You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.28 | রাজ্য-রাজনীতি বাংলাদেশের সমস্যা পশ্চিমবঙ্গেরও সমস্যা/কিন্তু প্রতিকার কী -বরুণ সেনগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

রাজ্য-রাজনীতি বাংলাদেশের সমস্যা পশ্চিমবঙ্গেরও সমস্যা/কিন্তু প্রতিকার কী

–বরুণ সেনগুপ্ত

বাংলাদেশের সমস্যা আজ পশ্চিমবঙ্গেরও সমস্যা, কারণ, বাংলাদেশে এখন যা কিছু ঘটছে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব সরাসরি ভাবে এই দেশের উপরও পড়ছে। পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির উপর বাংলাদেশের সমস্যার প্রচণ্ড চাপ ইতিমধ্যেই পড়েছে। এই চাপ দিন দিনই বাড়বে। এর সঙ্গে সঙ্গেই আসছে আমাদের আইন ও শৃঙ্খলা এবং সামাজিক পরিস্থিতির উপর বাংলাদেশের সমস্যার চাপ। শরণার্থী আগমন যত বৃদ্ধি পাবে এই চাপও ততই বাড়বে। তারপরই আসবে আমাদের রাজনীতির উপর বাংলাদেশের সমস্যার চাপ। এই সব চাপের ফলে পশ্চিমবঙ্গের অবস্থা শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াবে বলা কঠিন। তবে এটা বােঝা যাচ্ছে যে, অবিলম্বে বাংলাদেশের সমস্যার সুরাহা না হলে পশ্চিমবঙ্গের প্রায় ভেঙ্গে-পড়া অর্থনীতি ও রাজনীতি   একেবারেই ভেঙ্গে পড়বে। | বাংলাদেশের সমস্যার প্রভাব নানাভাবে গােটা ভারতের উপরই পড়বে। কিন্তু যে ভাবে তা পশ্চিমবঙ্গের উপর, পূর্ব ভারতের সীমান্তবর্তী চারটি রাজ্যের উপর পড়ছে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের উপর ঠিক তেমনভাবে পড়বে না। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় এবং ত্রিপুরার উপর বাংলাদেশের সমস্যার প্রথম ধাক্কাটা। এসে পড়ছে। কারণ এগুলি বাংলাদেশের সীমান্ত রাজ্য। এরমধ্যে আবার সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা এসেছে পশ্চিম বঙ্গের উপর। কারণ, বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তই সবচেয়ে দীর্ঘ এবং সমতল। পশ্চিম বাংলার মানুষ তাই স্বভাবতই পূর্ববাংলা অর্থাৎ বাংলাদেশের ব্যাপার নিয়ে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের লােকের চেয়ে বেশি চিন্তিত।

এর উপর তাে আছে আত্মিক যােগের প্রশ্ন। একভাষা, মােটামুটি একই সংস্কৃতি, একই ঐতিহ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রত্যক্ষ কোনও প্রভাব এসে না পড়লেও পশ্চিম বাংলার মানুষ পূর্ব বাংলার মানুষের কথা বেশি করে ভাবতই। নানা কারণে তাই আমরা আজ বিশেষভাবে জানতে ব্যগ্র, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনা প্রবাহের পরিণতি কী হতে পারে? এবং তার প্রভাব আমাদের উপর কীভাবে এসে পড়তে পারে? প্রথমেই এ জিনিসটা আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া উচিত যে, যদি বাইরে থেকে সক্রিয় সমর্থন না পান তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে পাক সামরিক কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে চূড়ান্তভাবে জয়ী। হওয়া প্রায় অসম্ভব। যদি কখনও তেমন একক জয় সম্ভব হয়ও তা হলেও দু-চার বছরের মধ্যে তা হতে পারে।

সে জয় হতে বহুদিন লাগবে। পাক সেনাবাহিনী নির্দয়। তারা পৃথিবীর যে কোন বর্বর খুনে বাহিনীর চেয়েও বেশি বর্বর। তারা আধুনিক অস্ত্রে বলীয়ান। তারা জনমতের ধার ধারে না। তারা পূর্ব বাংলার মানুষের মন জয় করতেও উৎসাহী নয় । তারা হাজারে মানুষ খুন করতে সামান্যও কুণ্ঠিত নয়। এই রকম একটা সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালানােও সহজ নয়। বিশেষ করে বাঙালীর পক্ষে জাতিগতভাবে গেরিলা যুদ্ধ বা সম্মুখ সমর। চালাবার অভিজ্ঞতা গত দু-শ বছরের মধ্যে যার নেই বললেই চলে। মুক্তিবহিনী পাক সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ চালাতে গেলেও দুটো জিনিস তার চাইই। (এক) নিয়মিত অস্ত্র গােরাবারুদ সরবরাহ । (দুই) পাক সেনাবাহিনীর নাগালের বাইরে একটা নিরাপদ  আশ্রয়। এই দুটো জিনিসের জন্যই মুক্তিবাহিনীর বাইরের সমর্থন চাই।। | দ্বিতীয়ত গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে পাক বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করা গেলেও ওইভাবে তাকে চট করে ক্যান্টনমেন্ট বা ঘাটি থেকে বিতাড়িত করা যাবে না। সেজন্য চাই ভারী অস্ত্র এবং বিমান না হলেও নিদেনপক্ষে বিমানবিধ্বংসী কামান বা রকেট। আর চাই সম্মুখ সমরে নামার ক্ষমতা। অর্থাৎ, পাক বাহিনীর চেয়ে বেশি সেনাবল এবং পাকবাহিনীর হাতে যে সব অস্ত্র আছে তার চেয়ে বেশি ক্ষমতার না হলেও অন্তত সমকক্ষ অস্ত্রশস্ত্র ।

কোন বড় রাষ্ট্র খােলাখুলিভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে না এলে এসব জিনিস সংগ্রহ করা বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। | সুতরাং, গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে পাকবাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত রাখতে গেলেও মুক্তিবাহিনীর বাইরের সাহায্য চাই; আবার, সম্মুখ সমরে নেমে তাদের ঘাঁটি থেকে উচ্ছেদ করে পূর্ববাংলা ছাড়া করতে গেলেও বাইরের সাহায্য চাই। দুটো সাহায্যে আবার কতকগুলি পার্থক্য আছে। যেমন, গেরিলা যুদ্ধে প্রয়ােজনীয় সাহায্য গােপনে দেওয়া গেলেও সম্মুখ সমরে প্রয়ােজনীয় সাহায্য খােলাখুলিভাবে ছাড়া অন্য কোনওভাবে দেওয়া যায় না। আরও একটা জিনিস আছে। প্রতিবেশী কোনও রাষ্ট্র-ছাড়া অর্থাৎ যার সঙ্গে সীমান্তের যােগাযােগ আছে, সে ছাড়া অন্য কেউ এসব সাহায্য দিতেও পারে না। পূর্ব বাংলার সঙ্গে সীমান্তের যােগাযােগ আছে একমাত্র ভারতের; আর সামান্য কয়েকমাইল এলাকায় বর্ষায় জলপথে তা আনতে গেলে সমুদ্রতটে অন্তত কিছুটা সুরক্ষিত অঞ্চল থাকা চাই। তেমন কোনও সুরক্ষিত এলাকা এখন বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে নেই।  তাই, এখন ভারত ছাড়া বা ভারতের সক্রিয় সহযােগিতা ছাড়া আর কারাে পক্ষে মুক্তিযােদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে প্রয়ােজনীয় সমর্থন দেওয়া সম্ভব নয়। ভারত সরকার দুভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে করতে পারেন। (এক) দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করতে পারেন। এবং (দুই) পাক বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে খােলাখুলিভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনে নামতে পারেন।  যদি শুধু দীর্ঘমেয়াদী গেরিলা যুদ্ধের জন্য ভারত সরকার ওদের সমর্থন করেন তা হলে দুটো দায়িত্বই তাঁকে নিতে হবে। প্রথমত, মুক্তি বাহিনীর জন্য প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং দ্বিতীয়ত, যতদিন ওই গেরিলা যুদ্ধ চলবে ততদিন অন্তত এক কোটি শরণার্থীর জন্য এখানে। অন্নবস্ত্র বাসস্থান জোগাতে হবে। কারণ, যতদিন পূর্ববাংলার খান-সেনারা থাকবে এবং যতদিন ওখানে। গেরিলা যুদ্ধের ভয়াবহতা চলবে ততদিন শরণার্থী আগমনও বন্ধ হবে না, আগত শরণার্থীরাও ফিরে যাবে না।

আর, যদি দ্বিতীয় পথে এগােতে চান তাহলে ভারত সরকারকে পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি লড়াইয়ে নামার ঝুঁকি নিতে হবে। সে লড়াই শুধু পূর্বে সীমাবদ্ধ থাকবে না, সে লড়াই পশ্চিম সীমান্তেও হবেই। এবং যে লড়াইয়ের সময় চীন উত্তর সীমান্তে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে না নামুক চাপ সৃষ্টি করবেই।নানাকারণে ভারত সরকার এখনই দুই নম্বর পথে এগােতে চান-না। অর্থাৎ পুরােপুরি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে। অনিচ্ছুক। একটি কারণ সরকার মনে করেন যে, তাতে বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের প্রশ্ন থেকে সরে গিয়ে ভারতপাকিস্তান সংঘর্ষের দিকেই বেশি পড়বে। ফলে, বাংলাদেশের ক্ষতি হবে। আর একটি কারণ, ভারত সরকার আশা করেন যে, বিশ্বের বিভিন্ন বড় রাষ্ট্রের চাপে এবং গেরিলা-যুদ্ধউদ্ভুত নিজস্ব অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশ সমস্যার একটা কোনও রাজনৈতিক সমাধানে রাজী হবে। এবং তারপর শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে পারবেন। প্রধানত এই দুই বিশ্লেষণের উপর ভিত্তি করেই ভারত সরকার তার বাংলাদেশ সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণ করেছিন বলে মনে হয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, ভারত সরকারের এই বিশ্লেষণ খুব বাস্তব নয়।

প্রথমত বিশ্ববাসী বাংলাদেশের ঘটনাবলী জানলেও বিশ্বের বড় বড় রাষ্ট্রগুলি এখনও পাকিস্তানকে চটিয়ে বাংলাদেশকে কোনও ভাবে সাহায্য করতে আগ্রহী নন। এই ব্যাপারে ডিগ্রীর তফাত থাকলেও ব্রিটিশ,  মারকিন এবং রূশ মনােভাব মূলত একই। বাংলাদেশের ঘনাবলীকে তারা নিজ নিজ স্বার্থে এখনও পাকিস্তানের নিজস্ব অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসাবেই দেখছেন। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে সাহায্য করতে এগিয়ে আসছেন চীন, মারকিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন। সুতরাং অর্থনৈতিক সংকটে পড়লেও পাকিস্তান এখনই অর্থনৈতিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে না। তৃতীয়ত, পাকিস্তান আরও বেশি চীনের দিকে চলে যাবে এই ভয়ে এবং নিজ নিজ অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থে মারকিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন ও রাশিয়া বাংলাদেশের ব্যাপারে পাক সরকারের উপর বড় কোন চাপ দিতে অনিচ্ছুক। চতুর্থত, পাকিস্তান সরকার বিভিন্ন বড়রাষ্ট্রের মনােভাব বুঝে আরও বেশি বেশি করে শরণার্থী ভারতে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে। | এই নতুন পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের সামনে এখন দুটি মাত্র পথ আছে ? হয় মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনে খােলাখুলিভাবে এগিয়ে যাওয়া আর না হয় কোটিখানেক শরণার্থী নিয়ে বিরাট বিশাল সংকটে দীর্ঘকাল হাবুডুবু খাওয়া এবং কিছু একটা সুরাহা হওয়ার আশায় বসে থাকা। | কোন্ পথে এগােবেন, ভারত সরকারকে তা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্থির করতে হবে।

২৮ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা