You dont have javascript enabled! Please enable it! কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা (৫) বাংলাদেশের ডায়েরি - অরুণ চক্রবর্তী - সংগ্রামের নোটবুক

কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা (৫) বাংলাদেশের ডায়েরি

— অরুণ চক্রবর্তী

১২ এপ্রিল, সকাল আমার বন্ধু এবং তার দল নিশ্চয়ই মুক্তিফৌজ গঠন করেছে। কিন্তু গােপনীয়তা কেন বুঝলাম না। গতকাল আমি যখন ঘুমিয়ে আছি বাড়ির চাকরটার সঙ্গে এক ঘরে হঠাৎ চাপা গলার ডাক শুনলাম। চোখ মেলাের আগেই বুঝলাম চাকরটা দরজা খুলে দিয়েছে।  লণ্ঠনের স্বল্প আলােয় বড় বড় ছায়া মশারীর উপর পড়ল। মাথা উঁচু করে দেখলাম, ওরা সবাই চাকরের চৌকিটা এক পাশে সরাল। চাকরটা ঘরের মেঝের এক গর্তের ভিতর ঢুকে পড়ল। কয়েক জন বাইরে থেকে গর্তের ভিতর ঢুকে পড়ল। কয়েক জন বাইরে থেকে অনেকগুলাে রাইফেল গর্তে দাঁড়িয়ে থাকা লােকটার হাতে দিচ্ছে। আমি গভীর ঘুমের ভান করলাম। কে একজন আমার পিঠে টর্চের আলাে ফেলে দেখল, বুঝরাম। বুঝতে পারছি না, এরা কি করছে।

রাত আমার বন্ধু, আমার সঙ্গে একজন লােককে দিয়ে বলল, “এর সঙ্গে তুমি যাও। ভয় নেই। আমরা তােমার যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। ১৪ তারিখে লােক গিয়ে তােমাকে নিয়ে আসবে।” গ্রামের পথে হাঁটতে গিয়ে দেখলাম, আমার সঙ্গে আরাে এক ভদ্রলােকও আছেন। সাধারণ কৃষক। আমরা তিনজনে প্রায় পাঁচ মাইল দূরের এই গ্রামটিতে সন্ধ্যের আগেই পৌছে গেলাম। আসবার সময় নানা গ্রামের মধ্য দিয়ে আমাদের রিকশা এলাে। গ্রাম খাঁ খাঁ করছে। খালি ভিটা। আমাদের গাইড বলল, হিন্দুদের গ্রাম। সব লুঠ করে নিয়েছে। রিকসাওয়ালা মুখ ঘুরিয়ে বলল, “স্যার, দেশটা একেবারে ধ্বংস হয়ে গেল।” বেনিয়াপুকুর গ্রামের চাল করার মেশিন ঘরটা শূন্য। খা খা করছে। মেশিনটা পড়ে আছে। রাস্তার পাশের দোকানগুলাে দেখে মনে হচ্ছে, ওরা সবাই সব নিয়ে কোথায় যেন উঠে গেছে। ছেড়া কাগজ, সিগ্রেটের বড় বাক্স পড়ে আছে কতগুলাে। কিছুক্ষণ আগে ওপাশের বেড়াকোপা গ্রামের আগুন সারা আকাশ লাল করে তুলেছিল। কৃষ্ণপক্ষের রাত। তিন মাইল দূরের এই গ্রামে লাল আলাে-ছড়িয়ে পড়েছিল। 

১৩ এপ্রিল, দুপুর সকাল নটা নাগাদ আমাকে এবং আমার সঙ্গের ভদ্রলােককে নিয়ে বাড়ির মালিক বড় রাস্তার ধারে একটা ক্লাব ঘরের বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বসালেন। একে একে গ্রামের অনেক মাতব্বর এলেন। | আমাদের হাত দশেক দুরেই খােয়া বাধান পথ পূর্ব-পশ্চিমে বিস্তৃত। দলে দলে হিন্দু পরিবার যাচ্ছে। বেশীর ভাগই পায়ে হেঁটে। দুটো বেবী-ট্যাক্সি এবং একটি বাসকে যেতে দেখেছি বােঝাই যাত্রী নিয়ে। মুসলমানও আছে অনেক। ওদের চোখে উল্কণ্ঠা। চোখে জল শুকনাে। আমি ভাবছিলাম শিয়ালদহ স্টেশনের কথা। ট্রেনে ঠেসে গরু-ছাগলের মতাে এই নিঃস্ব মানুষগুলােকে নানা ক্যাম্পে নিয়ে যাবার কথাও মনে পড়ে গেল। ক্ষীণ আওয়াজ আসছে মাইল দেড় বিস্তৃত বিলের অপর পারের গ্রাম থেকে। লুঠ চলছে। | একদল উদ্বাস্তু এদিকেই আসছে। এক যুবক। এক কাঁধে শীর্ণ একটা মেয়ে, অপর কাঁধে ভার। দুপাশে তােষক আর মাদুর। কেঁদে পড়ল, “দাদাগাে”! কত কষ্ট করে সংসার করছিলাম।” 

সবার চোখে জল। একজন বললেন, “পারলাম না। আমরা ঠেকাতি পারলাম না।” ফুলতলা থেকে একজন সাইকেলে আমার সঙ্গীকে খবর দিয়ে গেল, অপারেশন সাকসেসফুল। আমার সঙ্গীর দাড়ির ভিড়ে এতক্ষণে হাসি ফুটল। | আমি জানি না, এবার আমাকে ওরা কোথায় পাঠাবে। আমার সঙ্গী এখানকার পরিস্থিতি যাচাই করতে এসেছিল। তার মতামত নিয়ে সাইকেল-দূত ফুলতলায় চলে গেছে। সাতক্ষীরা, ১৪ এপরিল, রাত এখন আমি খুব ক্লান্ত। সারাদিনে চল্লিশ মাইল সাইক্লিং করে সাতক্ষীরায় পৌছেছি রাত সাড়ে আটটায়। একটা সাইকেলে দুজন ছিলাম। ভাগাভাগি করে চালিয়ে এসেছি। আমার সঙ্গী-ই পি সি পি (এম-এল) এর একজন তরুণ কমরেড। কাল কমরেড ফিরে যাবে এতটা রাস্তা সাইক্লিং করে।

আজ সকালে ফুলতলার স্কোয়াড এসে গেছে। ওদের কাছেই জানলাম কুখ্যাত ডাকাত রাজ্জাককে খতম করার প্ল্যান তাদের। | আমাকে তরুণ কমরেডের সঙ্গে সাতক্ষীরায় যেতে হবে। বেলা আড়াইটা নাগাদ খেয়ে দেয়ে আমরা রওনা হলাম। প্রথমটা আমি খুবই ভীত ছিলাম। কিন্তু জামুরিয়া বাজার পেরুতেই ভয়টা আর রইল না। রাস্তায় অনেক হিন্দুকে নির্বিঘ্নে রাস্তা দিয়ে চলতে দেখলাম। বুঝলাম, দাঙ্গা কিংবা লুঠ এদিকে নেই । সােয়া পাঁচটা নাগাদ আমরা চুকনগর পেরিয়ে যশাের-খুলনা সীমান্তে পৌছুলাম। এখানকার খেয়াঘাটের মালি হিন্দু। খেয়াতে অনেক হিন্দুকেই দেখলাম।

দুজন মুসলমান যুবকের কথােপকখন কানে এলাে। গতকাল এখান দিয়ে নাকি হাজার হাজার হিন্দু সাতক্ষীরার পথে গেছে। “কেন?” জিজ্ঞাসা করল অপর যুবক। উত্তর ঃ “কি জানু? শুনছি, হিন্দুদের ঘরবাড়ি লুঠ করতিছে।” আমি অবাক, এরা জানেই না! সাতক্ষীরা শহরের পূর্ব দিকে যশাের রােডের ধারে এক বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। কাল ভােরে সাতক্ষীরা ত্যাগ করতেই হবে। সাতক্ষীরা মুক্তিফৌজের সম্পূর্ণ দখলে।  আমি কয়েকজনের সঙ্গে আলােচনা করে এইটুকু বুঝলাম; এক সেকেন্ডের মধ্যে সাতক্ষীরায় পাক সৈন্যের হামলা শুরু হতে পারে। আবার পনেরাে দিনের মধ্যে নাও হতে পারে।সাতক্ষীরায় হামলা হলে প্রতিরােধ করা অসম্ভব। কেননা, মুক্তিফৌজ শহর থেকে দশ মাইল দূরে তাদের ঘাটি গেড়েছে। সারা শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা। ভালােমত বসতে বা শুতে পারছিনা। কলকাতা, ১৫ এপরিল রাত আজ নববর্ষ। গতকাল সাতক্ষীরায় আসবার পথে রাস্তার ধারে ধারে হিন্দুদের চড়ক পূজার অনুষ্ঠান দেখেছি। ঢাক কাঁসর বাজছিল। আজকের দিনটাকে শুভ মনে হচ্ছিল। কিন্তু আতঙ্ক আমার সারা দেহে। হাঁটতে পারছি না। ব্যথা শরীরে। এগারটা নাগাদ হেলিকপটার বাড়ির দরজায় এল। হেলিকপটার সমগ্র বাংলাদেশে কেন, সাতক্ষীরা ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোথাও এই হেলিকপটার নেই। দুই চাকার সাইকেলে পিছনের কেরিয়ারে গদি আঁটা। আপনি চলুন, পাইলট প্যাডেল করে চল্লিশ-পঞ্চাশ মাইল নিয়ে যাবে একটানা। দশ মাইলের ভাড়া দেড় টাকা। এখন এমারজেনসি পিরিয়ড তাই আড়াই টাকা। সাতক্ষীরার থেকে এক প্যাকেট চারমিনার কিনলাম। আনন্দবাজার পত্রিকার একটা কপিও। হেলিকপটার ছুটল। 

সারাটা পথ জুড়ে হিন্দু ও মুসলমান শরণার্থীর ভিড়- ভারতে চলেছে। ভারত থেকে আসছে হিন্দু মুসলমান উভয়েই বাংলদেশ দেখতে। | হেলিকপটার সাঁ সাঁ করে ঢুকে গেল ভারতের মাটিতে। আমি বিস্মিত। এত উৎকণ্ঠার দিনগুলাের শেষ এমন করে হবে ভাবতে পারিনি। সবাইকে জিজ্ঞাসা করছি, এটা ভারত? সবাই হাসছে। ইটিনডা বাজারে দেখলাম। বড় দেওয়াল লিখনঃ ‘ডান কমুনিস্টদের জিজ্ঞেস করুন, কেন…’। আমি স্থির, আমি ভারতের মাটিতে। কিন্তু আনন্দ পেলাম না। মনে পড়ে গেল সাংবাদিক দীপক ব্যানারজির কথা। আমার বন্ধু সুরজিত ঘােষালের কথা। দীপক আমার সহপাঠী ছিল। ওরাও কি পারবে না ফিরতে পারবে। মনে হল, যে দেশের মানুষ আজ সহৃদয় সচেতন, সেখানে শত্রুসৈন্য খতম করে স্বাধীনতা আদায়ে মানুষ বদ্ধপরিকর সেখানে ওদের অসুবিধে হবে না।

২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা