রাজধানী রাজনীতি বাংলাদেশের শরনার্থী আমাদের দায়িত্ব
— রণজিৎ রায়
কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম ও পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রী শ্রী আর, কে, খাদিলকার ৬মে দিল্লিতে এক প্রেস কনফারেনসে সাংবাদিকদের কাছে বাংলাদেশ থেকে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী চলে আসার গুরুত্বের কথা ব্যাখ্যা করেন এবং বলেন, এ সম্পর্কে বিশ্বের সমস্ত দেশের দৃষ্টি আকর্ষণ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। সাংবাদিকদের হাতে যে পুস্তিকা দেওয়া হয় তার নাম “পূর্ব বাংলা থেকে আগন্তুক শরণার্থী-একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব।” গত মারচের শেষের দিকে যখন প্রকৃতপক্ষে শরনার্থীদের আসা শুরু হয় তখনই ভারত সরকার আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়ার কথা ভেবেছিলেন, কিন্তু এও বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তাদের যে, সাহায্যের সবটুকু ভারত সরকারের হাতে পড়তে হবে এবং তার বিলি বণ্টনের ভারও তার হাতে থাকবে। কেননা, ভারতীয় সীমান্তে কোন কারণেই বিদেশী লােকজনের ভিড় সংযত হবে না। কিন্তু ঘটনার গুরুত্ব উপলব্ধি করে আজ ভারত সরকার তার সেই নির্দেশ কিছুটা শিথিল করতে চান। বিদেশীরা তাদের সাহায্যে নিজেরাই শরণার্থীদের মধ্যে বিলি-বণ্টন করতে পারবেন এখন থেকে। তবে, সেই আন্তর্জাতিক সাহায্যের পরিমাণ ও প্রকরন সম্পর্কে শ্রীখাদিকার কিছু মন্তব্য করেননি। | কেন্দ্রীয় সরকারের নজর বিশেষভাবে পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং মেঘালয় রাজ্যের প্রতি আছে, যাতে না সেই সব রাজ্যের সীমান্তে শরণার্থীর ভিড় বেশি হয়। রাজ্য সরকারের শরণার্থীখাতে যে অর্থব্যয়, তা পরিপূর্ণভাবে কেন্দ্র মিটিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন এবং সেই সূত্রে দিল্লি থেকে রাজ্যে রাজ্যে পুনর্বাসনকর্মী পাঠান হচ্ছে, যাতে সেবা ও পুনর্বাসনকর্ম নিখুত ও জোরদার করা যায়। সাধারণভাবে এমন একটা ধারণা দেশের মধ্যে চালু যে, আজকের এই শরণার্থী খাতে যা কিছু অর্থব্যয় তার সবটাই কেন্দ্র দেবেন। রাজ্য সরকারের এ ব্যাপারে প্রায়-কোন দায়িত্ব নেই। একথা মােটেই সত্য নয়। সরকারের দায়িত্ব বিশেষভাবে তাঁদের প্রতিই যারা ইতিমধ্যে বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় পেয়েছেন। কিন্তু আশ্রয়প্রাপ্ত এই শরণার্থীদের সংখ্যা তুলনায় অতি নগণ্য।
মােট শরণার্থীর এক তৃতীয়াংশের মতন হবে। এবং প্রসঙ্গত শ্রীখাদিলকার বলেন, এই আশ্রয়প্রাপ্ত শরণার্থীদের ক্ষেত্রে এপরিলের শেষ দিন পর্যন্ত ভারত সরকারের দশ কোটি টাকার মতন ব্যয় হয়েছে। এতাে গেল এক তৃতীয়াংশের কথা। বাকি দুই আর তিনভাগ শরণার্থীরা। আশ্রয় ও খাদ্য পেয়েছেন এপারের আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবের বাড়িতে। সীমান্তে বসবাসকারী মানুষজনও লক্ষণীয়ভাবে শরণার্থীদের সাহায্য করছেন। | কেন্দ্রের অর্থনৈতিক আদর্শকে কুর্ণিশ, যে-পূর্বের রাজ্যগুলিকে এই শরণার্থী সংকটের সবচেয়ে বেশি চাপ সহ্য করতে হচ্ছে। স্বাধীনতা-উত্তর কাল থেকেই উন্নয়ন প্রকল্পে তাদেরই ন্যায্য অংশ ফাকি পড়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের এই বিমাতৃসুলভ মনােভাবের জন্যে, এর আগে, অতীতে যখন উদ্বাস্তুরা পূর্ব বঙ্গ ছেড়ে পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরার মূলত এসে পড়েছিল এবং আংশিকভাবে আসামরাজ্যে তখন তাদের সর্বাঙ্গীন পূনর্বাসনের দিকটা তেমন গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। তাদের সুস্থ সামাজিক জীবনের কথা চিন্তা করা হয়নি। রাজনীতির দিক থেকে তারা একরকম বিস্ফোরক হিসেবেই থেকে গিয়েছিল। ওদিকে মেঘালয় রাজ্যেও বিশেষভাবে। শরণার্থী সংকটে পড়েছে। স্বয়ং-বিড়ম্বিত এই সব রাজ্যগুলির ব্যাপারে কেন্দ্র কিছু ভাবছেন কি? নিজেদের। আপনাপন সংকটে নাজেহাল এই সব রাজ্যে কিভাবে আজ এই অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করবে? এবং কতদিন? যে সংকটকে জাতীয় সংকট, সর্বভারতীয় মহাসংকট হিসেবেই গ্রহণ করার কথা, পূর্বপ্রান্তিক রাজ্যগুলি ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকার সে ব্যাপারে মােটামুটি নিরুদ্বিগ্ন বােধ হচ্ছে কেন এখনও? দেশের প্রধানমন্ত্রী এবং পুনর্বাসনমন্ত্রী ঘােষণা করেছেন, শরণার্থীদের সীমান্ত-বরাবর শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হবে। তার কারণ হিসেবে তারা বলেছেন বাংলাদেশের অবস্থা স্বাভাবিক হলেই তারা যাতে তাদের নিজ নিজ ঘরবাড়ি গেরস্থালিতে ফিরে যেতে পারেন, সেইজন্যেই সীমান্ত-বরাবর শিবিরে রাখার ব্যবস্থা। কিন্তু কতদিন তাদের এই শিবিরবাসী হয়ে থাকতে হবে তা একমাত্র ভগবানই জানেন। এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পযায়-অর্থাৎ যে পর্যায়ে পাকবাহিনীর সঙ্গে। মুক্তিযােদ্ধাদের মুখােমুখি লড়াই চলছিল, তার শেষ হয়েছে। এখন গেরিলা কায়দায় লড়াই চলছে। এবং এই গেরিলা-পদ্ধতির লড়াই স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। আমাদের সরকারও এ ব্যাপারে অনবহিত নন। এই যুদ্ধ এখন থেকে আর মাসের হিসেবে হতে পারে না, বছরের হিসেবে হবে। ইতিহাস তাই বলে। সুতরাং কেন্দ্রকে জিজ্ঞাস্য, এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে সীমান্ত প্রদেশের গ্রামাঞ্চল এই ক্রমবর্ধমান দীর্ঘস্থায়ী চাপ কীভাবে কতদিন সহ্য করবে? সরকার এ বিষয়ে কি কিছু ভেবেছেন?
পাকিস্তান সরকারের মনােভাব ভারতের অজ্ঞাত নয়। এই যুদ্ধ বাঁধিয়ে রেখে, নির্যাতন চালিয়ে লক্ষ লক্ষ লােককে নিহত করে পূর্বকে বানাবে সংখ্যালঘু পশ্চিমের কাছে। যাতে সংখ্যাগুরুত্বের দাবি তুলে স্বাধিকার এবং স্বাধীনতার কথা আর কোনােদিন না ওঠে। কেন্দ্রীয় সরকারের কেউ কেউ এমন কথাও মনে করেন, যদি বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে, সীমান্তে শিবিরে হােক, গেরস্তের বাড়িতে হােক, শরণার্থীদের মধ্যে অনেকেই আর দেশে ফিরে যেতে চাইবেন। কারণ হিসেবে তারা বলেন, পুর্ববাংলার আকাশ পশ্চিম বাংলাতেও বিস্তৃত, দুদিকের জল হাওয়া, মানুষজন, ভাষা আর মানসিক গঠন, হৃদয়বৃত্তি সবই প্রায় এক ধাচের। এবং তাদের মনাে ধাঁচে গড়া নয় এমন জনপদ থেকে স্বাভাবিক বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া অনেক সহজ। প্রতিকূল পরিবেশ থেকে মন নিজ দেশে ফিরতে উন্মুখ হবে। সেই পশ্চিম বাংলার সীমান্তে বা ভিতরে থেকে নাও হতে পারে। আরাে একটি সমস্যার কথা রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের দেখা উচিত হবে। স্বাভাবিক অবস্থা ফিরলে, যে সকল শরণার্থী এখানে তাদের বন্ধু এবং আত্মীয় স্বজনের কাছে আছেন, তাঁরা যেন যথাসময়ে দেশে ফিরে যান। তা না হলে, আজ যে রাজ্যে তারা আশ্রয় পেয়েছেন, সেই রাজ্য একদিন বিশেষভাবে বিব্রত হয়ে পড়বে। হয়তাে এমন একটি আশংকার কথা পূর্বপ্রান্তের রাজ্যগুলির মুখ্যমন্ত্রীদের মনে এসেছিল। তাই তারা দিল্লিতে ছুটে এসেছেন। প্রধানমন্ত্রীকে তাদের আশংকার কথাও জানিয়েছেন। শিবিরে আশ্রয় প্রাপ্ত শরণার্থীদের অন্যান্য রাজ্যগুলিতে স্থানান্তরের জন্যে আবেদন জানিয়েছেন। আশ্বস্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী তাঁদের। কিন্তু এখনাে পর্যন্ত সেই আশ্বাস কার্যকর হয়নি, দেখতে পাচ্ছি। প্রতি রাজ্যের প্রচার দফতরের মুখে কথার ফুলজুরি-সত্যিকারের জাতীয় সংকট এসেছে আজ। কিন্তু, বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখনাে শুধু কথায় চিড়ে ভেজেনি। কথাও চিড়ে ভেজেও না। দু’দিনের জন্যে হলেও, পূর্বাঞ্চলে ছাড়া অন্য কোনাে রাজ্যে শরণার্থীদের পুনর্বাসন দেবেন এমন কথা বলেননি, সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেননি কেউ।
১৯৪৭ সালের কথা। তখন পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন ডঃ প্রফুল্লচন্দ্র ঘােষ । কেন্দ্রের নির্দেশে তিনি বলেছিলেন, দেশভাগের জন্যে যেসব উদ্বাস্তু আসছেন, তাদের পুনর্বাসন দেওয়া ভারতবর্ষের দায়িত্ব নয় । তারা ফিরে যান। শ্রীঘােষ ছ’মাস বাদে মন্ত্রিত্ব হারালেন। তিনি গেলেন, কিন্তু হাজার হাজার ছিন্নমুল মানুষ তৈরি করে গেলেন যাদেরকে কোনােরূপ বন্ধনে বাঁধা যায় না। | ১৯৪৮-এ ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়ের মন্ত্রিত্ব শুরু। ততদিনে সেই সব শরণার্থী পুরােপুরি পথের ভিক্ষুকে পরিণত হয়েছে। নিজ হাতে আইনকানুনের দায়িত্ব তুলে নিয়েছে তাঁদের অনেকে। যে যেখানে পারছে বসে। যাচ্ছে, ঘরবাড়ি বানাচ্ছে। সুতরাং, সরকারের চোখ খুললাে। এক অংশকে পুনর্বাসন দেবার চেষ্টা হলাে। অল্পবিস্তর ক্যাশ-ডােল দেওয়া হলাে। প্রকৃতপক্ষে পুনর্বাসন দেবার ব্যাপার এখানে আজ পর্যন্ত করা হয়নি। | ১৯৫০ সালের সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামায় নতুন করে উদ্বাস্তু এলাে। তদানীন্তন পুনর্বাসন দফতরের মন্ত্রী শ্রী মােহনলাল সাকসেনা দৌড়ে কলকাতায় এলেন। কেন্দ্রের নির্দেশঃ সীমান্তের কাছে ক্যাম্প করে উদ্বাস্তুদের রাখতে হবে। ঠিক আজকে যে কথা যেভাবে উঠেছে, সেদিনও সেরকম কথাই উঠেছিল। আমাদের সরকারের দৃষ্টিকোণের বদল ১৯৬০, ১৯৬৪ তেও হয়নি। ১৯৫৭-তে তৎকালীন মন্ত্রী মেহেরচাদ খান্না শরণার্থী ঠেকাতে সীমান্ত বন্ধ করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এ-করে দু’দেশের মধ্যেকার সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা রুখতে পারেননি।
উদ্বাস্তুর আগমন স্বতই ঘটেছে। বিরাটভাবে হয়েছে। | কোনকালেই বিস্তৃতভাবে এবং বিশেষভাবে পুনর্বাসন-সমস্যাকে দেখা হয়নি। কিছু কিছু পরিবারকে পরীক্ষামূলক আন্দামান, দন্তকারণ্য প্রভৃতি জায়গায় টেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকি উদ্বাস্তুরা পশ্চিম বাংলার শহর-গ্রামে পচছে । এবং আমাদের সরকারের কাছে অতীতের কোন শিক্ষাই শিক্ষা নয়। অতীতেও যে-ভুল করেছেন আজও ঠিক সেই ভুলটি করতে চলেছেন। ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা শুরু হবার ঢের আগে থেকেই পশ্চিম বাংলা এবং ত্রিপুরা শরণার্থীর ভিড়ে প্রায় ভেঙেপড়ার অবস্থায় ছিল। আজকের সঙ্কটতাে আরাে মর্মান্তিক। গােটা শরণার্থী স্রোত পশ্চিম বাংলার দিক লক্ষ্য করে ছুটে আসছে। কোনরকম ব্যবস্থা না নিলে গােটা পুর্বাঞ্চলে সাংঘাতিক অবস্থা তৈরি হবে। কেন্দ্রের হুঁশিয়ার হওয়া দরকার।
১৩ মে, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা