জাতীয়তার জয়
“জয় বাংলা”
–বিশেষ প্রতিনিধি
প্রশ্নটা অনেকেই তুলেছিলেন। তবু বিশেষ করে আজ মনে পড়ছে টয়েনবির কথা। কারণ আর সকলে রাজনীতিক, আরনলড টয়েনবির ঐতিহাসিক হিসাবেই তিনি বলেছিলেন- পাকিস্তান এক দুরুহ পরীক্ষা। কারণ-ভুগােল। কারণ- ইতিহাস-ঐক্যসূত্র হিসাবে ধর্ম কি চিরকাল সমান মজবুত থাকবে। | তেইশ বছর পরে এই প্রশ্নে উত্তর দিয়েছে পাকিস্তান নিজেই। না, ধর্ম শেষ কথা নয়। তার চেয়ে অনেক, অনেক প্রবল- স্বাধীনতা, জাতীয়তা। পূর্ব পাকিস্তানের নাম আজ- “বাংলাদেশ।” মুখে তার ধ্বনি- “জয় বাংলা।” তার কবির গান- “আমার মায়ের সােনার নােলক হারিয়ে গেল শেষে/হেযায় খুঁজি হােথায় খুঁজি সারা বাংলাদেশে।”
রূপান্তর না-বলে বলা চলে- যুগান্তর মাত্র তেইশ বছরে এই যুগান্তর কী ভাবে সম্ভব হল তা নিয়ে আজ আর গবেষণার প্রয়ােজন নেই। আমেরিকায় যারা উপনিবেশ স্থাপন করেছিলেন তাঁরা ব্রিটেনের আপন সন্তান। তারাও কিন্তু মাতৃভূমির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছিলেন। কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়াও আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। আর পূর্ব পাকিস্তান? পশ্চিমের সঙ্গে দেড় হাজার মাইলের দুরতুই দুই পাকিস্তানের মধ্যে একমাত্র ব্যবধান নয়। জাতি, ভাষা, অর্থনীতি- সব কিছুতেই দুই আলাদা। শুধু ধর্মই যদি এই দুইকে এক রাখতে পারত, তবে মধ্যপ্রাচ্যেও নিশ্চয়ই মানচিত্র অন্যরকম চেহারা লাভ করত। অন্তত আফগানিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান এক হতে কোন বাধা ছিল না। কিন্তু ইতিহাসের পাঠক জানেন, সবার উপরে সত্য- জননী জন্মভূমি। আর মায়ের আর এক নাম মাতৃভাষা।
পূর্ব বাংলার জাতীয়তা এই মাটি আর মুখের ভাষাকে ঘিরেই অঙ্কুরিত। বদরুদ্দীন ও(উমর যাকে বলেছেন, “বাঙালী মুসলমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন”- সেই ঐতিহাসিক ঘটনায় অবশ্য পাথেয় জুগিয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের আচরণ । পিয়াসন কমিশনও স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন- দুই খণ্ডের সম্পর্ক কার্যত শাসক এবং শাসিতের। পূর্ব বাংলা পশ্চিমের কাছে কামধেনু মাত্র দুইয়ের স্বাস্থ্যে বিস্তর পার্থক্য। পার্থক্য লক্ষ্যেও। অতএব শেষ পর্যন্ত অনিবার্যই ঘটেছে- বিদ্রোহ। জীবনানন্দকে স্মরণ করেছেন ঢাকার তরুণ দল“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি।” মায়ের রক্তশূণ্য এই মুখের দিকে তাকিয়েই পূর্ব বাংলার চোখে আজ আগুন।
ফরাসী বিপ্লবের মানসিক পরিমণ্ডল সৃষ্টিতে সহায়ক হয়েছিলেন দেশের লেখকরা। বাংলা তথা ভারতের জাতীয় আন্দোলনের আগে নবজাগরণের হাওয়া রয়েছে মনে মনে। পূর্ব বাংলায়ও তাই ঘটেছে। এই যুগান্তরের পেছনে যেমন আছে আর্থিক কারণ সমূহ, তেমনই রয়েছে পাকা সাংস্কৃতিক বনিয়াদ। বাকি ছিল শুধু একটি রাজনৈতিক শ্লোগান। আওয়ামীলীগ আর তার ছয় দফা-ই পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা তীরে সেই “বন্দে মাতরম ।” পূর্বের চেতনায় পুরানাে ঐতিহ্যও সমান ক্রিয়াশীল। | যাদের হুকুমে একদা বাদশাহদের ক্রমাগত হঠতে হয়েছে সেই বারাে ভুইঞার নজির টানব না। মুজিবর ইশা খান নন, তিনি গণনায়ক,- পূর্ববংলার হৃদয়ের বাদশা। লড়াইয়ের ভঙ্গীতে তিনি প্রমাণ করেছেন, রাজনীতিক হিসাবেও তিনি ঐতিহাসিক পুরুষ। তিনি বন থেকে বেরিয়ে এসে হঠাৎ সােনার টোপর মাথায় দিয়ে বসেননি, কোন বাঁকা পথে পা বাড়াননি- গণতন্ত্রের সরল রাস্তায় ক্ষমতায় এসে পৌঁছেছেন। ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্রকে তিনি যেভাবে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে সম্ভবত তা তুলনাহীন। গান্ধীজীর অসহযােগও এই চেহারা নিতে পারেনি। অবশ্য তার লক্ষও ছিল ভিন্ন। তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন গােলাম খানা থেকে বের হয়ে আসতে,- মুজিবরের ডাক- গােলামখানাকেই স্বাধীনতার মঞ্জিলে পরিণত কর। এভাবে ক্ষমতা দখলের একমাত্র নজির বােধহয় তিনিই। কী করবেন এবার ইয়াহিয়া খান? যুদ্ধ সামরিক বলে অন্যদেশ দখলের নজির অবশ্যই আছে। কিন্তু যুদ্ধ সামরিক বলে পরদেশ দখলে রাখার কোনও নজির একালের পৃথিবীতে নেই। বিশেষত এমন-দেশে, যেখানে সাত কোটি পঞ্চাশ লক্ষ মানুষের প্রত্যেকেই এক একজন মুজিবর রহমান।
১৬ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা