You dont have javascript enabled! Please enable it! বাঙালী ফজলুল হক ফজলুল হকের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি -পার্থ চট্টোপাধ্যায় - সংগ্রামের নোটবুক

বাঙালী ফজলুল হক ফজলুল হকের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি

—পার্থ চট্টোপাধ্যায়

সেদিন ছিল ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল। ওপার বাংলার নবগঠিত যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভার মুখ্যমন্ত্রী শের-ই-বঙ্গাল  ফজলুল হক এসেছিলেন কলকাতা সফরে। সঙ্গে তার মন্ত্রীসভার অন্যতম তরুণ সদস্য শেখ মুজিবর রহমান। | একাশী বছরের যুবক বাঙ্গলার বাঘ-এর দৃপ্তকণ্ঠে সেদিন ধ্বনিত হয়েছিল, ‘জীবনের প্রান্তসীমায় পৌছে আমার আর কোন আশা বা আকাঙ্ক্ষা নেই। উভয় বঙ্গের মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর রচিত হয়েছে, তা অপসারিত করবার কাজ যদি আমি আরম্ভ করে যেতে পারি, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। দুই বাংলার। মধ্যে যে ব্যবধান আছে তা একটা স্বপ্ন ও ধােকা মাত্র। করুণাময় খােদাতাল্লার দরবারে আমার একটা মাত্র প্রার্থনা তিনি যেন এই ব্যবধান দূর করেন। আমার এই আকাক্ষা যাতে পূরণ হয় সেজন্য আপনারা আমাকে দোয়া করুন।’ ইতিহাসের অমােঘ নিয়তি-১৭ বছরের মধ্যে শের-ই-বঙ্গালের সেই প্রার্থনা ঈশ্বর পূর্ণ করলেন। আজ যখন রূঢ় সত্যের আগুনে দুই বাংলার কৃত্রিম চেক পােস্ট জ্বলে পুড়ে গেল, আজ যখন দুই বাংলার মানুষ এক সূত্রে সহস্র জীবন সমর্পণ করলেন তখন শের-ই-বঙ্গাল বেঁচে নেই।  ২৭ এপ্রিল শের-ই-বঙ্গালের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী পালিত হল। সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা এই যে, আজ অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশের জঙ্গীচক্র কবলিত পাকিস্তান বেতার থেকে খুব বড় গলা করে ঘােষণা করা হল শেরই-বঙ্গাল ফজলুল হকের জন্মবার্ষিকীর কথা। অথচ সুকৌশলে তারা চেপে গেল ফজলুল হকের সেই আপসহীন সংগ্রামী দিনগুলির কাহিনী । যেদিন তিনি পাকিস্তানের সামরিক চক্রান্তের বিরুদ্ধে দেশের মানুষকে সংগঠিত করে তুলেছিলেন। যেদিন পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি বৃহত্তর গণসংগ্রামের 

নেতৃত্ন করেছিলেন। যেদিন জনগণের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ফজলুল হককে পিন্ডির সামরিক চক্র করাচী থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে পা দেওয়া মাত্র গ্রেফতার করেছিল। পূর্ব বাংলার মানুষের কণ্ঠ রােধের ঘৃণ্যপ্রয়াস সেই প্রথম। ১৯৭১ সালে মুজিবর রহমান ও তার আওয়ামী লীগকে গ্রাস করার জন্য আজ যে ফেীজি অপচেষ্টা তার সূচনা আজ থেকে সতের বছর আগে। তিনি ছিলেন কী আচারে কী আচরণে সবটুকুই বাঙালী। সাধারণ বাঙালীর যা আছে তা থেকে একটি জিনিস তার বেশি ছিল তা হল প্রশস্ত হৃদয় । জন্মেছিলেন বরিশালের চাখার গ্রামের এক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে। রাজনীতির মতাে লেখাপড়াতেও তিনি সফল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেয়েছিলেন রসায়ন অঙ্ক ও পদার্থ বিদ্যার ট্রিপল অনার্স । জীবন শুরু করেছিলেন অধ্যাপক ও সাংবাদিক হিসাবে। সরকারী চাকরি করেছেন বছর ছয়েক। তারপর চাকরি ছেড়ে আইন ব্যবসায় এবং সেই সঙ্গে রাজনীতি। অবিভক্ত বাংলার আইনসভায় পার্লামেন্টারিয়ান ফজলুল হক আজও কিংবদন্তী হয়ে আছেন। অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে ফজলুল হকের অনেক ঐতিহাসিক স্মৃতি এখনও তার অনেক পুরােনাে সহকর্মী ও সরকারী অফিসারের হৃদয়ে। উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে।

দেশ বিভাগকে তিনি মন থেকে স্বীকার করেননি। ভাগ্যচক্রের আবর্তনে ইতিহাসের এই অনিবার্য পরিণতিকে মেনে নিতে হলেও তিনি দুই বাংলার কৃত্রিম সীমারেখাকে স্বীকার করেননি। বলেছিলেন, ‘এই কৃত্রিম সীমারেখা আমি মানি না। দুই বাংলার মানুষে মানুষে কোন ভেদ নেই।’ বলেছিলেন, ‘পাকিস্তান’ শব্দের কোন অর্থই হয় না। এই শব্দটির সৃষ্টি করেছে তারা যাদের কায়েমী স্বার্থ আছে। যারা ধাধা লাগিয়ে দিয়ে কাজ হাসিল করতে চায়। তার সে কথা সেদিন বুড়িগঙ্গা থেকে পদ্মা-মেঘনা ধলেশ্বরীর তুফান তুফানে সারা পূর্বদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। পূর্ব বাংলার নতুন জেনারেশন তারই সেই বাঙ্গালী জাতীয়তা, ঔদার্য ও সংস্কার মুক্তির মন্ত্রে। সঞ্জীবিত। আবুল কাশেম ফজলুল হক শুধু একজন মানুষ নন, একজন নেতামাত্র নন, তিনি একটি রেনেশাসের অগ্রদূত।

২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা