You dont have javascript enabled! Please enable it!

গাইড মকতু মিয়া

মকতু মিয়া আগে আগে। আমরা তার পেছনে থেকে দ্রুত অনুসরণ করছি তাকে। লােকটা হাঁটছে না, যেনাে বাতাসের বেগে ছুটে চলেছে। এইভাবে কিছুদূর এগিয়ে রাস্তা ছেড়ে আমরা কোমর সমান একটা ধানক্ষেতের ভেতরে নেমে পড়লাম। ধানক্ষেত অতিক্রম করার পর ঢুকলাম মাথা ছাপিয়ে ওঠা একটা কাশবনে। দু’হাতে কাশবন সরাতে সরাতে এগুতে লাগলাম আমরা। সেটা শেষ হলাে একটা উঁচু গড়ে এসে। গড় পার হয়ে আবার ধানক্ষেত, উঁচু উঁচু মাটির ঢিবি, এবড়ােখেবড়াে পিছল কাদাময় মাটি।

মকতু মিয়াকে সামনে রেখে আমরা শুধু এগুচ্ছি। কোনাে প্রশ্ন নেই। হাতে হাতিয়ার। নিজেদের সজাগ রেখে কেবল এগিয়ে চলা। পেরিয়ে যাওয়া ফসলের মাঠ, ঝােপঝাড়, এবড়ােখেবড়াে অসমতল প্রান্তর। এগুচ্ছি যতােটা সম্ভব দ্রুত। তবে নিঃশব্দে। মকতু মিয়ার নির্দেশিত পথ ধরে । ওর বিশ্বস্ততার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে। মতু মিয়া, আমাদের প্রথম গাইড। আমরা বলতাম গাইডার।

– আর কতদূর মকন্তু মিয়া? অনেকক্ষণ এগুবার পর প্রথম জিজ্ঞাসা । – এই তাে সামনে। মকতু মিয়ার সংক্ষিপ্ত জবাব।

এবার একটা পায়ে চলা গ্রামের রাস্তা। একটার পর একটা বাঁক পেরিয়ে গেলাম। কখনও ডানে, কখনও বাঁয়ে, কখনও সােজা । এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর একটা জায়গায় এসে মকতু দাঁড়িয়ে পড়লাে।

—কী হলাে মকতু মিয়া?

– স্যার, সামনের বাড়ি কয়টার লোকজন দালাল। একটু সাবধানে আসতে হবে।

 

মকতু মিয়ার দিকে এতােক্ষণ পর একটু ভালাে করে তাকালাম। দেখলাম, বেটেখাটো শক্ত গড়নের মানুষ । গায়ের রঙ কালাে। রাতের অন্ধকারেও তার মুখে একটা ভয়হীন হাসির রেশ। চমৎকার শাদা দাঁতের বারি না, এ লােককে সন্দেহ করার কোনাে কারণ নেই। ওকে এগুতে বলে জায়গাটা পার হলাম। বাড়ি ক’টাকে চিনে রাখলাম। লােকজনের সাড়া চাই। শুধু একটা ছােট্ট বাচ্চা ছেলের কঁকিয়ে কঁকিয়ে কান্নার শব্দ পেলাম ।

মকতু মিয়া এবার থামলাে। তাকালাে আমাদের দিকে।

– এসে গেছি স্যার। ৯ বসলাম সবাই। মকতুকে বসতে বললাম।

— সামনের ওই যেটার ওপারেই ব্রিজ, মকতুর দাঁত সেই অন্ধকারে চিকচিকিয়ে ওঠে। হাসছে সে।

— এগুনাে যাবে মকতু?

– বােধহয় যাবে, দেইখা আসি, যামু উৎসাহে টগবগ করছে মকতু। কিন্তু মকতুকে ছাড়তে চাই না। শক্রকবলিত এ এলাকায় মকতুকে ছেড়ে দেয়াটা ঠিক হবে না। ওকে আমাদের বিশ্বাসের আওতায় আনতে এখনও অনেক সময়ের দরকার।

— না, তুমি একা যাবে না, বলেই প্রশ্ন করি, খানেরা আছে নাকি মকতু?

– বােধহয় না। রাতের বেলা ওরা থাকে না। কেবল দিনে এসে ঘুরে যায় ।

-তুমি জানাে?

—হ স্যার।

– কেমন করে জানাে?

মকতু এ কথার উত্তর দেয় না। কেবল চুপচাপ থাকে কিছুক্ষণ । এদিক-ওদিক তাকিয়ে পরিবেশটা আঁচ করে নেয়। তারপর গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়ায় ।

— লন ছার উঠেন।

মকতুকে এ মুহূর্তে বিশ্বাস না করে উপায় নেই। ওর নির্দেশিত পথে এগুনাে ছাড়া গত্যন্তর নেই। সুতরাং প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গী-সহযােদ্ধাদেরকেও উঠতে বললাম । রাস্তা ছেড়ে শর্টকাট পথে আসতে গিয়ে মকতু মিয়া যেভাবে আমাদের জলা, খালবিল আর এবড়ােখেবড়াে, উঁচুনিচু প্রান্তর দিয়ে নিয়ে এসেছে, তাতে করে সবাই ক্লান্ত আর বিধ্বস্ত, কিন্তু উপায় নেই। সামনে অনেক কাজ।

Reference:

গেরিলা থেকে সন্মুখ যুদ্ধে – মাহবুব আলম

ছবি – রাজিবুল বারী

সংগ্রামের নোটবুক

 

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!