You dont have javascript enabled! Please enable it!

কলকাতা-ঢাকা-কলকাতা বাংলাদেশের ডায়েরি

— অরুণ চক্রবর্তী

বাংলাদেশে আগুন জ্বলে ২৫ মারচ রাত থেকে। তার ঠিক আগের দিন আমাদের প্রতিনিধি অরুণ চক্রবর্তী হরিদাসপুর সীমান্ত দিয়ে ওই বাংলায় প্রবেশ করেন। বিচিত্র অভিজ্ঞতার পথে পথে কুড়িয়ে ঢাকায় যেদিন তিনি পৌছলেন, সেদিন মধ্যরাত্রি থেকেই নৱহত্যালীলা শুরু। বিভীষিকাপূর্ণ কয়েকটি রাত ও দিন শহরে  কাটিয়ে তিনি আবার কলকাতার পথ ধরেন। চারিদিকে তখন প্রচণ্ড লড়াই চলছে। ২৪ মারচ থেকে ১৫ এপরিল- এই তেইশ দিনের বাংলাদেশের ডায়েরি কয়েক কিস্তিতে প্রকাশিত হবে। আজ পয়লা কিস্তি। হরিদাসপুর ২৪ মারচ ॥ বেলা প্রায় একটা। কাটায় ভরা বেগুন ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে এলাম। সেখান দুজন যুবক আমাকে অভ্যর্থনা জানাল। ওরা জানল, আমি স্কুল মাস্টার। লেখক মানুষ। পূর্ব-বাংলার সংগ্রামের ওপর বই লেখবার জন্য উপকরণ সংগ্রহ করতে তাদের দেশে এসেছি। ওরাই আমায় একটা রিকশায় নিয়ে গেল বেনাপােল বাজারে। সেখান থেকে একটা স্কুটারে যশােরের দিকে দ্রুতগতিতে রওনা হলাম। 

পথে ঝিকরগাছা। সীমান্ত থেকে প্রায় দশ মাইল। হাট বসেছে। প্রায় সকলের বুকে কালাে ব্যাজ । রিকশায় হ্যানডেলে জয় বাংলা আর কালাে পতাকা। আমি একটা ডাবের জল পান করলাম। ছােট্ট হাটের এখানে ওখানে জয় বাংলা পতাকা। গত সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতীক একটা নৌকা (কাগজের তৈরী) দুটো গাছে সটান বাধা। তারই নীচ দিয়ে আমরা আবার এগিয়ে চললাম। | সীমান্ত থেকে প্রায় সতেরাে-আঠারাে মাইল এসেছি। একজন পুলিশ অফিসার ও তার সিপাই আমাদের থামতে বললেন। আমার ব্যাগ সারচ করে কয়েকটি কাগজপত্র পেলেন। আমাকে ভয় দেখালেন। সিপাই আমাকে একদিকে নিয়ে গিয়ে বিপদ উদ্ধারের সহজ পথ বাৎলালেন। টাকা চাই। কম করে একশ। নইলে হাতের ফেবর-লবা ঘড়ি। ড্রাইভার নিশ্চপ। আমি নিরুপায় হয়ে হাতের ঘড়িই খুললাম। তবে ঘড়িটা সিপাইটার হাতে দিতে গিয়ে আবেগ জড়ানাে গলায় বললাম, “আমি আপনাদের সেবা করতেই এসেছি। ক্ষতি করতে নয়। বাংলার ছেলে আমিও।” আমার কথায় খুব মায়া জড়ানাে ছিল। ড্রাইভার ঘুরে দাড়ালাে। ঘড়িটা সিপাইয়ের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আমাকে দিল। পুলিশ অফিসারের কাছে গিয়ে কী বলল বুঝলাম । ওর শেষের উত্তেজনা শুনলাম, “আমার টাকা দরকার নেই। আপনারাই নিন।” | আমার কাছ থেকে কুড়ি টাকা নিয়ে সিপাইয়ের হাতে গুঁজে দিয়ে সে গাড়ী ছাড়ল। আমার কাছে তখন মাত্র সতের টাকা। আমি বিস্মিত হলাম, এ কোন দেশে এসেছি। দেশের প্রতি এমন দুর্বলতা আর কোন জাতির ইতিহাসে আছে। বেবী ট্যাকসি যশাের স্টেশনের কাছে থামল। ড্রাইভার একজন রিকশাওয়ালাকে ডাকলাে। আমার কাছ থেকে সাত টাকা নিল সে। বলল, “বাকী পাঁচ টাকার ওপর আমার কোন দাবী নেই। আপনি দ্বিধা করবেন ।” বিকেল প্রায় পাঁচটা। 

যশাের থেকে খুলনায় চলেছি। বাসে। আমার পাশে জানলার ধারে একজন সাধারণ কৃষক। নীল সারট পরা। বুকে ধূলাে জমা কালাে ব্যাজ । লুঙ্গিটাকে হাঁটুর ওপর উঠিয়ে আরাম করে বসেছেন। একমনে “দৈনিক ইত্তেফাক” পড়ছেন। আমার ইত্তেফাকের কপিটা পড়ছেন সামনের সীটের এক শীর্ণকায় যুবক। অনেক পথ। অনেক যাত্রী। নানা বক্তব্য। বেশীর ভাগ কথাবার্তায় মূল বক্তব্য বাংলা। গতকালের প্রতিরােধ দিবসের সফলতার কথা। বাসটা চলেছে যেন এক ঝাঁক হর্ষোৎফুল্ল মানুষকে নিয়ে। কুলতলার কিছু আগে পাশের কৃষক বলে উঠলেন “দেখিছেন, ক্যামন হক কথা লিইখেছে।” দেখলাম ২৩ মারচের প্রকাশিত ইত্তেফাকের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় সুহৃদের বিশেষ রচনার এক অংশ। সুহৃদ লিখেছেন, “যাহারা একদিন লােটা কম্বল লইয়া এদেশে আসিয়াছিল” তারা তাদের স্বার্থরক্ষায় বাংলার মুক্তিসংগ্রামকে ব্যহত করার জন্য কোমর বেঁধেছে। এদের প্রত্যেকের উপর জনসাধারণের সতর্কতাকে আহ্বান জানিয়েছেন। আমি এই সচেতন মানুষটার দিকে তাকিয়ে বললাম শিয়ালদাহ স্টেশনের প্ল্যাটফরমে এমনি অভুক্ত মানুষের। ছবি অনেক দেখেছি। শীর্ণ। তফাৎ, একে অনেক সচেতন মনে হল।  আরাে কিছু পরে সামনের যুবক আমার কাগজটা ফেরৎ, দিতে বলল, “দেখিছেন, শালার দাউদ কেমন কথা লিইখেছে।” দেখলাম, দাউদ পেট্রোলিয়াম আর বিজ্ঞাপনে সুকান্তের কবিতার উদ্ধৃতি দিয়ে আমরাও বাংলার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ এমন একটা উক্তি। আমি জানতাম, পশ্চিম পাকিস্তানের যে দুটি বিরাট শিল্পপতি। আছেন, দাউদ তাদের একজন।

খুলনা, রাত সাতটা বাসটা টারমিনালে দাঁড়াতে একটা ছােট ছেলে চিৎকার করে উঠল, জয় বাংলা। রিকশা করে দৌলতপুরের দিকে চলতে শুরু করলাম। দৌলতপুরে আসবার সময় নামতে পারতাম, কিন্তু আমার একটা ধারণা ছিল খুলনা থেকে দৌলতপুর বেশ কিছুটা দুরে। নিষ্প্রদীপ রাস্তা। রিকশা একটা জুটমিলের দিকে চলল। | জুটমিলে বন্ধু থাকেন। সহাস্যে অভ্যর্থনা জানালেন। বললেন, সময় নেই, চলাে টেলিভিশন দেখে আসি। ছুটলাম পাশের বাড়িতে। তখন দেশাত্মবােধক গান হচ্ছে। শুধু একটি লাইন, “আমাদের সংগ্রাম চলছে চলবে।” বিভিন্ন মারচিং সুরে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন হচ্ছে। গা শিউরে উঠছে ক্যামেরার কারসাজী আর গায়ক-গায়িকাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের পরিরচয়ে। ভাবছি, এখনাে স্বাধীন নয় যে দেশ সেখানে এ কি দেখছি?

শুরু হল অনুষ্ঠানের অন্যান্য গান। দস্যু দমন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞার গান, বাংলা মাকে সাজাতে আবেপ্রবণ গান; সংগ্রামী হতে দেহমনকে গড়ে তােলার আশ্চর্য সুর-সংযােজন। | শুরু হল খবর, কালাে ব্যাজ পরা খবর পাঠক পড়ে চললেন। দৃঢ় তার ভাষা আর ভঙ্গি। জনগণকে আহ্বান করার বক্তৃতা যেন। রমনা ময়দানে সামরিক মহড়ার চলচ্চিত্র সহযােগে খবর পাঠ করলেন। শেখ মুজিবরের বক্তব্য পাঠ করবার সময় দেখা গেল দৃঢ়চেতা মুজিবরের ছবি। ভুট্টোর ছবিও। বিশ্বাস করলাম, এ এক আশ্চর্য দেশ দেখার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছি। খুলনা, ২৫ মারচ, ভাের সাড়ে চারটে বন্ধুর টয়ােটা করােনা গাড়ীতে চেপে খুলনা স্টেশনে পৌছুলাম। বন্ধুই সব ব্যবস্থা করে ছিলেন। গাড়িটা  

ছাড়তে ও ফিরে গেল। মনে পড়ল, স্টেশনে আসবার সময় বন্ধু বলেছিলেন, “নয় বছর আগে যে দেশ দেখেছাে (আমি ১৯৬২ সালে ভারতে গিয়েছি) তা খুঁজতে চেয়াে না।” সিরাজগঞ্জ ঘাট, দুপুর। সমস্ত ভ্রমণে একটাই জিনিসই লক্ষ্য করলাম। একটা উত্তেজনা। সমগ্র দেশটা যেন স্বাধীনতার উৎসবে মেতেছে, সবার মুখেই এক আশ্চর্য প্রত্যয়। স্টিমারে এক ভদ্রলােক জানালেন, ইয়াহিয়া ছয় দফা মেনে নিয়েছেন। রেডিওতে নাকি শুনেছেন তিনি। আমার চারপাশে বিভিন্ন জীবনযাত্রার মানুষ। সকলের মুখেই প্রত্যয়ের হাসি। ডেকে দাঁড়িয়ে উচ্ছসিত যমুনার বুকে অসংখ্য ছােট-বড় নৌকা দেখছিলাম। সব নৌকার মাথাতেই দুটি পতাকা। সবুজ-সােনা আর কালাে। ভাবলাম, কান পাতলে বুঝি শােনা যাবে সেই গান, আমার সােনার বাংলা ঢাকা, রাত প্রায় দশটা পূর্ব ব্যবস্থা অনুযায়ী বন্ধুকে পেয়ে গেলাম। একটা বেবী ট্যাকসিতে করে তাদের সিদ্ধেশ্বরী রােডের বাড়িতে এলাম। পথে অনেকগুলাে মিলিটারী ট্রাক দেখলাম। সশস্ত্র মিলিটারী চোখে পড়লাে। রাস্তা খুব ফাকা। বন্ধু বলল, এই মাসটা জুড়েই এমনটা চলছে। লক্ষ্য করলাম, সমস্ত রাস্তায় মেয়েদের 

চলতে দেখলাম না। বেনাপােল থেকে খুলনা যাবার পথেও নারীদের চোখে পড়েনি। রাত প্রায় দুটো। | লম্বা ট্রেন জারনির পর আমি একটু বেহুশের মতােই শুয়েছিলাম। দরজায় অকস্মাৎ ব্যস্ত আঘাতের শব্দে চমকে উঠি। বন্ধু ঘরে ঢুকে বলল, “সর্বনাশ হয়েছে। সমস্ত ঢাকা শহরে মিলিটারী ছেয়ে গেছে। গােলাগুলিও চলছে। সম্ভবত মিলিটারী কুপ। ইয়াহিয়া নাকি গ্রেফতার হয়েছেন।” | বাড়ির সবাই জেগে উঠেছে। বন্ধু ছাদে ছুটল। আমি ভারী মােটরের আওয়াজ শুনে জানলা একটু ফাক করে দেখলাম, একটা জীপের পিছনে তিন ট্রাক বােঝাই রাইফেল, স্ট্রেনগান সজ্জিত সৈন্য। সামনের সিদ্ধেশ্বরী রােড বেয়ে চলেছে। বন্ধু কয়েক জায়গায় ফোন করলেন। বললেন, “সব জায়গায় একই অবস্থা- ধানমণ্ডী, চকবাজার, তেজগাঁ সর্বত্র।” | আমাদের সবার মুখ বিবর্ণ। বন্ধুর বৃদ্ধ পিতা আল্লার উদ্দেশ্যে মােনাজাত করলেন। বন্ধু স্তব্ধ। পরিবারের আর সকলের সঙ্গে আমিও। | আকাশ চিরে মেঘের ডাকের মতাে এক বিকট শব্দে রাত্রির নিস্তব্ধতা ভাঙ্গল। আওয়াজটা এলাে দক্ষিণপশ্চিম কোণ থেকে। তেজগার দিক থেকে। ঘরের সব আলাে নিভিয়ে দিতেই আবার শুনলাম সেই প্রচণ্ড আওয়াজ। আবার আবারও। মুহুর্মুহু। বাড়ির কাঁচের শার্সিগুলাে ঝরঝর শব্দে কেঁপে উঠতে শুরু করল। | একতলার ড্রইংরুমের পাশে বাথরুম আর দুটো ঘরের মাঝখানে ছােট জায়গাটিতে সেই পরিবারের পাঁচজন আর আমি অন্ধকারে মেঝেতে রুদ্ধশ্বাসে বসে রইলাম। আমরা নিজেদের নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। ২৬ মারচ, ভাের। আমি আর আমার বন্ধু ছাদে দাঁড়িয়ে শহরের স্কাইলাইন দেখছিলাম। অনেক প্রান্তে কুণ্ডলীকৃত ধোয়া দেখতে পেলাম। সম্ভবত, রাতের আগুনে শেষটুকুও জ্বলছে।

আবছা আলােতেই আমাদের বাম পাশের গলির মুখটাতে একটা ছােট জনতা নজর পড়ল। তাদের কয়েকজনের হাতে বন্দুক। পরনে কারাে লুঙ্গি, কারাে প্যানট। কেউবা পাজামা পরা। আওয়াজের প্রচণ্ডতা এবং দ্রুততা থেকেই বুঝতে পারছিলাম যুদ্ধ চলছে চারপাশে। উত্তর পূর্ব দিকে মগবাজার অঞ্চলে; আমাদের সামনের দিকে কয়েকটা বাড়ি পেরিয়ে ওপাশের এলাকায়। দক্ষিণে পুরানাে। পল্টনে। আমার মনে হলাে সমস্ত ঢাকাতেই যুদ্ধ চলছে। সকাল আটটার পর গােলাগুলির আওয়াজ তীব্র হয়েছে আরাে। মনে হচ্ছে, খুব ভারী অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি রাইফেল আর মেসিনগানের শব্দ ছাড়া একমাত্র হাত বােমার শব্দেই অভিজ্ঞ। তাই ঠিক কি ধরনের গােলাগুলি ব্যবহৃত হচ্ছে বুঝতে পারছিনা।

আমি যে বাড়িতে আছি, তার থেকে প্রায় দুশ’ গজ দূর দিয়ে একটা ট্যাঙ্ককে বেশ জোর গতিতেই চলে যেতে দেখলাম কিছুক্ষণ আগে। এখন চব্বিশ ঘন্টার কারফু চলছে। রাত বারােটা সারাদিন এক তীব্র উৎকণ্ঠায় কাটল। প্রচুর মৃত্যুর খবর এ পাড়ায় আসছে। আমার বন্ধু তার বেশ কয়েকজন পরিচিতের নাম বলল। যারা এ পাড়ার, এবং এগিয়ে হাটখােলার কাছে মিলিটারীকে বাধা দিতে গিয়ে মারা গেছে। আমার বন্ধু সারাদিন পাড়ায় ঘুরছেন, ও চেষ্টা করছে, পাড়া থেকে যাতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি না হয়। কেননা, ও বলল, যে সমস্ত জায়গায় একটিমাত্র বন্দুকেরও আওয়াজ পাওয়া গেছে, সামরিক বাহিনী তার আশেপাশের ব্যাপক অঞ্চলকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে, আগুনে এবং বােমায়।  বন্ধু খবর দিল, ইত্তেফাক অফিসের অনেক কর্মচারী নিহত হয়েছে। এবং ইত্তেফাক অফিস ধ্বংস করে ফেলেছে। আমি খবর সংগ্রহের কোন উপায় দেখছিনা। তাছাড়া খবর পাঠাবার কোন উপায়ও দেখছি না। চারদিকে তাণ্ডব চলছে।

২৪ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!