গেরিলা যুদ্ধ আন্তর্জাতিক আইনে বৈধ
— ইন্দ্রনীল
বাংলাদেশে এখন গেরিলা যুদ্ধ চলেছে। বাংলাদেশ বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানের হানাদারদের বিরুদ্ধে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। গেরিলা আক্রমণের ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে প্রচুর। আন্তর্জাতিক আইনে গেরিলা যুদ্ধ অবৈধ নয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জারমানি অধিকৃত ইউরােপের বিভিন্ন দেশে স্বাধীনতাকামীরা গেরিলাযুদ্ধ চালিয়েছিলেন দীর্ঘ দিন ধরে। অধিকৃত ফ্রানসে চারলস দ্য গ্যল যে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তা গেরিলা লড়াই ছাড়া আর কিছুই নয়। গেরিলা যুদ্ধের সাহায্যে যে একটা সুসংগঠিত ও আধুনিক অস্ত্র সজ্জিত সেনাদলকে ব্যতিব্যস্ত ও শেষ পর্যন্ত বিপর্যস্ত করা সম্ভব, বর্তমান যুগে একাধিক দেশে তা প্রমাণিত হয়েছে। গেরিলা যুদ্ধের সাহায্যে দেশের স্বাধীনতা অর্জনও যে সম্ভব আলজিরিয়া ও অন্যত্র তা প্রমাণিত হয়েছে। আলজিরিয়ার মুক্তি যােদ্ধারা ফ্রানসের বিরুদ্ধে দীর্ঘ ৮ বছর গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে আলজিরিয়ার স্বাধীনতা অর্জন করেন। এজন্য তাদের মূল্য দিতে হয়েছিল প্রচুর। ৮ বছর ধরে লড়াই চালাতে গিয়ে আলজিরিয়ার আড়াই লক্ষ মুক্তি যােদ্ধা প্রাণ হারান।
সুসংগঠিত শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধের উপযােগিতা এদেশে সর্বপ্রথম প্রমাণ করেন ছত্রপতি শিবাজী। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত তাঁর গেরিলা বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে প্রতিপক্ষের সুসংগঠিত শক্তিশালী সেনা বাহিনীকে শেষ পর্যন্ত নতি স্বীকার করতে হয়েছিল। প্রধানত গেরিলা কায়দায় লড়াই চালিয়ে শিবাজী এক স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করেছিলেন। গেরিলা যুদ্ধের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বিখ্যাত আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞ ওপেনহাইম বলেছেন, গেরিলা যােদ্ধারা সুসংগঠিত সেনা বহিনীর অংশ নয়। শত্রু অধিকৃত এলাকায় তারা বিক্ষিপ্ত ও চোরা গােপ্তাভাবে লড়াই চালায়। সাধারণত অধিকৃত দেশে পরাজিত সেনা দলের অংশ বিশেষকে নিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করা হয়। অধিকৃত অঞ্চলের জনসাধারণও স্বাধীনতা অর্জনের জন্য গেরিলা বাহিনী গঠন করতে পারেন। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে যুদ্ধ সংক্রান্ত হেগ চুক্তিতে অনিয়মিত সেনাবাহিনীর ক্ষেত্রে যে সব নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করা হয়েছে, গেরিলা যােদ্ধারা যদি তা মেনে চলেন, তাহলে তারা যুদ্ধরত দেশের।
সেনাবাহিনীর সমান মর্যাদা পাওয়ার অধিকারী। বন্দী হলে তাদের বিচার করতে হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত বিভিন্ন আদালত এই নীতি মেনে নেন। কোন নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে যদি দেখা যায় যে, গেরিলারা হেগ চুক্তির নিয়ম কানুন মেনে চলেনি তবুও বন্দী অবস্থায় তারা নিয়মিতভাবে গঠিত আদালতে বিচারের জন্য দাবি জানাতে পারেন। যে সব ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নিয়ম কানুন অনুযায়ী গঠিত সরকারের নির্দেশে গেরিলা যােদ্ধারা প্রতিরােধ আন্দোলন ও লড়াই চালান, সে সব ক্ষেত্রে হেগ চুক্তির নিয়ম কানুন বিশেষভাবে প্রযােজ্য। ১৮৯৯ সালে হেগ সম্মেলনে গেরিলা যুদ্ধ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল কিন্তু বর্তমান যুগে পরিবর্তিত অবস্থায় গেরিলা যুদ্ধকে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে স্থানীয় জনগনের প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার অধিকার স্বীকার করে নিয়ে আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে; দখলদার বাহিনীর কর্তৃত্ব যখন আর অবিসম্বাদিত থাকে না, তখন প্রতিরােধ আন্দোলনের বৈধতা স্বীকার করে নিতে হয়। বর্তমানে সাঁজোয়া বাহিনী ঝটিকা বেগে এগিয়ে এসে কোন একটা দেশের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নিতে পারে কিন্তু সেখানে তারা তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। সেখানকার স্থানীয় অধিবাসীদের বৈধ প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার যথেষ্ট সুযােগ সুবিধা থেকে যায়। এইসব কারণে ১৯৪৯ সালে গৃহীত হেগ চুক্তির চার অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নিয়মিত বাহিনীর অংশ নয় এমন আধা সামরিক ও স্বেচ্ছাসেনাবাহিনী এবং সংঘর্ষে লিপ্ত কোন পক্ষের সুসংগঠিত প্রতিরােধ বাহিনীর সেনারা যদি অধিকৃত এলাকার ভিতরে বা বাইরে তৎপরতা চালিয়ে বন্দী হয় তাহলে তাদের যুদ্ধ বন্দীর মর্যাদা দিতে হবে। অবশ্য তাদের দায়িত্বশীল ব্যক্তির নির্দেশে যুদ্ধের নিয়ম কানুন অনুযায়ী যুদ্ধ চালাতে হবে।
দখলদার কর্তৃপক্ষ যদি গেরিলা যােদ্ধাদের উপর অকথ্য নিষ্ঠুর অত্যাচার চালায় তাহলে তারা যুদ্ধপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবে। গেরিলা যােদ্ধারাও যদি প্রতিপক্ষের উপর অত্যাচার চালায় তাহলে তারাও ঐ একই অপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবে। দখলদার কর্তৃপক্ষ যদি অধিকৃত এলাকার বেপােরােয়াভাবে নিষ্ঠুর অত্যচার চালিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে তাহলে তারা যুদ্ধপরাধে অপরাধী বলে গণ্য হবে। যুদ্ধপরাধের বিচারের জন্য গঠিত বিভিন্ন ট্রাইব্যুনাল এই ব্যাপারে একমত হন। | বাংলাদেশে গেরিলাযােদ্ধাদের প্রতি জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়া খার সেনারা সভ্য সমাজ অনুমােদিত আচরণ করবে, এ আশা দুরাশা। | ইয়াহিয়া খাঁর বর্বর সেনারা বাংলাদেশের অসামরিক জনগণ ও গেরিলা যােদ্ধাদের উপর যত অত্যাচারই চালাক না কেন, বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলছে ও চলবে। এবং তাতে জয়লাভও সুনিশ্চিত। আজ অথবা কাল হানাদাররা বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবে। সােনার বাংলা স্বাধীন হবে।
২৭ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা