You dont have javascript enabled! Please enable it!

বনগাঁয় দু’লক্ষ অতিথি সত্ত্বেও বাজার চড়েনি

— শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়

জিন্নার স্বপ্ন আমাদের দুঃস্বপ্ন। কিন্তু পাকিস্তান জিনিসটি ভেঙে পড়তে পড়তেও অনেক ক্ষতি করে যাচ্ছে। তবু কিছু কিছু লাভও হল। সিকি শতক ধরে যাদের আমরা সীমান্ত, রাষ্ট্র ইত্যাদি কারণে ভুলতে বাধ্য হচ্ছিলাম- বুকের কপাট খুলে তারা আবার আমাদের মধ্যে চলে এলেন।  ভােরবেলা গাইঘাটার রাস্তার ধারে চায়ের দোকানে বসে আছি। রাস্তার দুধারে পাটের জমিতে নিড়েন। চলছে। বােরাে ধান পাকছে- পাকবে অবস্থা। একজন চাষীবাসি মানুষের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। বলাই কয়াল। সেই জানালাে ঃ এরা যে এসেছেন, কষ্টে আছেন ঠিকই কিন্তু বনগাঁ অবধি যে ক্যামপেই যাবেন- এখন কোন পুরুষলােক পাবেন না। তাকিয়ে আছি দেখে বলল ঃ সবাই এখন মাঠে। এধারে এবার পাটের চাষ খুব। কত লােক চাই। যশাের খুলনার লােক সবাই এখন টোকা মাথায় মাঠে জমি খােচাচ্ছে। বেলা দুটো অবধি দু’টাকা। আপনাদের কাজ হারাতে হচ্ছে না?  কিছু ঠিকই হচ্ছে। কিন্তু মানুষ হয়ে এই অবস্থায় না দেখলে আর কবে দেখবে?

পৌনে চার লক্ষ মানুষের মহকুমা বনগাঁয় এখানে সেখানে নানান ক্যাম্পে প্রায় দু’লক্ষ বাংলাদেশের তাড়া খাওয়া মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। শহর বনগাঁয়ে আশি হাজারের বসতি। সেখানে লােক থিক থিক করছে। তবু দেখলাম মাংসের কেজি পাঁচ টাকা, মাছ চার টাকায় পাওয়া যায়- খােলা বাজারে চাল একটাকা পয়তাল্লিশসরেস এক টাকা পঞ্চান্ন পয়সা। এবার এদের জন্যে কি এতই ভালােবাস যে কালােবাজারিরাও অভ্যাস ভুলে গেল। বয়ড়ার পথে মামা-ভাগনে দু’নম্বর শিবিরে গেলাম। বলব না যে দারুণ ভালাে ব্যবস্থা। কিন্তু আমরা তাে জানি ইদানীংকার বাজারে আত্মীয়-স্বজন বাড়িতে এলে একবেলা পেরােলেই ভাবতে হয় কাল কি বাজার, ঝিকরগাছার লক্ষ্মীর সঙ্গে বসে খালিশপুরের ফতিমা কুমড়াে কুটছেন বিরাট কড়াইয়ে রান্না হচ্ছে। শ্রীগুরু সংঘের কর্মীরা চালের বস্তা নামাচ্ছেন। সরকার দিয়েছেন। ভাত হবে। বাইরেই একটু দূরে তরুণ দুই চিকিৎসক ডাঃ মুখারজি আর ডাঃ বসু মল্লিক ওষুধ দিচ্ছিলেন। ড্রাম ভর্তি ট্যাবলেট। বেশরি ভাগই পেটের রােগের। বললাম এত ওষুধ পেলেন কোথায়?  

দু’জনই সেচ্ছাসেবী ডাক্তার। কাসা’ সেবাপ্রতিষ্ঠানের হয়ে রােগী দেখছেন। ওষুধ দিচ্ছেন। ওদেরই ওষুধ। ওদেরই ভ্যাকসিন। আলাপ করিয়ে দিলেন বিবেকানন্দ যশের সঙ্গে। তিনি জনা কুড়ি ভলানটিয়ার নিয়ে ঘুরে বেড়চ্ছেন। ৪/৫ মাইল অন্তর এক এক শিবিরে ওঁরা দুধ দিচ্ছেন মােট ৫০ হাজার শিশুকে। খাবার ব্যবস্থা করছেন। কেউ পড়ে হাওড়ায় নরসিংহ দত্ত কলেজে- কারাে বাড়ি জ’পুরে। বয়স ১৮/১৯। দুপুরে মােট ঘণ্টা দুয়ের বিশ্রাম। তারপরেই আবার রাত অবধি কাজ চলে। তরুণ ডাক্তার বললেন, এদিককার শিবির গুলাের কোন বড় অসুখ পাবেন না। গােড়াতেই টিকে দিয়ে রেখেছি। রামকৃষ্ণ মিশনের ফেসটুন লটকানাে একটি লরি চলে গেল রাস্তা দিয়ে। মামা-ভাগনে শিবিরটি ঝকঝকে তকতকে। সরকার থেকে কয়েকটা টিউবওয়েল বসিয়েছে। একজন স্বেচ্ছাসেবক বললেন, সদ্য সদ্য গােড়া বাধিয়ে দিচ্ছে সিমেন্ট দিয়ে- নইলে মশা-মাছির আড়ৎ হয়ে যাবে। কিন্তু দেখলাম পায়খানার জায়গা নিয়ে মহামুশকিল। কোনক্রমে ব্যবস্থা হয়েছে। তবে আরও দরকারঅনেক দরকার। গাঁড়পােতা, বাগদা, হেলেনচা- সর্বত্রই একই সমস্যা। কাশী বিশ্বনাথ সেবাসমিতির কর্মীরা কড়া নজর রেখেছেন। ব্লিচিং ছড়াচ্ছেন। সবাইকে ঘণ্টা দুই অন্তর শােয়া বসার জায়গা পরিষ্কার রাখতে বলছেন। পরিচ্ছন্নতার জন্যে গায়ে মাখার কাপড় কাচার দু’লক্ষ পিস সাবান দিয়েছে কাসা’। খুব একটা অপরিচ্ছন্ন কাউকে লাগলাে না। বয়ড়ার ওখানে দাঁড়িয়ে দেখলাম- ওপারেই পাকিস্তান। যশোের বিশ মাইলের পথ । কয়েকদিন আগে 

নদী পেরিয়ে এসে গুলি করে গিয়েছে। দূরে তাল খেজুরের সারির পিছনে নাকি থানা গেড়েছে কদিন। আঠারাে বছরের আবু আতাহার তার মাকে নিয়ে নদী পেরিয়ে এপারে এল। রাতে রাতে হেটে এসে ঝােপে ঝাড়ে লুকিয়ে ছিল। ফাক দেখে জল ঝাপিয়ে চলে এসেছে। দিদি লুট হয়েছে পথে। বনগাঁ হাসপাতালে আর জায়গা নেই। বুলেট তােলার পরেই নতুন রােগীকে খাট ছেড়ে দিতে হচ্ছে। আঠারাে বেড়ের কাসা’ আফটার-কেয়ার হাসপাতালে গেলাম। সেখানে ড্রেস করা হচ্ছিল ফরিদপুরের বজলুর রহমানের পিঠে । ওঁদের শ্রীযুক্ত পি. সি যােশেফ দাঁড়িয়ে-লিউকোপ্লাস্ট এগিয়ে দিলেন। বুলেট তুলে নেওয়ার পরেও ঘা শুকোতে দেরি হচ্ছে। ইলেকট্রিক এসেছে। পাখা এসে পৌছয়নি। একজন ক্যাথলিক সিসটার তাল পাতার পাখা বাতাস করছিলেন। বললেন, এ বাড়িটা পড়েই ছিল। কদিন হলাে পরিষ্কার কোরে নিয়ে আমরা হাসপাতাল বানিয়েছি। জয়বাংলার একখানা জিপ, কিছু ধুতি, শাড়ি নিয়ে সাতমাইল দূরের এক শিবিরের দিকে রওনা দিল। আরেকজন সিসটার এগুলাে একটু আগে গুছিয়ে দিচ্ছিলেন। | মেঘ করে এসেছে। তাই কিছু স্বস্তি। যশাের রােডের দু’ধারে বিপুল ছায়া ধরে বিরাট বিরাট গাছের সারি। দুপুর বেলা ত্রিপলের ছাউনি আগুন হয়ে ওঠে। তাই সবাই রাস্তার ধারের ঘাসে বসে আছেন। কদিন পরেই বৃষ্টি। তখন বহু শিবিরে জল দাঁড়াবে। চাই ভালাে আশ্রয়। অবশ্য চাইতাে অনেক কিছু। সব এক সঙ্গে হবার নয়। তবু একটা জিনিসের অভাব নেই। এত লােক এসেছেন- তবু চাষী, রেলের পাের্টার স্থানীয় মাস্টার মশাই, কয়লার দোকানদার- কারও কপাল কুচকে নেই। শুনলাম, শিবিরের বাইরে বহু মানুষ এখন অনেকের বাড়িতেই অতিথি।

২৪ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!