ঢাকার ডাক –আসুন বাংলাদেশে
‘বাংলাদেশ থেকে বিশেষ প্রতিনিধি ‘বাংলাদেশে আজ কাউকে আমন্ত্রণ জানাবার অধিকার আমার আছে কিনা জানি না, কিন্তু সেই বাংলার একজন অখ্যাত সন্তান হয়েও আমি স্বাধিকারে বিশ্বাসী সকলকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি যে, আপনাদের মধ্যে কেউ এখন একবার পূর্ব বাংলায় আসুন। দেখে যান, সাড়ে সাত কোটি লােকের মরণ শপথ, দেখে যান দেশপ্রেমের আগুনে কী মহান আত্মাহুতি, দেখে যান অসম্পূর্ণ স্বাধীনতাকে পূর্ণতা দেবার কী দূর্জয় প্রতিজ্ঞা! কিন্তু আসবেন কী করে? আজ সারা বাংলাদেশ’ বহির্জগৎ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে। বিদেশের সঙ্গে বিমান চলাচল বন্ধ, ডাক, টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ব্যবস্থা ছিন্ন, সড়ক পথ রুদ্ধ এবং নৌপথে যাতায়াত অনিশ্চিত। কেবল মাত্র বাইরের জগতে তথ্য পরিবেশণের জন্য তারবার্তা প্রেরণের একটি মাত্র পথ খােলা আছে।
এ অবস্থায় কারাে যদি আসা সম্ভব না হয় তবে মনশ্চক্ষে পূর্ববাংলার এই আন্দোলনের একটি দৃশ্যপট কল্পনা করুন। আমি দেখিনি, কিন্তু ১৯৩০ সালের মহাত্মাগান্ধীর আইন অমান্য আন্দোলন আপনারা প্রত্যক্ষ করেছেন, দেখেছেন ১৯৪২ সালের ভারতছাড়াে’ আন্দোলনের বিরাট ব্যাপকতা। তার আগেও অনেকে প্রত্যক্ষ করেছেন ১৯২০ সালের অসহযােগ আন্দোলন। যে সকল আন্দোলনের ইতিহাস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের পাতায় অক্ষয় হয়ে আছে। সেদিনও ভারতের মুক্তিপাগল তরুণ আজকের পূর্ববাংলার তরুণদের মতই নিজেদের বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জাতির মুক্তির রক্তাক্ত স্বাক্ষর রেখে গেছেন। ভারতাত্মার অবিস্মরণীয় যে সকল শহীদবর্গ আজ পূর্ববাংলার উৎসর্গিত প্রাণকে সর্বস্বত্যাগে উদ্বোদিত করছে। কিন্তু এ সত্ত্বেও একটা কথা বলে পারছি না। ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রসারতা যতই ব্যাপক হােক না কেন, সে সকল আন্দোলনে ভারতের আপামর জনসমাজ সমভাবে শরিক হননি। জনতার এক অংশ সংশয়ে দুলেছেন, এক অংশ নিস্ক্রিয়তা অবলম্বন করেছেন, এক অংশ নিস্পৃহতা দেখিয়েছেন এবং একটা উল্লেখযােগ্য জনতা এই স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরুদ্ধাচরণ করেছেন।
কিন্তু আজ পূর্ব বাংলায় যে-কেউ এলে দেখতে পাবেন। যে,- ৭ কোটি লােক কি এক দুরুহ মন্ত্রসাধনের প্রবল বাসনায় এক ছত্রতলে এসে সমবেত হয়েছেন। এতে অংশ নিয়েছেন বালক, কিশাের, যুবক, প্রৌঢ়, বৃদ্ধ এমন কি জরাজীর্ণ স্থবির ও মৃত্যুর প্রহর গণনায় ভুল করে মানুষের অন্তহীন মিছিলে নিজেকে শরিক করেছেন। যে মুসলমান পরিবারের মেয়েরা এতদিন গৃহাভ্যন্তরে থাকতেই অভ্যস্থ ছিল, আজ তারাও ঘর ছেড়ে পথে এসে দাঁড়িয়েছে, পুরুষের পাশে পাশে লাঠি উঁচিয়ে। শােভাযাত্রায় যােগ দিয়ে বিশাল বিক্ষুব্ধ জনতার সাথে একাত্ম হয়ে সংগ্রাম চালাবার অগ্নিশপথ গ্রহণ করেছে। নগর প্রদক্ষিণ করে তারাও সমবেত কণ্ঠে গান গেয়ে চলেছে,- “আমার সােনার বাংলা আমি তােমায় ভালবাসি।’ ঢাকা বেতার কেন্দ্র, টেলিভিশন ও হাজার সভাসমিতি দিনের পর দিন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অমর গান গেয়ে চলেছে।
ধনধান্যে পুষ্পে ভরা আমাদেরই বসুন্ধরা, তারি মাঝে আছে, যে সে সকল দেশের সেরা, সে যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরী সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা। এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি । এছাড়া অজ ঢাকার অলিতে গলিতে শুনতে পাওয়া যাবে অতুল প্রসাদের গান, শুনতে পাওয়া যাবে রঙ্গলালের অমর দেশাত্মবােধক কবিতার আবৃত্তি স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিয়ে চায়, শুনতে পাওয়া যাবে নজরুলের বিদ্রোহী’ কবিতার বলিষ্ঠ হাজার তরুণপ্রাণের জীবনােৎসর্গের শুরু দিয়ে এই মহান আন্দোলনের মহাযাত্রা শুরু হয়েছে। পূর্ববাংলার ৭ কোটি মানুষ এই আন্দোলনের জীবনপতাকা বয়ে নিয়ে চলেছে এক নব তীর্থে পৌছুতে। তাদের যাত্রা স্বল্প কিংবা দীর্ঘ তা কেউ বলতে পারেনা। তবে ঈপ্সিত বস্তু লাভের পুর্বে এযাত্রায় যে বিরাম ঘটবেনা তা সুনিশ্চিত। “আমার সােনার বাংলা” গানটিই যে ভবিষ্যতে “বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত বলে স্বীকৃতি লাভ করবে তাতে কিছুমাত্র সংশয় নেই। আজ দশদিন ধরে পূর্ববাংলার কোন সরকারী অফিসে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়ছে না। তার পরিবর্তে উড়ছে কালাে নিশান। হাজার হাজার গাড়ী-ঘােড়া ঐ কালাে নিশান উড়িয়ে ঘােরাফেরা করছে। ঢাকার ১৬ হাজার সাইকেল রিক্সার উপরেও ঐ একই নিশান। সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর দৃশ্য, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস’ এর সৈন্যবাহী। ট্রাকগুলােও ঐ কালাে নিশান উড়িয়ে ছােটাছুটি করছে। ঢাকার বেতার কেন্দ্র থেকে ঘােষক আজ আর রেডিও পাকিস্তান ঢাকা’ বলছেন না, তার পরিবর্তে তার কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হচ্ছে , ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’। আজ রেডিও টেলিভিশনে ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ দিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হয় না।
১৬ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা