You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.08 | এই সংগ্রাম -নরেশচন্দ্র সাহা - সংগ্রামের নোটবুক

এই সংগ্রাম

–নরেশচন্দ্র সাহা

“আমার শাসনের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করলে তা বরদাস্ত করা হবে না।… পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য যদি দশ-বিশ হাজার মানুষকেও হত্যা করতে হয়, তবু আমি পিছপা হব না।”- পাকিস্তানের অখণ্ডতা। রক্ষার মহান দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সেদিন সদম্ভে যিনি এই কথাগুলাে বলেছিলেন তিনি আর কেউ নন, তল্কালীন পূর্ববাংলার গভর্ণর, পরবর্তী সময়ে যিনি সারা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পদ দখল করেছিলেন সেই দুর্দান্তপ্রতাপ সেনাপতি ইসকান্দার মির্জা সাহেব। আজো সেই পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার দায়িত্ব বহন। করার তাগিদেই বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খাঁ বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষের রক্তে বাংলার মাটি রঞ্জিত করতে পিছপা হচ্ছেন না; বাংলার অসহায় মানুষের করুণ আর্তনাদ তাকে স্পর্শও করতে পারছে না।

আজ বাংলাদেশে যা ঘটে চলেছে, তাতে সারা বিশ্বের শান্তিকামী গণতান্ত্রিক মানুষ স্তম্ভিত, বিচলিত। কিন্তু তবু এটা কোন একটা আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন ঘটনা মাত্র নয়। ইতিহাসের এক স্তর থেকে আরেক স্তরে অবশ্যম্ভাবী উত্তরণের শেষ ধাপ। মধ্যযুগীয় ধর্মীয় গোঁড়ামিকে পিছনে ঠেলে দিয়ে নবতম এক মানবিক উত্তরণ। ধর্মীয় গোঁড়াবিদের ধ্বংসস্তুপ থেকে জন্ম নিল এক সাচ্চা মানবতাবাদ। ফলে যে পাপ আজ। বাংলাদেশ থেকে মুছে যেতে বসেছে, তা হল জিন্নাসাহেবের দ্বিজাতি তত্ত্ব। আজ বঙ্গবন্ধু মুজিবরের নেতৃত্বে যে রাজনৈতিক বিপ্লব দানা বেঁধে উঠেছে, তা মােটেই দু-এক বছরের  প্রচেষ্টার ফল নয়; বহু দিনের বহু বছরের তিল তিল অভিজ্ঞতা ও ইতিহাসের পাঠ থেকেই এ বিপ্লবের জন্ম। স্বাধীনতার পর থেকেই পূর্ব বাংলার মুসলমান তরুণদের কাছে একটা জিনিস পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছিল যে, পশ্চিমী স্বৈরতন্ত্রী জঙ্গী গােষ্ঠী পূর্ববাংলাকে পাকিস্তানের সমান সমান অধিকার দিতে উৎসাহী নয়। উপরন্তু নিকটতম প্রতিবেশী ও একই ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক ও বাহক পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে ভৌগােলিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিচ্ছেদ ঘটিয়ে পূর্ববাংলাকে সাংস্কৃতিক ও কৃষ্টির দিক থেকেও দেউলিয়া করে তােলার একটা জঘন্য চেষ্টা তারা চালিয়েছে। পশ্চিমী স্বৈরতান্ত্রিক শাসকবৃন্দ অবশ্য এ সবই করছেন পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার ‘মহানদায়িত্ব পালনের স্বার্থেই। এই উদ্দেশ্যেই ওঁরা মুজিবরের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ দাঁড় করাতে চাইছেন। অথচ বাঙালীরা যেখানে সংখ্যাগরিষ্ঠ সেখানে, তাদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযােগ আনা যায় কিনা, সেটা ভেবে দেখা দরকার । মুজিবরের সেই প্রশ্ন, “বাঙালীরা পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ । অতএব বাঙালীদের বিরুদ্ধে বিচ্ছিন্নতাবাদের অভিযোেগ কি করে আসে? সংখ্যাগরিষ্ঠরা কি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়?”

আজকের বাংলাদেশের এই বিশেষ আন্দোলনের চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গিয়েই প্রথমেই আমাদের বােঝা দরকার যে, এটা কয়েকদিনের প্রস্তুতিতে হঠকারী ‘বিপ্লব’ নয়; বহুদিনের বহু অভিজ্ঞতা, অনেক ত্যাগ ও কঠিন আত্মদানের মধ্যে দিয়ে ধীরে ধীরে সংগঠিত । এবং এ আন্দোলনের শ্রেণী-চরিত্র বিশ্লেষণ করতে গেলে প্রথমে জানা দরকার যে, এ আন্দোলন বিশেষ কোন একটা শ্রেণী বা গােষ্ঠী কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে না। এটা একটা ‘Mass movement’, এখানে একই “জয় বাংলা” পতাকাতলে সমস্ত শ্রেণী ও গােষ্ঠীর প্রতিনিধিরা এসে দাঁড়িয়েছেন। তবু একটা কথা এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, ওই বাংলায় যখন মুজিবরের নেতৃত্বে হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা জীবন-পণ করে সংগ্রাম করছেন তখন এই বাংলায় বসে কেউ কেউ মুজিবরের ও তার পার্টির রাজনৈতিক শ্রেণীস্তর বিশ্লেষণের চুলচেরা বিচারে ব্যস্ত রয়েছেন। এদের কাছে একটা কথা বললেই যথেষ্ট হবে যে, মুজিবরের আওয়ামী লীগ মােটেই কোন শ্রেণীগত দল নয়এখানে সমস্ত শ্রেণীর লােকেরই সমন্বয় ঘটেছে। তাই কম্যুনিস্ট বিরােধী’ যে মুজিবর মনে করেন, “একমাত্র আমিই পূর্ব পাকিস্তানকে ক্যুনিজম থেকে বাঁচাতে পারি (৩১ মারচ, আনন্দ বাজার পত্রিকা]”, সেই মুজিবরকে সমর্থন করছেন প্রবীণ ক্যুনিস্ট নেতা মৌলানা ভাসানী; এমন কী কট্টর চীনপন্থী কম্যুনিস্ট নেতা মহম্মদ তােহাও।

শুধু তাই নয়, পরিষ্কার ভাবে এটা বােঝা দরকার যে, পূর্ববাংলার বর্তমান আন্দোলন যে রূপ নিয়েছে, তা সম্পূর্ণ বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-এবং বলা বাহুল্য, এই সংগ্রাম জাতীয়তাবাদী শক্তির বন্ধনে বিকাশ লাভ করছে বলেই জাতীয় জীবন থেকে এর বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম এবং এরূপ ক্ষেত্রে জয় অনিবার্য- খুবই বেশী। তবু, একটা আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত জঙ্গী বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হতে গেলে বাংলার  সংগ্রামীদের কাছে এই মুহূর্তে প্রয়ােজন অন্যান্য দেশগুলির সাহায্য। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ ব্যাপারে পৃথিবীর বৃহত্তর শক্তিগুলাে প্রায় নির্বিকার রয়েছে। কেউ বা দৈর্ঘ্য-প্রস্থ মেপে মেপে নিচু গলায় মােখিক সহানুভুতি জানাচ্ছে।

৮ মে, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা