You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.29 | আমিও জয় বাংলা বললাম -বরুণ সেনগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

আমিও জয় বাংলা বললাম

–বরুণ সেনগুপ্ত

মুজিবরের ‘বাংলাদেশ’ দেখে এলাম। খুলনা জেলায়। পারুলিয়া- সাতক্ষীরা অঞ্চলে। সীমান্ত থেকে বেশ কয়েক মাইল ভেতরে। ইছামতীর অনেকটা পূবে। রবিবার প্রায় গােটা দিনটা এই নতুন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কাটিয়ে এলাম। পুরনাে মাটির নতুন দেশের আবাল বৃদ্ধ বনিতার নতুন প্রাণের স্পন্দন অনুভব করে এলাম। বারবার জয়-বাংলা’ ধ্বনি শুনলাম। আমরা পশ্চিম বঙ্গের দুই সাংবাদিক নতুন বাঙ্গলার তরুণপ্রৌঢ় বৃদ্ধের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে বলে এলাম “জয় বাংলা”। জয় বাংলা । হ্যা জয় বাংলা। কারণ এ’এক নতুন বাংলাদেশ। আমিও ওই বাংলারই ছেলে। কিন্তু এমন প্রাণের আবেগ, এমন মনের দৃঢ়তা এবং এত একতা আমি ওই বাংলায় কোনও দিন দেখিনি। যেমন দেখেছি রবিবার মুজিবরের “বাংলাদেশ” । সেই পূর্ববাংলা, সেই খেজুর গাছ, সেই নারকেলের সারি, সেই মানুষ, সেই দাড়ি, সেই লুঙ্গি কিন্তু তবু এ এক নতুন দেশ, এক নতুন জাতি। ওপারে না গেলে যা বােঝা যায় না, যার অনুভূতি পাওয়া যায় না। | রবিবার সকাল বেলা বেরিয়ে পড়লাম কলকাতা থেকে। ইচ্ছা ছিল সীমান্তটা ঘুরে দেখে আসব। কিছু খবর টবর পাওয়া যায় কিনা। ওপার থেকে এপারে কোনও সংবাদ আসে কিনা। সীমান্তে। একটা বরডার আউট পােসটে। জিজ্ঞেস করলাম খবর কী? হতাশ হলাম। কোনও খবর নেই । খবর আসছে না। চলাচল বন্ধ। এমন কি প্রতিদিনের চোরাই চালানকারীরাও নাকি যাতায়াত বন্ধ করে দিয়েছে।

ফিরে আসছিলাম। পথে দেখা হল দুটি ছেলের সঙ্গে। কালাে ব্যাজ বুকে। গাড়ী থামালাম। জিজ্ঞাসা করলাম, কালাে ব্যাজ কেন? বললে ও পূর্ব বাংলার সমর্থনে। জানেন না, পূর্ব বাংলায়ও সাবই কালাে ব্যাজ পরছে? পূর্ব বাংলা কালাে পতাকা উড়ছে? বললাম ঃ তা ঠিকই। কিন্তু ওপারে যা সব হচ্ছে তার কোন খবর টবর পাচ্ছেন কি? শুনছেন কিছু? ওরা একটু থমকে দাঁড়াল। দুজনে দুজনের দিকে তাকালাে। তারপর বললঃ আপনারা?  পরিচয় দিলাম। বললাম আমাদের সীমান্তে আসার উদ্দেশ্য। ওরা হাসল। বলল আসুন। চলে আসুন আমাদের সঙ্গে। একঘণ্টা পরেই আমরা চারজন ইছামতির উপরে। জোয়ার এসেছে। নৌকা এগােচ্ছে পূবে। পারুলিয়া সাতক্ষীরার দিকে। ওরা দুজন- অমিয় আর গােবিন্দ। আমরা দুজন আমি এবং হিন্দুস্থান স্ট্যানডারডের সােমেন।। ওপারে নামলাম। সেই মাটি, সেই খেজুর গাছ, এপারেও যা ওপারেও তাই। গ্রামের মধ্য দিয়ে এগােলাম। পূবে আরও পূবে। পুকুরে স্নান করছে মেমরা। দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্ছেন চাচা। বাচ্চা ছেলেরা উঠুনে খেলছে।

যুবকরা দুচারজন জিজ্ঞেস করলেন ? কোথায়? কোন দিকে? অমিয় জবাব দিল ঃ পারুলিয়ায়। মােহিত ভাস্কর বাড়ি। জয় বাংলা দেখতে। ওরা স্বাগত জানালেন। বললেনঃ হ্যা এগিয়ে যান, সাতক্ষীরাটাও ঘুরে আসবেন। রাস্তাগুলি কেইটে দেওয়া হয়েছে। দেখে আসবেন। খানদের আর এগুতি হবেনা।  মাঠ ভেঙ্গে নালা পেরিয়ে ভরা রােদে হাঁটতে হাঁটতে এগােলাম। পা ভেঙ্গে আসছিল । শহরে লােক আমরা। হাঁটতেই কষ্ট হয়। তায় তাে অমন হাঁটা। তবুও এগিয়ে চললাম। মুজিবর রহমানের মুক্তি ফৌজকে দেখব বলে। অবশেষে ঘণ্টা দুয়েক পরে পৌছলাম পারুলিয়ায়- মােহিত ভাস্কর বাড়ীতে। শুনলেন সব। আনন্দে প্রায় জড়িয়ে ধরলেন। বললেনঃ আপনারাই তাে ভরসা। আপনারা ছাড়া কে আর আমাদের সাহায্য করবে। আপনারা আর আমারইতাে বাঙালী।

আধ ঘণ্টার মধ্যে ভরে উঠল বাহির বাড়ী। এলেন পারুলিয়া আওয়ামী লীগের সম্পাদক আসরাফউদ্দিন সাহেব। এলেন আরও অনেকে। বললাম ঃ এখন বসতে চাই না। চলুন রাস্তাঘাটের অবস্থা দেখে আসি। | সবাই এগােলাম পারুলিয়ায়-সাতক্ষীরা যশাের রােড ধরে। রাস্তায় এসে যােগ দিলেন আরও বহু মানুষ। সবাই এগিয়ে চললাম। ততক্ষণে মুখে মুখে রটে গিয়েছে আমরা ওপার থেকে খবরের কাগজের রিপােরটাররা এসেছি সব দেখতে। | বেশ কিছুটা এগিয়ে থামতেই হল। রাস্তা কেটে দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবকরা, যেন খান সাহেবরা অর্থাৎ সৈন্যরা না আসতে পারে। মােহিত ভাই বললেন ঃ গােটা বাংলাদেশের রাস্তার এই অবস্থা। কেটে দেওয়া হয়েছে। বড় বড় গাছ ফেলে রাখা হয়েছে। যেন সৈন্যরা অর্থাৎ খানরা যাতে না এগােতে পারে। ছবি তুললাম। গরু ষাড় বসেছিল কিছুটা দূরে। সেখানে যাচ্ছিলেন সবাই গরু বাছুর নিয়ে। কৃষক সবাই। সাধারণ মানুষ। ওঁরা ধ্বনী দিলেন ? জয় বাঙ্গালা । বললেন ঃ সব দেখে শুনে যান। হিন্দুস্থানের রেডিওতে বলুন। খবর কাগজে ছাপুন। খানেদের জ্বালায় এখানে তাে তা হতি পারছে না।

মােহিত ভাই বললেন ঃ চলুন আওয়ামী লীগের অফিসে। হাটের মধ্যেই আওয়ামী লীগের অফিস। পতপত করে নয়া বাংলার পতাকা উড়ছে। গরুর খুরে ধূলাে উড়ছে নীচে। ধূলােয় ভরে গিয়েছে হাটের মাঠ। | বােঝাই হয়ে উঠল অফিস। ঠেলে দরওয়াজা বন্ধ করে দিলে যুবকেরা। গােটা হাট প্রায় ভেঙে চলে এসেছে। মােহিত ভাই বললেন ঃ আপনারা সবাই ভিতরে আসার চেস্টা করলেন না। জায়গা নেই। পরে মাইক লাগিয়ে আমরা সব বলব। আলাপ হল অনেকের সঙ্গে। শুনলাম সব। ওঁরা বললেন ঃ সেনাবাহিনী জেলা শহর গুলি ছেড়ে এখনও বের হতে সাহস পাচ্ছে না। মেলা শহরেও বেশীটাই ব্যারাকে থাকছে। মাঝে মাঝে বেরিয়ে এসে নিরস্ত্র  মানুষের উপর গুলি চালাচ্ছে। ওঁরা আবেদন জানালেন ঃ আপনারা আমাদের সাহায্য করুন। আপনারা আমাদের বােমা গ্রেনেড গুলি দিন। আমাদের এখন ওসব-জিনিস ভীষণ দরকার। ওদের ঘাঁটিতে গিয়ে আমরা আক্রমণ করতে চাই। একটি ছেলে এগিয়ে এল । বলল । শুনুন যশাের-খুলনার খবর। খুলনার দিকে গিয়েছিলাম খবর আনতে। এই আসছি। খুলনা-শহরে সারকিট মডিলে হাউসে] পাঞ্জাবী সেনারা ঘাটি করেছিল। লড়াই করে ওদের সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন ওরা গিয়ে জজ কোরটে আশ্রয় নিয়েছে। সেখানেও লড়াই চলছে।

বলে চলল ঃ যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্যরা কাল বিকেলে খুলনার দিকে এগােচ্ছিল। ট্রাকে ট্রাকে বােঝাই হয়ে। রাস্তায় মুক্তি ফৌজ বড় বড় গর্ত খুঁড়ে রেখেছিল । গর্তের ওপরটা কিন্তু ছিল ঢাকা। কালাে আলকাতরা মাখা কাপড় দিয়ে। যেন ওপর থেকে কিছু বোেঝা না যায়। ট্রাকগুলি এগিয়ে এল। একটার পর একটা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। মুক্তি ফৌজ আগে থেকেই খবর পেয়ে অপেক্ষা করছিল। গুলি চালাল। সব খান খতম। সব অস্ত্র দখল। ট্রাকগুলি কেবল এখনও পড়ে আছে। ওঁরা জানালেন, পুলিশ থানাগুলি থেকেই স্বাধীন বাংলার লড়াই পরিচালিত হচ্ছে। ই পি আর, আনসার, ই বি আর এবং সেনা বাহিনীর প্রাক্তন জওয়ান ও অফিসাররা লড়াইয়ে যােগ দিয়েছেন। জনসাধারণ কোনও সরকারী নির্দেশ মারছেন না। কেউ নিজস্ব অস্ত্র সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেননি। সব সরকারী অফিস বন্ধ। সবাই অস্ত্রশস্ত্র তুলে দিচ্ছেন মুক্তিফৌজের হাতে।  বেলা হয়ে এলাে। বললাম ছবি নিয়ে, খবর নিয়ে আজ রাত্রিতেই কলকাতা ফিরতে হবে। মােহিত ভাই বললেন ঃ থেকে যাবেন না! সবাই ধরে বসলেন। আমরা বললাম ঃ আজ নয়, আর এক দিন এসে থেকে যাব বাংলাদেশে। ওঁরা বললেন আচ্ছা, তাহলে তাই হােক। তবে চারটি ভাত খেয়ে যান। মােহিত ভাইয়ের বাড়িতে ভাত খেতে বসলাম। বেলা তখন প্রায় পাঁচটা। গরম ভাত এবং মুরগির ঝােল। আশ্চর্য হয়ে গেলাম মুখে ভাত দিয়েই। এ যে ঠিক সেই মুরগির ঝােল, যে ঝােল খেতাম বরিশালের স্টীমারে। গত তেইশ বছর গােটা পৃথিবীতে এই স্বাদের মুরগীর ঝােল আর খাইনি।

২৯ মার্চ, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা