এখন তা শুণ্য-পরিত্যক্ত! মুজিবের দীর্ঘদিনের বন্ধু ৪৫ বছরের হাজি মুরসেদ টেলিফোনের পাশে রােজকার মতই বসেছিলেন। এতদিন তিনি মুজিবের সব টেলিফোন ধরতেন। ৬০ বছরের রমা ফরিদপুরের সেই ছােট্ট ছেলেটিকে ক্রমে ক্রমে বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠতে দেখেছে। সে এতদিন ধরে মুজিবের ঘরবাড়ি দেখাশােনা করে এসেছে নামেই শুধু পরিচারিকা। স্বাধীনতা যুদ্ধের মাঝখানে সে তার মনিবকে ছেড়ে যেতে রাজী হল না। “যা হয় হবে- আমি আপনাকে ছেড়ে যাব না।”। আরেকজন বালক ভৃত্য ছিল। সেও যেতে রাজি হয়নি। বাইরের লনে পাহারায় থাকল রাজা আর মহিউদ্দিন। সরকারী কর্মচারী, চাষী, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার, ছাত্র, শ্রমিক, আওয়ামি লীগের কর্মীরা-দলে দলে সারাদিন অনেকে এলেন। আমরা কি করব? তখন আর ফেরার কোন পথ নেই। সবারই প্রশ্ন-এরপর কি ঘটবে? কি ঘটবে?

২৪ মারচ। সন্ধ্যেবেলা । ইয়াহিয়ার অন্যতম পরামর্শাদতা জেনারেল পিরজাদা বৈঠক থেকে উঠে বেরিয়ে গেলেন। অজুহাত- কর্তার সঙ্গে পরামর্শ করতে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু তখনি বুঝেছিলেন। পিরজাদা আর ফেরেননি। মুজিবুর সব বুঝেছিলেন। পাক সৈন্যরা চরম আঘাত হানতে প্রস্তুত। তিনি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালেনচট্টগ্রামে শক্তি সংহত কর। আক্রমণ ঘটলে চট্টগ্রাম হবে আমাদের ঘাটি। চট্টগ্রামকে পাক বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত রাখতে হবে। ২৫ মারচ রাত ৯টা। স্ত্রী, কন্যা, বন্ধুবান্ধবদের মুজিব বিদায় দিলেন। সবাইকে বললেন গায়ে ছড়িয়ে পড়। সেখানে প্রতিরােধ গড়ে তােল। নিজে যেতে চাইলেন না। আমি গেলে আমাকে খোঁজার নামে অসংখ্য মানুষকে গুলি করা হবে। পাক দস্যুদের সে সুযােগ দেব না।’ 

রাত ১২টা ১৫। ঢাকা চারদিকে মেসিনগানের গুলির আওয়াজ। মুজিব তখন বিছানায় শুয়ে। চারদিকে গাড়ির শব্দ। মরটারের গােলা পড়ছে। তিনি বিছানা থেকে উঠে কেন্দ্রীয় টেলিগ্রাফ অফিসের কর্মীদের নির্দেশ দিলেন- সারাদেশে এই বার্তা পৌছে দিন- রাজারবাগে পুলিশ লাইনে পাক সেনাবাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছে। পিলখানায় ইপিআর সদর দফতর আক্রান্ত। প্রতিরােধ কর। স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য তৈরি হও।’

রাত ১২টা ৩০। গােলাবর্ষণ করতে করতে ধানমুণ্ডির দিকে পাক সৈন্যরা এগিয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু রাজা মহিউদ্দিনকে বললেন, ‘চলে যাও এখুনি। আমার আদেশ।’ অনিচ্ছায় ওরা বাড়ির বাইরে গিয়ে লুকিয়ে  থাকল।

রাত ১টা। সেনাবাহিনীর একখানা গাড়ী এসে থামল। গাড়ি থেকে সৈন্যরা লাফিয়ে নেমে গুলি চালাতে চালাতে বাড়ির ভেতর ঢুকলাে। ৪০ জন সৈন্য ও অফিসার মিলে বাড়িটি ঘিরে ফেলল। ওরা মুজিবকে যথেচ্ছ গালাগালি দিয়ে জানালায় দরজায় গুলি চালাচ্ছিল। রাত ১টা ৫। মুজিব দোতলার ঘর থেকে একতলার বারান্দায় নেমে এলেন। উত্তেজিত। চেঁচিয়ে উঠলেন, “নির্বিচারে গুলি চালিয়ে আমার লােকদের খুন করা বন্ধ কর। তার চেয়ে আমাকে মেরে ফেল।’ । সৈন্যরা তখন মুজিবকে আওয়ামি লীগকে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করছে। মুজিব ধৈর্যহারা হয়ে পড়লেন ‘সভ্য মানুষের মত ব্যবহার কর- কুকুর বেড়ালের মত কোরাে না।’ তখনাে তিনি বিড়বিড় করে কি বলছিলেন। সৈন্যরা এগিয়ে এসে তাকে, হাজি মুরসেদকে আর বঙ্গবন্ধুর দুই পরিচারককে ঘিরে ফেলল। মুজিবকে তার সামান্য বিছানা সুদ্ধ একটি টয়েটো মােটরগাড়িতে ওঠানাে হল। গাড়িটি সােজা ক্যানটনমেনটে গিয়ে ঢুকলাে।

২৬ মারচ। রাত ২টা। সৈন্যরা তখনাে ৩২ নম্বর ধানমুন্ডির বাড়িটি ঘিরে রেখেছে। সৈন্যরা আবার মেসিনগানের গুলি চালাতে চালাতে বাড়িটি তছনছ করে দিল। বাড়ির ভেতর থেকে কাগজপত্র এনে বড় রাস্তায় আগুন দিল । সৈন্যরা যেন মুজিবকে পায়নি। তাই এই তাণ্ডবনৃত্য। এই ভাবটা বাইরে প্রচার করার চেষ্টা চলল। মুজিবকে গােপনে হত্যা করার মতলবেই সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে এই  কাণ্ডটি করা হল।

মুজিবকে পাওয়া যায়নি- এটা রটাতে পারলেই বন্দী মুজিবকে হত্যা করে বাইরে বলা যাবে তাকে তাে আমরা পাইনি। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টা পরে ২৭ মারচ পাক বেতারে বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের খবর প্রচার করা হল। তাঁর দুজন পরিচারককে ছেড়ে দেওয়া হয়। কিন্তু হাজি মুরসেদ কোথায় কেউ জানে না। একজন এসব স্বচক্ষে দেখেছেন। তাঁর পরিবারবর্গ এখনাে বাংলাদেশে। পরিবারবর্গের অনিষ্ট হতে পারে এই আশংকায় নাম না প্রকাশ করে এসব কথা জানান। একটি রিপোেরটে বলা হয়, ২৬ মারচ সকালে মুজিবকে বিমানে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে পেশােয়ারের কাছে আটক দুর্গের বন্দীশালায় ।

প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ ঃ ৩১ মারচ বন্দীদশায় মুজিবের ছবি তােলা হয় করাচি বিমান বন্দরে । তখন রাত ৯টা ৩০ মিঃ। কাছেই পি আই এ-র বিমান দাঁড়ানাে। সম্ভবতঃ মুজিব তখনই করাচিতে এসেছেন কিংবা তাঁকে নিয়ে বিমানটি তখনই আবার ঢাকা রওনা হবে। গ্রেফতারের কিছু পরেই রাওয়ালপিনডি ও করাচিতে শােনা যায়- বঙ্গবন্ধু শত্রুর খাদ্য খাবেন না বলে অনশন ধর্মঘট করেছেন।  এপরিলের প্রথম সপ্তাহে মুজিবকে ঢাকায় আনা হয়। তাকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দী করে রাখা হয়। মুজিব অনশন করে চলেছেন। মৃত্যু নয়ত স্বাধীনতা এই তার প্রতিজ্ঞা। তাকে খাওয়ানাে যায়নি। 

নির্ভরযােগ্য সূত্রের খবর ঃ বঙ্গবন্ধু গুরুতর অসুস্থ। ওজন কমে যাচ্ছে। ঢাকার সামরিক হাসপাতালে বঙ্গবন্ধুকে সামরিক বাহিনীর ডাক্তাররা ইনজেকশন করে গ্লুকোজ দিচ্ছে। খাদ্য পাম্প করে খাওয়াবার চেষ্টা করছে। দেশদ্রোহের অভিযােগে বিচারের জন্য তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে। সেইজন্যই রিপােটাররা তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পাননি। [শেষ তিনটি অনুচ্ছেদ সঠিক নয়।]

১১ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!