ভারত যেন না ভােলে
— সন্তোষকুমার ঘােষ
বাংলাদেশের বিষয়ে ভারতীয় সংসদ সহবেদনাতুর একটা প্রস্তাব পাশ করেছিল কবে? খানশাহী “মারয়, মারয়, উচাটয়, উচাটয়” বলে যখন ঝাপিয়ে পড়ে, মনে পড়ছে সেই প্রথম প্রহরে। তারপর ওই সংসদেই। প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রধান ঘােষণা দিয়ে যেন মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় মাস উদ্যাপিত হল। “বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান চাই … শক্তিধর রাষ্ট্রগুলির দয়িত্ব অনেকখানি-” খবরের কাগজের চমৎকার শিরােনামা, একটি দৃপ্ত ভাষণের অত্যন্ত সমীচীন মুখবন্ধ। তার বেশি কিছু না। বাংলাদেশ যে রুধিরে পঙ্কে, নিরাশার অন্ধকারে। নিমজ্জিত ছিল, সেখানেই থেকে গেল। না স্পষ্ট প্রধানমন্ত্রীর উক্তি, না তাঁর ভাষা নীতি। আশুকরণীয় বা অনুসরণীয় কোনও পন্থার কিছুমাত্র ইঙ্গিত পাওয়া গেল না।
রাজনৈতিক সমাধান- শুনতে অতীব উত্তম। কিন্তু ইন্দিরাজী নতুন কোনও কথা বলছেন কি? রাজনৈতিক সমাধান হাতের কাছেই ছিল, একটি দল ভােট এবং আসন উভয়ই অশ্রুতপূর্ব গরিষ্ঠতা পেয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানী শাসক দল তাকে দু-পায়ে দলন করেছে। ইতিহাসে এই ধৃষ্ট বিশ্বাসঘাতকতায় নজির বেশি নেই, খুব সম্ভব আদৌ নেই। এর পরেও রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা মাঝখানের দুই মাসের বীভৎস অত্যাচারকে একেবারে ভুলে যাওয়া। সমাধান কার সঙ্গে? একহাতে যেমন তালি বাজে না, এক তরফা হাত ধরাধরিও হয় না। আসর কথা, বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাধবে কে? প্রধানমন্ত্রী সেই কথাটা এড়িয়ে গিয়েছেন। তার আর যত কথা তা শুধু আশা আর আশ্বাসের কথা- তাতে নতুন করে আর অলীক ধূমজাল রচিত হবে। । বিশ্ববিবেক জাগ্রত হবে? সেই সম্ভাবনা, হায়, আজ হ্যামলেটের ভাষায় “এ কনসামেশান ডিভাউটলি টু বি উইশড”। সাত মণ তেল পুড়বে না। পােড়ার হলে এতদিনে পুড়ত। ইতিমধ্যে বরং পুড়ে ছাই হতে চলেছে সাড়ে সাত কোটি মানুষের অদৃষ্ট- গণনাতীত গণহত্যার পরে সাড়ে সাত আর সাড়ে সাত আছে কিনা জানিনা। ওপার বাংলা ভরে গেছে নিহতের স্কুপে, এপার বাংলা লক্ষ শরণাগতে। নির্বিবেক বিশ্ব অম্লান মুখে চেয়ে দেখছে।
বৃথাই প্রধানমন্ত্রী এই অস্তিত্ববিহীন বিবেক বস্তুটার দোহাই পেড়েছেন। বিবেক-টিবেক যা কিছু বাঁধা আছে বাঘা বাঘা রাষ্ট্রগুলির কাছে। একটি একটি করে দেখা যাক। তাসখন্দের সময়ে যে রাশিয়ার মাতব্বরির সীমা ছিল না, আজ কোথায় সে? গােড়ার দিকে বার কয়েক নাক ডাকিয়েই সােভিয়েত ঝুমিয়ে পড়েছে। তার নাসিকা গর্জনকেই আমরা জাগরণ ভেবে ভুল করেছিলাম। আমেরিকা? নৈতিক দায় এই তথাকথিত “ফ্রি ওয়ারলডের” আপনি মােড়লের ছিল সবচেয়ে বেশি। কেননা যিনি যাই বলুন, অনুমাত্র সন্দেহ নেই যে, আমেরিকা একদা আওয়ামী নেতৃত্বের কানে বিস্তর মন্ত্র জপেছে অন্তত ভরসার ছাতা জুগিয়েছে। সেই ছাতা ঝটপট বন্ধ হয়ে গেল। এও সম্ভব যে, ইয়াহিয়ার চতুর চালে আমেরিকা নিজেও বােকা বনে গেছে। নিজে মজে অন্যকেও মজানের এমন নমুনা ডিপ্লোমেটিক ইতিহাসে বেশি লেখেনা।
একমাত্র চীনের নীতিই মনে হয় সােজাসুজি। তাতে আদর্শবাদ যদি নাও থাকে, বাস্তববাদ আছে। সেই বাস্তববাদের নাম হল ভূগােলভিত্তিক রাজনীতি। তাতে ভাওতা নেই, ভেজালও অল্প। পাকিস্তানের দুটো ভাগকেই চীনের হাতে রাখা চাই, তার কারণ ওই মুলুকের ভৌগােলিক অবস্থিতি। পশ্চিম পাকিস্তান আফ্রিকা। আর ইউরােপের নিকটতর, বস্তুত সে মধ্য প্রাচ্যেরই অংশ। তার প্রমাণ সেন্টাচুক্তি। উপরােক্ত রাশিয়ার সঙ্গে বর্তমান বিরােধে পশ্চিম পাক মুলুকের ভৌগােলিক অবস্থিতির দাম চীনের চোখে আরও বেড়ে গেছে ওই এলাকায় রুশ আর চীন পরস্পরের খুব কাছাকাছি। পাক কবলিত কাশ্মীরের মানচিত্র স্মরণ করলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হবে। রফতানি ব্যবসার জন্য করাচি বন্দর ব্যবহারের সুবিধাও চীনের দরকার। পূর্ব বঙ্গের উপরেও তার নজর আছে বৈকি, তবে যতদিন ওখানকার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে, ততদিন মুক্তিযুদ্ধকে সে নেকনজরে দেখবে না। এসপার ওসপার একটা কিছু হয়ে যাক, পরের বিবেচনা পরে। এখন আসল। প্রতিযােগিতা তার মারকিনের সঙ্গে, পিন্ডির মন নিয়ে। এই প্রতিযােগিতায় হালে আবার ভয়ের ভাগ কিছু কমেছে- গােটা পাঞ্জা কষাকষিটা চলছে পিংপং খেলার স্পােরটিং স্টাইলে। এই পাশাখেলায় বাংলাদেশ নামে দ্রৌপদীর ইজ্জত বিকিয়ে গেছে। | তবু চীনের তারিফ করি এই কারণে যে হাতে তাস নিয়ে “আঠারাে? আছি,” “উনিশ? আছি” দিব্যি জোর গলায় একমাত্র সেই বলছে। আর এই আণবিক ভীতির ভারসাম্যের যুগে গলাবাজিই তাে আসল, যে যতদূর যেতে পারে। তার বেশি কেউ এগােয় না। চীনেরও এই চমৎকার নীত দিব্যি ডিভিডেনট দিচ্ছে। | নীতি স্থির ইয়হিয়া চক্রেরও, তথা পশ্চিম পাকিস্তানের। ইয়াহিয়া ততদিন শেখ সাহেবকে আলাপের অছিলায় ভুলিয়ে রেখেছেন, যতদিন তিন সাগর পেরিয়ে নতুন ফৌজ আর রসদ এসে না পৌছােয়।
তারপর মধ্যরাত্রে একদিন জঙ্গীশাহীর চণ্ডরূপ মার মার মূর্তি-স্ট্রাইক, স্ট্রাইক।’ শুরু হয়ে গেল হনন, ধর্ষণ, লুণ্ঠন‘অপারেশন ম্যাসাকার।’ মনে হয় বিশ্ববিবেকের ব্যাপারটা ইয়াহিয়া জানতেন, অন্তত আমাদের অনেকের চেয়ে বেশী জানতেন। শুধু তিনি জানতেন না প্রতিরােধ কী প্রবল রূপ নেবে। প্রথম দিন দশেক তাই খান সেনা গুটিয়ে গেল, লুকিয়ে পড়ল শহর গ্রাম ছেড়ে বিবরে, বিবরে, তাদের শক্ত ঘাটি ছাউনির পর ছাউনিতে। আজ যারা হাসছেন, পরম পাকার মতাে মাথা নেড়ে নেড়ে বলছেন, ‘জানতাম এ হবেই, এ টিকবে না’, তারা জেনে তাে রাখুন, সেদিন পূর্ববঙ্গের বৃহত্তর ভাগ সত্যই মুক্ত ছিল। চাকা ঘুরেছে যেদিন খান সেনা চাঁদপুরে আর গােয়লন্দে নতুন ফৌজ আর রসদ নামাতে পেরেছে সেদিন থেকে। আজ রণনীতির পণ্ডিতী বিশ্লেষণ মানায় না, অতিরঞ্জন সম্পর্কে কটাক্ষও সাজেনা। যুদ্ধ যে দিকেই মােড় নিয়ে থাকুক, তাতে একটি বিদেশীপ্রায় শাসককুলের কোনও তাত্ত্বিক পুঁথি মাফিক আসুক বা না আসুক স্বাধীনতার জন্য এই সর্বপণ সত্য আগ্রহ অতীতের ভূলভ্রান্তি স্বীকার করুক বা না করুক। যতটুকু শুদ্ধি ঘটেছে তাই ঢের, যা এখনও ঘটেনি তা নিয়ে অনুযােগ আর অভিযােগ শুধু ছুতাে এবং আত্মছলনা। পূর্ব পুরুষের পাপ সন্তানে বর্তায় না। তাছাড়া সন্তানেরা তাে রক্তদিয়ে প্রায়শ্চিত্ত করছে।
আর নীতি নিরূপত হয়েও অনিশ্চিত একমাত্র ভারতের। কী উচিত সে জানে, কী না করে উপায় নেই। তাও জানা আছে তার, তবু হাত সরছে না। অপেক্ষা, কীসের অপেক্ষা? কবে দুনিয়ার কে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে, অপেক্ষা কি তার? কিন্তু অন্য কোনও দেশ তাে আমাদের মতাে কোমরজর অবধি ডুবে যায়নি, ইংরাজিতে “ইনভলভড় হওয়া যাকে বলে। তাদের সময় আছে, আমাদের নেই। আমরা যদি বা অপেক্ষা করি, ওপারের লক্ষ লক্ষ আর্ত মানুষ করবে না। জঙ্গীশাহীর অর্থনীতি কবে যুদ্ধদানবের খােরাক মেটাতে মেটাতে একেবারে দেউলে হয়ে যাবে, এখন কি প্রতিক্ষা তারই? নিতান্ত দুরাশা। তার আগে শরণাগতের চাপে আমাদের অর্থনীতিও পিষ্ট হয়ে যাবে। অর্থাৎ প্রত্যেক্ষভাবে যুদ্ধ যদি নাও চাই, পরােক্ষভাবে তার দায়, তার ব্যয় আমাদের উপর পড়ছেই। দাউ দাউ করে জ্বলছে না, ধিকিধিকি। পুড়ছে সেই কি একমাত্র সান্ত্বনা? দুইয়ের মধ্যে কোন্টা শ্রেয় সেই বিচারও একদিন করতেই হবে। চাই বা না চাই, দিন আগত ওই ।
অথচ এ পর্যন্ত আমরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে পারলাম না। আমরা যে বড়ই কুটনৈতিক কেতাদূরস্ত, বড়ই ব্যাকরণবাগীশ। আমরা তাে চীন নই, ব্রিটেনও নই। চীন শিহানুককে স্বীকৃতি দিয়েছে যখন স্বভূমে শিহানুকের পা রাখার ঠাইও ছিল না। ব্রিটেন অনুরূপ পরিস্থিতিতে স্বীকৃতি দিয়েছিল দ্য গলকে। আমরা ছিঃ, ওসব পারি না। কিন্তু বিলম্বে শুধু সময়ের পাড়ে ধস নামছে। কালহরণে একমাত্র লাভ ইয়াহিয়া খানের। খানিক মেরে, খানিক তাড়িয়ে তিনি ক্রমে ক্রমে পাকিস্তানের পূর্ব আর পশ্চিম ভাগের জনসংখ্যায় প্রার্থিত সেই “প্যারিটি”সেই সমতা আনছেন। পূর্বভাগের গরিষ্ঠতাই তাে এতকাল পশ্চিমের গলায় কাঁটা হয়ে ফুটেছিল? ভারসাম্য এসে গেলে আর ভয় নেই, বিশ্ব বিবেকও সম্ভবত তখন হৃষ্ট, তৃপ্ত ও নিশ্চিত হবে- তৃপ্ত হবে অগণিত মানুষের পিণ্ডভােজনে। এই সংখ্যাসাম্যের দাম যদি কোটি প্রাণও হয়, সেও মঞ্জুর। কেননা এ প্রাণ তাে এশিয়াবাসীর। এশিয়া তাে য়ুরােপ, এমন কী আফ্রিকাও নয়। পাশ্চাত্তের চোখে স্থবিরা এশিয়া আজ বুঝিবা বাসযােগ্য যাকে বলে ‘এক্সপেডেল’-এই রূঢ় সত্যটা ভারত যেন না ভােলে।
২৬ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা