You dont have javascript enabled! Please enable it!

প্রধানমন্ত্রী দেখে গেলেন শরণার্থীর স্রোতে উত্তরবঙ্গ প্লাবিত

— বিধান সিংহ

প্রধানমন্ত্রী উত্তরবঙ্গের শরণার্থী পরিস্থিতি পরিদর্শনে তিনটি জিনিস পরিষ্কার হল ঃ তিনি নিজের চোখে দেখে গেলেন সমস্যাটি কী ভয়াবহ এবং তুলনায় রিলিফ কত অপ্রতুল। জেলা প্রশাসন বুঝে নিলেন তাঁদের আরাে। তৎপর হতে হবে। শরণার্থীরা উপলব্ধি করলেন তারা অবহেলিত নন। যদিও শেষ পর্যন্ত গাছতলায় পড়ে থাকা শরণার্থীদের শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর দেখা হল না। দেখা হল না জলপাইগুড়ি-হলদিবাড়ির ষােল মাইল রাস্তার দূধারে খােলা আকাশের নিচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা। শরণার্থীদের। শুনলাম, তিনি ক্যামপে আশ্রিতদের থেকে এঁদের দেখার ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন। অবশ্য ক্যাম্প শরণার্থীদের সঙ্গে বলেই প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছেন অবস্থাটা কী। হলদিবাড়িতে শরণার্থীদের একাংশের প্রতিনিধি বললেন ঃ তারা বাংলাদেশে ফিরে যেতে চান। ব্যবস্থা করুন। কী ব্যবস্থা? দেওয়ানগঞ্জের শরণার্থীরা কিন্তু স্পষ্ট বললেনঃ তারা আর ফিরে যাবেন না। মরতে হয় এখানেই মরব।’ গত কয়েকদিন উত্তর বাংলার শরণার্থীদের মধ্যে ঘুরে আমারও ধারণা হয়েছে তাদের অধিকাংশই আর ফিরে যেতে অনিচ্ছুক।

এ-জন্যেই স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বলেছেনঃ এদের অন্য রাজ্যে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য কেন্দ্রকে একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। এবং তা করতে হবে অবিলম্বে। নইলে সমস্ত উত্তর বাংলার অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যাবে। বর্ষায় সমগ্র এলাকা বিচ্ছিন্ন হয়ে এক ভয়াবহ বিপর্যয় সৃষ্টি করবে। শরণার্থী স্রোতে উত্তরবঙ্গ প্লাবিত এখনও হু হু করে শরণার্থী আসছেন সীমান্তের ওপার থেকে। এঁরা এত সাধরণ গাঁয়ের মানুষ যে নিজের বয়সটা পর্যন্ত ঠিকমত বলতে পারেন না। মানিকগঞ্জের কাছে আরও অনেকের সঙ্গে দেখা পেলাম শ্রী দর্পনারায়ণ বর্মনের। জাতীয় সড়ক ধরে হাঁটছিলেন। পূর্ববঙ্গের বগুড়া বাড়ি থেকে আসছেন। জিজ্ঞাসা করলাম বয়স কত? বলতে পাররেন না। শুধু বললেন, ‘পচ্ছন্দ করি দেখেন আপনারা। নব্বই মত হবে। পরিবারে আর কেউ নেই। বুড়াবুড়ি চলে এসেছেন। কারণ ওপারে শুধু গােলাগুলি’।  এইটেই পাক ফৌজের নতুন কৌশল। সােমবার দুপুরে ইসলামপুরের মরাগতি সীমান্তে দাঁড়িয়ে দেখেছিলাম নাগের নদী পেরিয়ে দলে দলে শরণার্থী আসছেন- ভাঙ্গালণ্ঠন, ছেড়া কাথা, মাদুর, গরু-ছাগল, পােষাপাখী, কেউ কেউ পাটের বােঝা মাথায় করে।  নতুন করে এই শরণার্থীর স্রোত বেড়ে গেছে। কেন আসছেন প্রশ্ন করতেই জানালেন কালই পাক ফৌজ শুধু শুধু হাটে ঢুকে গুলি করল। তিনটি লােক কাউন ক্ষেতে পড়ে মরল। দুটি মেয়ে ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ দিল। প্রচুর ঘর বাড়ি জ্বলল। শেষে ওরা গ্রামের মাতব্বর মৈনুল হককে জবাই করল। যাতে আরাে বেশি শরণার্থীকে এপারে ঠেলে দেওয়া যায় সেজন্যে যেখানে যতটুকু রের লাইন আছে অনর্থক ট্রেনে করে সৈন্য নিয়ে এসে গ্রামে ছেড়ে দিচ্ছে। আওয়ামী লীগ সমর্থকদের আগেই নিপীড়ন করেছে। তাদের না পেয়ে এখন যে মুসলিম লীগ ও জমিয়েত ইসলামীরা এতদিন পাক ফৌজকে সাহায্য করছিল। তাদেরই খুন করছে। উদ্দেশ্য, যাতে গ্রাম খালি করে ওরা এপারে চলে আসে।

দিনাজপুরের বড়শালুপাড়া, আটোয়াবাড়ি প্রভৃতি অঞ্চল মালদহ থেকে আগে যেসব বাদিয়া মুসলমান (আদিবাস বিহার) পূর্ববঙ্গে গিয়েছিল তাদের লেলিয়ে দিয়েছে। তারা নির্বিচারে লুটপাট, অগ্নিসংযােগ, মেয়েদের ওপর অত্যাচার চালিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই শুনাচ্ছে “ব্যাটা ঘর উঠিবেন না। উঠিবেন না। এখনও পালাল নি।” তাই ওরা পালাচ্ছে। বামুনপুকুর থেকে পলাতক সুলতান আলি বললেন ঃ কী করব? হাকিম নেই, হুকুম নেই। নেই থানা-পুলিশ। কার কাছে যাব? জঙ্গীচক্রের প্রশাসন নেই। জঙ্গীশাহী ঠাকুরগাঁও-পচাগড় রােডে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সমগ্র পূর্ববঙ্গে তারা কোন প্রশাসন চালু করতে পারেনি। এখন বিহারী মুসলমানদের সাহায্যে মুজাহিদ এবং আনসার বাহিনী নতুন করে সংগঠিত করছে। কিন্তু আইন শৃঙ্খলা ও প্রশাসনে না গিয়ে তারা লুটপাটেই ব্যস্ত। | মুসলীম লীগ এবং জমিয়েতের লােকেদের ওপর হামলা হওয়ায় তারাও যেমন ভেঙ্গেছে- জঙ্গীচক্রের শান্তি কমিটি এবং তথাকথিত ছােটখাট অসামরিক যােগসূত্রও ভেঙ্গে পড়েছে। ফলে সব পাক ফৌজ এখন সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এবং তাদের মনােবল বিপর্যস্ত।

সম্প্রতি বিশজন মুসলীম লীগ নেতা সপরিবারে মুক্তি ফৌজের কাছে আত্মসমর্পণ করে বলে পাক ফৌজ তাদের পরিবারের উপর অত্যাচার করছে। মুক্তি ফৌজ দরকার হলে তাদের মেরে ফেলুক। কিন্তু পরিবারের মেয়েদের ইজ্জত বাঁচাক। ওই মুসলীম লীগ পন্থীদের মুক্তি ফৌজ গ্রেফতার করেছে। এবং তাদের পরিবারবর্গকে নিরাপদে রেখে দিয়েছে এক মুক্তাঞ্চলে। পাক ফৌজের অবস্থা এমন দাড়িয়েছে যে, তারা রংপুরের ১৪ থেকে ৪০ বছরের সমস্ত লােকের নাম রেজিসট্রি করতে বলেছে। উদ্দেশ্য হয় তাদের যুদ্ধে নামানাে না হয় অত্যাচারী চক্রের মদত দেওয়ার জন্য প্রশাসন গড়ে তােলা। ফলে আতঙ্কে আরও বেশী লােক রংপুর ছেড়ে পালাচ্ছে। 

মুক্তি ফৌজের গুপ্ত বাহিনী তৎপর। মুক্তি ফৌজের এক মুখপাত্র বললেন, লালমনিরহাট বিমান বন্দরটি এখনও পাক ফৌজ ব্যবহার করতে পারছে না। কারণ তার চারিদিকে মুক্তি বাহিনীর গুপ্ত বাহিনী তৎপর। তাই সমগ্র উত্তর খণ্ডে পাক বাহিনীর রসদ সরবরাহ বিপর্যস্ত। তারা সৈয়দপুর এবং রংপুরের মধ্যে নতুন। বিমান বন্দর গড়ার চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে বাংলাদেশের মানুষ মরিয়া হয়ে অদ্ভুত প্রতিরােধ নিচ্ছে। শুনলাম রংপুরের একচাষীর ছেলেদের পাক ফৌজ মেরে ফেলে। প্রতিহিংসা নেওয়ার জন্য ওই চাষী কিছু টমেটোর ভিতর বিষ ঢুকিয়ে রংপুর সেনাবাহিনীর ছাউনীতে গিয়ে বিক্রি করে এবং সরে পড়ে। ওই টমেটো খেয়ে বেশ কিছু পাক সেনা। মারা যায়। এখন জঙ্গীচক্র আদেশ জারি করেছে স্থানীয় লােকের কাছ থেকে যেন কেউ কোন ফল না কেনে। এইভাবে পাক বাহিনী নিজের লােকের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। আর এপারে শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা আমরা করছি। আমাদের সীমান্তরক্ষী ক্যাম্প গুলি বস্তুত এখন রিলিফ-কেন্দ্র-শরণার্থীদের দেখাশােনা করাই ওঁদের প্রধান কাজ। শরণার্থীরা বুঝেছেন ভারত গরিব হলেও তাদের দেখাশােনা করবে- প্রধানমন্ত্রীর এ আশ্বাস শুধু কথার কথা নয়।

২১ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!