ক্ষাত্ৰতেজ আর দেশপ্রেম
–পার্থ চট্টোপাধ্যায়
ওদের সব গেছে, ঘর বাড়ি, আত্মীয় পরিজন কিন্তু একটি জিনিস এখনও অটুট আছে তা হল মনােবল। অর্ধাশনে থেকে ভূমিশয্যায় শুয়ে এই ধরনের অসাধারণ মনােবল আর কোন জাতির থাকত কিনা বলা মুশকিল। ইউরােপে নাজি আমলের মুক্তিযােদ্ধাদের দেখিনি, দেখিনি আলজিয়ার্সের তরুণ বীরদের অথবা। ভিয়েতনামের অদম্য অজেয় গেরিলাদের, কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের দেখে যে কোন বাঙালীর বুকেই ভরে উঠবে গর্বে। ক্ষাত্রতেজের সঙ্গে দেশপ্রেমের এত বড় মিলন এই বঙ্গভূমিতে বােধহয় বহুদিন ঘটেনি। | এতক্ষণ যা লিখলাম তা উচ্ছাসের কথা নয়। অর্ধাশনেই ওঁরা আছেন। বিভিন্ন শিক্ষা শিবিরে গিয়ে দেখেছি, ওঁদের দুপুরে ও রাতে খাবার জুটছে ভাত ডাল আর তরকারি। সকালে কেউ কেউ পাচ্ছেন ভেজান। ছােলা। কোন শিবিরে তাও আসেনি। জিজ্ঞেসা করেছিলাম একজনকে। চা খান না? ছেলেটি ম্লান হেসে জবাব দিল, দুধ, চিনি, চা কিনবার পয়সা কোথায়? ওটা আমাদের কাছে বিলাসিতা। মাঝে মাঝে যখন ক্ষিদের জ্বালায় ছটফট করি তখন লুকিয়ে এক কাপ চা কিনে খেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু পরক্ষণেই ভাবি সবাইকে বঞ্চিত করে নিজে খাওয়া মারাত্মক অপরাধ।
একটা শিবিরে ছেলেরা বলল, তেলে জলে মানুষ, আজ কতকাল তেল-সাবানের মুখ দেখিনা। পরনের লুঙ্গিটাও কাচা হয়নি কতকাল। নেতা উত্তর দিলেন, তেলের কথা ভুলে যাও। চেষ্টা করছি এক টুকরাে সাবান দেওয়া যায় কী না। | ঘণ্টার পর ঘণ্টা বনে বাদাড়ে দৌড়াতে হয়। অথচ অধিকাংশের পায়ে জুতাে নেই। কাটায় শামুকের খােলায় অনেকের পা রক্তাক্ত। ওরা যদি প্রত্যেকে একটা করে ক্যাডস পেত। কেউ কেউ পেয়েছে। কিন্তু সংখ্যা অতি অল্প। একটি দল কোথা থেকে গুড়াে দুধ সংগ্রহ করেছে। কী ফুর্তি তাদের। বললাে, খুব শুভদিনে এসে পড়েছেন। একটু দুধ খেয়ে যান আমাদের সঙ্গে। খেতে হল। দুধের মগ ছেলেমানুষের মত মুখে ধরে তারিয়ে খাচ্ছে। মুখ ভরে উঠছে খুশীতে। বলল, আজকের সন্ধ্যাটার কথা মনে থাকবে। কতদিন পরে দুধ খেলাম । রাত্তিরে একটি শিবিরে গিয়ে অপ্রস্তুত । গুদোম ঘরে সারি সারি সারে ছেলেরা শুয়েছে করােগেটেড সীটের ওপর। আর বলিশের বদলে থান ইট পেতেছে। তার ওপর লুঙ্গি দিয়ে মােড়া। অঘােরে ঘুমােচ্ছে। শিবির ইনচারজ বললেন, ডাকব। বললাম, দরকার নেই। এই শিবিরে দেখা ছােট্ট ছেলেটির সঙ্গে। কচিমুখ, রােগা চেহারা। বছর চোদ্দ বয়স। ক্লাস নাইনে পড়ত। আমি বললাম, তুমি কি করবে? সে বলল, কেন, আমি গ্রেনেড ছুঁড়ব। ওদের খতম করবাে। তােমার আব্বা, আম্মা জানেন তুমি এখানে? ছেলেটি বলল, হ্যা তারাই তাে আমাকে দিয়ে গেছেন এখানে।
ভাগ্যক্রমে একদিন ওর বাবাকে পেলাম বেতাই গ্রামে। সরকারী কাজ করতেন। সব ফেলে গােটা পাঁচছয় ছেলেমেয়ে নিয়ে এখন এসেছেন শরণার্থী হয়ে। বললেন, আমার ছেলের কথা বলছেন? দেখুন, আমার তাে দিন ঘনিয়ে এসেছে। বড় ছেলেটা অসুস্থ। ছােটটিকে তাই মুক্তিফৌজে দিলাম। একগ্লাস পানিও যদি এগিয়ে দিতে পারে তাহলেও তাে সাহায্য হবে। ভেড়ামারার রাজা মিঞা একটা শিবির চালাচ্ছেন। বিরাট ব্যবসা ছিল। এখন পথের ভিখারি। তার উপর পারিবারিক জীবনে নেমে এসেছে চরম ট্র্যাজেডি। বােনের বিয়ে দিয়েছিলেন এক পাঞ্জাবী অফিসারের সঙ্গে। মুক্তিযুদ্ধের পর আর ওই অফিসারের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়ত বা বেঁচে নেই। বােন তার দুটি বাচ্চা নিয়ে ওঁর কাছে রয়েছিল। বললেন, বােনটার দিকে তাকাতে পারি না, কিন্তু আমার কোন আফশােস নেই। মুক্তিফৌজের কাজ তারা করেছে। একেই বােধ হয় বলে জনযুদ্ধ। মুক্তিযােদ্ধাদের শিবিরে সব শ্রেণীর মানুষই আছেন। একটি ছেলে বলল, আপনাদের কাগজে আমাদের লেখা ছাপাবেন? খোঁজ নিয়ে জানলাম, ছেলেটি অর্থনীতির এম-এ। মাধ্যমিক স্কুলের এক শিক্ষককে দেখলাম। একজন বললেন, ছােটখাট ব্যবসা ছিল। এখন পরিচয় মুক্তিযােদ্ধা, এসেছেন চাষীর ছেলে, বেশ কিছু কারখানার শ্রমিক। যাবার সময় ছেলেরা ঘিরে ধরল। আকুল জিজ্ঞাসা, আমরা লড়াই চালিয়ে যাবাে। শুধু বলুন কবে আমরা স্বীকৃতি পাব?
১৬ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা