You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.06 | বমবে শহরেও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ - সলিল ঘােষ - সংগ্রামের নোটবুক

বমবে শহরেও বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগ

— সলিল ঘােষ

‘বাংলাদেশ’-বাংলাদেশ সারা ভারতবর্ষ যেন বাংলাদেশে-এ পরিণত হয়েছে। ভাবা যায় না। সাম্প্রদায়িক মনােভাবের উর্ধ্বে উঠে এদেশে হিন্দু-মুসলমান ও অন্যান্য ধর্মালম্বিদের মধ্যে এই সম্প্রীতির মনােভাব অন্য উপলক্ষে কখনও ঘটেনি। বমবে শহরেও এর কোন ব্যতিক্রম হয়নি। বাংলাদেশই হলাে এখানকার সকলের উদ্বেগ, আশংকা, সহানুভূতি আলােচনার বিষয়। জনসাধারণ বাংলাদেশ এর মুক্তি সংগ্রামীদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছে, যদিও রাজনৈতিক দলগুলি ও সরকার কোন প্রকার আহ্বান বা নির্দেশ না দেওয়া সত্ত্বেও। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিকট হইতে কোন প্রকার নির্দেশ ছিল না বলে প্রথমদিকে জনসাধারণ কেমন যেন বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিল তাদের কর্তব্য সম্বন্ধে। কিভাবে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে যাবে বুঝতে পারছিল না, প্রবল আকাথা সত্ত্বেও কিছু করার। এই অবস্থায় বাংলাদেশের জন্য এখানে সংগঠিতভাবে প্রথম সাহায্যের আবেদন জানাল। “বাংলাদেশ এইড কমিটি” শ্রী হরিশ মহীন্দ্ররের সভাপতিত্বে। মুসলমান সমাজের বেশ কিছু প্রতিনিধিও এই সমিতিতে যােগ দিলেন, যেমন বেগম মহবুব নাসরুল্লা, চিত্র তারকা শ্ৰীমতী ওয়াহিদা রহমান, তরুণ শিল্পপতি জনাব মুকু হামিদ। স্থানীয় মুসলমান সমাজ-এর বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন থাকলেও নানা কারণে এরা কিছুটা নীরব ছিল। কিন্তু বিখ্যাত উর্দু কবি আলি সর্দার জাফরী, কায়ফী আজমি প্রমুখ বুদ্ধিজীবীদের নানা স্থানে।  

আবেগপুর্ণ আবেদন বক্তৃতা বহু মুসলমানকে বাংলাদেশের পক্ষে এগিয়ে আসতে উদ্দীপিত করে। উর্দুভাষীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় কাওয়ালি সঙ্গীতশিল্পী শ্রীইউসুফ আজাদও শ্রীমতী রসিদা খাতুন বাংলাদেশএর সাহায্যে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান করতে এগিয়ে আসেন। এরপর থেকেই সর্বত্র, এমন কি মুসলমান সমাজের মধ্যেও বাংলাদেশের স্বপক্ষে জনমত দানা বাঁধতে শুরু করে। নানাভাবে জনসাধারণ বিশেষ করে তরুণ সমাজও এগিয়ে এসেছে বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির কাজে। এসব ক্ষেত্রে যা হয়, নানা সমিতি, প্রায়ই একই ধরনের নামে, নানাভাবে সাহায্যে অনুষ্ঠান ও অর্থ সংগ্রহ করতে লেগেছে। বহু ক্ষেত্রে প্রতিযােগীতার মনােভাবও বর্তমান। এর উপর কিছু ব্যবসায়ী, কিছু শিল্পী “বাংলাদেশের প্রতি জনসাধারণের এই সহানুভূতিকে মােকাবেলা করে ব্যবসায়িকভাবে লাভবান হবার প্রচেষ্টায় আছে। তবে অসামাজিক ব্যক্তিরাও সুযােগ নিতে ছাড়ছে না।

“বৃহৎ বমবে বাঙ্গালী সমাজ” আয়ােজিত স্থানীয় চলচ্চিত্র শিল্পের কুশলীদের নিয়ে অনুষ্ঠান খুবই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল, বিশেষ করে শ্রী শচীনদেব বর্মণের গান। শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও ৬৫ বছরের শচীন কর্তা এক আবেগপূর্ণ আবেদন ও আহ্বান জানান বাংলাদেশের সাহায্যে সব শিল্পীদের এগিয়ে আসতে। তারপর বাংলাদেশের বিশিষ্ট বৃহৎ ঢােল নিয়ে রচিত তার এক পুরানাে গানের নব সংস্করণ মীরাদেবী রচিত  গানটি করেন শ্রী অবনী দাশগুপ্তের ঢােল বাদনের সঙ্গে মাতিয়ে দিয়েছিলেন ৩০০০ শ্রোতাদের, বিরাট যখান প্রেক্ষাগৃহে। গানের কথা হল “আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই অখণ্ড এই ঢােল সব ভুলে যাই তাও ভুলি না। বাংলা মায়ের কোল আমাদের মশাল কভু নেড়েনা মুজিবরের ভাই আমরাবাঁচতে জানি মরি না।” ইত্যাদি। এই অনুষ্ঠানে অন্যতম আকর্ষণ ছিল-শ্রী হট্টের জনপ্রিয় লােক সংগীত শিল্পী শ্রী নির্মলেন্দু চৌধুরী, বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি কলকাতা থেকে এখানে আসেন। তাঁর নতুন গান “রাম কান্দে রহিমের লাগিয়া” শ্রোতাদের নিকট সঙ্গে সঙ্গে ‘হিট’ গানে পরিণত হয়। বাংলাদেশ সম্বন্ধে এবং দুই বাংলার বিভিন্ন সমস্যা সম্বন্ধে জনমত গঠনে এখানে সৌমেন্দ্র ঠাকুরের কয়েকটি বক্তৃতা খুবই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। বাংলা ও ইংরাজী দুই ভাষাতেই সুবক্তা সৌমেন্দ্রনাথ যেভাবে বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দেন, তা সকলকেই চমক্ত করে।

৬ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা