You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং না-দেওয়ার সমস্যা

— অধ্যাপক সমর গুহ, এমপি

ভারতীয় সংসদে গৃহীত সর্বসম্মত প্রস্তাবের অনিবার্য পরিণতি যে বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারের আশু স্বীকৃতিদান, সেই অনস্বীকার্য কর্তব্যকে অস্বীকার করে বিরােধী নেতৃবর্গের বৈঠকে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছেন যে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এখনও সম্ভব নয়। বিরােধী পক্ষ একযােগে স্বীকৃতির দাবী করেছেকিন্তু সরকার নিষ্ক্রিয়তার স্থিতাবস্থা চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছেন। ভারতের কয়েকটি বিধান পরিষদ ঐক্যবদ্ধ প্রস্তাব করেছে স্বীকৃতির স্বপক্ষে,- বহু বিশিষ্ট কংগ্রেসী নেতা এবং কেন্দ্রীয় মন্ত্রীও এই দাবি করেছেন, তবুও ভারত সরকার অনিশ্চয় মন্থরতায় অচল।।  সরকারের, এই মনােভাবের ফলে সরকারী নীতির সঙ্গে বিরােধী পক্ষ এবং ভারতীয় জনমতের দাবির মধ্যে ঘটলাে এক দুর্ভাগ্যজনক ব্যবধান। বিরােধীপক্ষ এখন কী করবে? তারা কি সরকারের উপরে চাপ সৃষ্টি করার জন্য জনআন্দোলনের পথ বেছে নিতে বাধ্য হবেন? | বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না-দেওয়ার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী যে যুক্তি দিয়েছেন, ভারতের ন্যায় বিরাট দেশের পক্ষে তা বিস্ময়কর ভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ। ভারত সরকার বলেছেন, বিশ্বের কোনও বড় বা ছােট রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজী নয়, তাই ভারতের পক্ষে এককভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে আন্তর্জাতীয় গােষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া সম্ভব নয়। জাতীয় অবমাননাকর এই যুক্তির চেয়েও আরেকটি অন্তঃসারশূন্য এবং স্ববিরােধী যুক্তি দাঁড় করিয়ে প্রধানমন্ত্রী বিরােধী নেতৃবর্গকে বলেছেন যে এখন স্বীকৃতি দিলে এরূপ রাজনৈতিক পদক্ষেপ বাংলাদেশের পক্ষে সহায়ক হবে না। সেই সঙ্গে সার্বভৌমিকতার শর্তপূরণের কথাও তিনি উল্লেখ করেছেন। | এই কয়টি যুক্তিই আসল কারণকে প্রচ্ছন্ন রাখার আবরণ প্রয়াস মাত্র। বিরােধী পক্ষের সঙ্গে আলােচনায় একথাটিই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে বিশ্বের কোন বৃহৎ রাষ্ট্র স্বীকৃতি না দিলে এককভাবে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দায়িত্ব নিয়ে পাক-ভারত সশস্ত্র সংঘর্ষের ঝুঁকি নিতে ভারত সরকার প্রস্তুত নয় ।

আমেরিকা, রাশিয়া, বৃটেন ও ফ্রান্স বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের প্রশ্নে ভারত সরকারকে যে বুঝে সুঝে পা বাড়াবার পরামর্শ দিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে তা স্পস্টই বােঝা গেছে। কিন্তু ভারত সরকারের কাছে জিজ্ঞেস্য, বড় ছােট কোন রাষ্ট্রেরই আজ কি বিশ্ববিবেক বলে কিছু অবশিষ্ট আছে? বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র, গণতান্ত্রিক বা কম্যুনিস্ট সবাই কি নগ্ন জাতীয়তাবাদী দৃষ্টি দ্বারা আজকে নিজেদের আন্তর্জাতিক নীতি পরিচালনা করছে না? আরও বক্তব্য কখনও কি বিশ্বের কোনও বৃহৎ রাষ্ট্র ভারতকে একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের গুরুত্ব দিয়ে পাক-ভারত সমস্যার স্থায়ী সমাধানের কোন আন্তরিক চেষ্টা করেছে? নিজেদের রাজনৈতিক দাবা খেলার ক্ষেত্ররূপে প্রতিটি বৃহৎ রাষ্ট্র কি আগাগােড়া পাক-ভারতের ভারসাম্য রাখার তৎপরতা দেখায়নি? তাই, বাংলাদেশ সম্বন্ধে এই সব রাষ্ট্রগুলির পরামর্শের পশ্চাতে শুভবুদ্ধির স্বাক্ষর কোথায়?

রুশ-মারকিন দুটি রাষ্ট্রই পূর্ব বাংলার স্বাধিকার আন্দোলনকে প্রথম পর্যায়ে উৎসাহ দিয়েছে। কিন্তু এই আন্দোলন যখন বৈপ্লবিক জাতীয় উত্থানের অপূর্ব ইতিহাস রচনা করলাে, তখন বাংলাদেশকে সমর্থনের প্রশ্নে এই রাষ্ট্রদ্বয় আকস্মিকভাবে পশ্চাদপদ হলাে কেন? তার উত্তর নিহিত রয়েছে- চীন-মারকিন সমঝােতা প্রয়াসের পিংপং কূটনীতির মধ্যে। রাশিয়া পিন্ডিশাহীর নীতির মধ্যে। রাশিয়া পিন্ডিশাহীর কাছে বাংলাদেশ  সম্বন্ধে দু’টি নােট পাঠিয়ে এখন নীরব ও নিষ্ক্রিয়। কারণ রাশিয়ার দৃষ্টি এখন চীন-মার্কিন পিংপং খেলার টেবিলের দিকে। রাশিয়া মার্কিনের মতিগতি না বুঝে বাংলাদেশের ব্যাপারে মাথা গলাতে চায় না। মার্কিনের। বড় স্বার্থ এখন বাংলাদেশের চেয়েও পিকিংয়ের দিকে। ফ্রান্স সর্বদাই পাক ভারতের দুটি দেশের সামরিক বাজার রক্ষায় আগ্রহী। বৃটেনের রক্ষণশীল দল এখনও পাক-ভারতকে পরস্পরের বিরুদ্ধে খেলিয়ে কমনওয়েলথের কর্তৃত্ব ও শিল্পসামগ্রীর বাজার বাঁচাতে ব্যস্ত। যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার ফলে ভারত পাকিস্তানের উপরে প্রাধান্য লাভ করে বসে, সেটাই বৃটেনের। প্রধান দুশ্চিন্তা।

বাংলাদেশের স্বীকৃতিদানের প্রশ্ন এই চারটি রাষ্ট্রের কারাে জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত নয়। জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে জড়িত হলে এই রাষ্ট্রগুলি কি উগ্ররূপ ধারণ করে চীনের ক্ষেত্রে কোরিয়া, রাশিয়ার ক্ষেত্রে হাঙ্গেরী ও চেকোশ্লোভাকিয়া, মার্কিনের ক্ষেত্রে পানামা ও কিউবা এবং ভিয়েনাম, ফ্রান্সের ক্ষেত্রে আলজেরিয়া এবং বৃটেনের ক্ষেত্রে সুয়েজের ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। | বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে কমুনিষ্ট রাষ্ট্রগুলির অবস্থা সবচেয়ে শশাচনীয়। সাম্রাজ্যবাদ-বিরােধী ও ঔপনিবেশবাদী বিরােধী ন্যাশনাল লিবারেশন মুভমেন্টের সমর্থনে প্রচণ্ড প্রচারের সদ্য সােচ্চারিত কণ্ঠে পূর্ব বাংলার ঐতিহাসিক ঔপনিবেশবাদবিরােধী সংগ্রামের ঘটনা সম্বন্ধে আজ সতর্কভাবে নীরব। বাংলাদেশে যে। সামগ্রিক জাতিয়তাবাদী গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে বিশ্বের অধিকাংশ কম্যুনিস্ট পার্টিগুলি নাকি সে সংবাদও জানে  এই আশ্চর্যজনক বিষয়টি জানিয়েছেন আন্তর্জাতীয় কম্যুনিস্ট সম্মেলনে যােগদানকারী ভারতীয় কম্যুনিস্ট পার্টির সম্পাদক কমরেড রাজেশ্বর রাও। 

বাংলাদেশের স্বীকৃতির সমস্যা ভারতের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে জড়িত। এই সমস্যা নিয়ে। প্রত্যক্ষ মাথাব্যথা তাই মূলত ভারতের। তথাপি রুশ, মার্কিন, ফ্রান্স, বৃটেনের স্ব-স্বার্থী পরামর্শের কাছে ভারত। মাথা নােয়াতে রাজী হচ্ছে কেন? আমরা আজ উদ্বিগ্ন হয়ে ভাবছি, ভারত কি পাকিস্তানের অস্তিত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষায় এই চার রাষ্ট্রের আপােস সূত্রের ফেরিওয়ালার ভুমিকা নেবে? বাংলাদেশকে আবার বশে আনার সুযােগ দেওয়ার জন্য এই বৃহৎ রাষ্ট্রগােষ্ঠী যে অপচেষ্টা করছে, তার সুযােগ দেওয়ার জন্যই কি ভারত সরকার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি। দিতে এত ইতস্ততভাব দেখাচ্ছে?

আজ একথা ভারত সরকার ও সারা বিশ্বের নিঃসন্দেহে জানা উচিত যে ১৯৪৭ সালের পাকিস্তানের কবর খোড়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশে পিণ্ডিশাহীকে বাঁচিয়ে তােলার কোন সম্ভাবনাই আর নেই। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ ঐতিহাসিক ধ্রুব সত্য। ভারত যদি এই সত্যকে সাহসের সঙ্গে যথা সময়ে স্বীকার করে না নেয় তা হলে তার প্রতিফল ভারতকেই ভূগতে হবে। | সার্বভৌম স্বতন্ত্র রাষ্ট্রের মর্যাদালাভের প্রায় সমস্ত শর্তই পূর্ণ করেছে বাংলাদেশ। নিজের দেশের স্বতন্ত্র জাতীয় নাম, নিজস্ব পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত এবং রাষ্ট্রীয় ভাষাই শুধু বাংলাদেশে প্রবর্তিত হয়নি, বাংলাদেশের স্বাধীন সরকার গণভােটে নির্বাচিত প্রায় সমগ্র জনপ্রতিনিধির সার্বিক সমর্থন, সরকারী কর্মচারী ও বাঙালী পুলিশ ও সামরিক বাহিনীর আনুগত্য এবং জনতার পূর্ণ সহযােগীতা লাভ করেছে। বাংলাদেশের প্রায় আশীভাগ মুক্ত অঞ্চলে নৈতিক কর্তৃত্ব চলছে পিভিশাহীর নয়, বাংলাদেশ সরকারের। নাদির-বংশধরের বর্বরতার হাত থেকে আত্মরক্ষার জন্য কোথাও পাক পতাকা উড়লেও, তা’ প্রতিরােধ লড়াইয়ের রণ-কৌশল মাত্র। মুজিব নগরের ভৌগােলিক অবস্থানের কথা ব্যক্ত করে পাক বােমার শিকার। হওয়াও রণনীতি সঙ্গত নয়। এর চেয়ে বহু কর্ম শর্ত-পুর্তির অধিকার, বহু সদ্যপ্রতিষ্ঠিত জাতীয় রাষ্ট্র বহুরাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করেছে। পানামা, ইজরাইল, উগান্ডা ইত্যাদি বহু রাষ্ট্রের নজীর তুলে তার তথ্য দেওয়া যায় । কিন্তু সার্বভৌমিকতার শর্ত-পূর্তির বিষয়টি যে আসল কথা নয়, বা প্রধান বাধাও নয়, বিরােধী-পক্ষের বিতর্কের উত্তরে প্রধানমন্ত্রীও সেকথা স্বীকার করেছেন। তাই বাংলাদেশকে আশু স্বীকৃতি না দেওয়ার কারণ গুপ্ত রয়েছে অন্যত্র এবং অন্য যুক্তির উপরে।

অবিলম্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলে এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রকৃতিতে গুণগত পরিবর্তনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হবে। বাংলাদেশের জনতা ও সগ্রামীদের মনে এক বিপুল আত্মপ্রত্যয় সৃষ্ট হবে,  এদের মনােবল ভেঙে দেওয়ার জন্য যে বর্বর প্রচেষ্টা চলছে তার হিংস্রতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের মানুষের মনে। এই বিশ্বাস আসবে যে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা এক অনস্বীকার্য বাস্তব ঘটনা। এই মনােবলের অধিকারী হয়েও শত নিষ্পেষণের মােকাবিলা করতেও বাঙালীরা ভীত হবে না। | বাংলাদশ ভারতের স্বীকৃতি পেলে, দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সমমর্যাদার সম্পর্কে এবং আন্তর্জাতীয় বিধান অনুযায়ী, ভারত সরকার প্রকাশ্যে এবং প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, আর্থিক এবং সামরিক সাহায্য দিতে সক্ষম হবে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের অভিযােগ আন্তর্জাতীয় আইনের ভিত্তিতে মূল্যহীন হয়ে যাবে। বিশ্বের অন্য কোন রাষ্ট্রও ভারতের বিরুদ্ধে এরূপ অভিযােগ আনতে পারবে না। মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার জন্য ভারত প্রকাশ্যে বাংলাদেশের সরকারকে অস্ত্র সাহায্য দিতে পারবে, বাঙালী ফৌজকে সামরিক শিক্ষা দিতে পারবে। এমন কি ভারতীয় ভলান্টিয়ার বাহিনী বাংলাদেশের সংগ্রামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করতে পারবে।

১৫ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!