You dont have javascript enabled! Please enable it! ইতিহাসের আলােকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম - নারায়ণচন্দ্র চন্দ - সংগ্রামের নোটবুক

ইতিহাসের আলােকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম

— নারায়ণচন্দ্র চন্দ

১৯৭১ সনের ১৭ই এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মুজিবনগরে এক প্রাচীন আম্রকুঞ্জে আনুষ্ঠানিক ভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হল। অনুষ্ঠানটি অনাড়ম্বর ও সংক্ষিপ্ত কিন্তু এর গুরুত্ব অসাধারণ। যে রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে আত্মপ্রকাশ, ইতিহাসে এর অনুরূপ নজির হল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৫ বছর আগে (জুলাই ৪, ১৭৭৬) আমেরিকার ১৩টি উপনিবেশ ইংলন্ডের শাসন শােষণের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিল। সেদিন অমেরিকাবাসীর প্রধান অভিযােগ ছিল ইংলন্ডের অর্থনৈতিক শােষণের বিরুদ্ধে। একই জাতির লােক, উভয়ের ভাষা একই, তবু আমেরিকানরা তিন হাজার মাইল দূরে অবস্থিত ইংরেজদের প্রাধান্য ও সর্ব প্রকার আধিপত্য বিলােপ করতে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল। টমাস জেফারসন রচিত মারকিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি একটি বিখ্যাত ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়েছে, তার কারণ শুধু আমেরিকাবাসীর নয়, সমগ্র মানবজাতির মৌল অধিকারের কথা এতে ধ্বনিত হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণায় এই বিশ্বমানব দলিলের মূল যুক্তি আর একবার গৃহীত হল, আমেরিকানরা যে অধিকার আদায় করে নিয়েছিলেন, অনুরূপ পটভূমিকায় ও রক্তঝরা পরিবেশে বাঙালীরা তার জন্য সংগ্রাম শুরু করলেন। এই ঘােষণাপত্র আংশিক বাংলা অনুবাদ এখানে দিই, মনে হবে আমেরিকানদের ঘােষণা নয়, বাঙালীদের ঘােষণা।  ঘটনাপ্রবাহে যখন একটি জাতির পক্ষে অপর একটি জাতির সঙ্গে রাজনৈতিক বন্ধন ছিন্ন করা এবং প্রকৃতির ও তার স্রষ্টার নিয়মে বিশ্বের শক্তিগুলির মধ্যে পৃথক ও সমান আসন অধিকার করা প্রয়ােজন হয়ে ওঠে, তখন মানব জাতির মতামতের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের জন্যই পৃথক হওয়ার কারণগুলি ঘােষণা করা আবশ্যক হয়।

আমরা এই সত্য গুলি সর্বস্বীকৃত বলে বিশ্বাস করি ঃ সকল মানুষ সমান, স্রষ্টা তাদের যে অবিচ্ছেদ্য অধিকার দান করেছেন তার মধ্যে আছে জীবন, স্বাধীনতা ও সুখানুসরণের অধিকার; এই অধিকার লাভের উদ্দেশ্যে জনসাধারণের সম্মতি-ভিত্তিক সরকার গঠিত হয়; যখনই কোন সরকার এই উদ্দেশ্যে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়, তখন সেই জনসাধারণের সেই সরকারকে পরিবর্তন বা বিলােপ করে নূতন সরকার গঠনের অধিকার আছে।  যে যে কারণে আমেরিকার উপনিবেশ ইংলন্ডের শাসনের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিল, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সে সব তাে আছেই, তার অতিরিক্ত আছে। আমেরিকা ও ইংরেজদের ভাষা ছিল এক, সংস্কৃতির উৎস ছিল একই, ইংলন্ডের লােক নূতন মহাদেশে গিয়ে নূতন ইংলন্ড গড়ে তুলেছিল। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের লোেকদের সঙ্গে এই আন্তর যােগাযােগ নেই। উর্দুভাষী পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকের কাছে বাংলাভাষা ও বাঙালীর সংস্কৃতি নেহাৎ তুচ্ছ; বাঙালী গােলামের জাতি; বাংলাদেশের সম্পদ তাে তাদের ভােগের জন্যই। বাঙালীর শৌর্য তাদের কাছে অবজ্ঞার বস্তু। দুই দিনে তারা বাংলাদেশকে খতম করে দেবে আস্ফালন করেছিল। লম্বাচওড়া শক্তদেহের খানেরা কোমলদেহী বাঙালীকে তাচ্ছিল্য করেছে। পাথরের মধ্যে স্ফুলিঙ্গ থাকে বটে কিন্তু কোমলমেঘের মধ্যে লুকিয়ে থাকে পর্বতবিদীর্ণকারী বজ্র। বাঙালী এই শক্তি পরীক্ষায় অবতীর্ণ। | আমেরিকার স্বাধীনতা ঘােষণার পর বৃটিশ সরকার স্বেচ্ছায় উপনিবেশ ছেড়ে দেয়নি; রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ভিতর দিয়ে বিপুল অস্ত্রবল নিয়ে বিদ্রোহীদের দমন করে শােষণ ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার চেষ্টা করেছিল। প্রথম যুদ্ধে পেশাদার ইংরেজ সৈন্যের বিরুদ্ধে জরজ ওয়াশিংটনের সৈন্যবাহিনী পরাজিত ও দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত হল। এদের তখন চরম সংকটকাল। তাদের উদ্যম কি ব্যর্থ হয়ে যাবে? একটি মহাদেশ কি চিরদিন ক্ষুদ্র দ্বীপের পদানত হয় থাকবে? মাকড়সা যেমন নিজের চেয়েও বৃহৎ পতঙ্গকে জালে আদ্ধ করে তার প্রাণরস শােষণ। করে নেয়, সেইরূপ জালবদ্ধ পতঙ্গ হয়ে থাকাই কি তাদের বিধিলিপি? এইরূপ চিন্তায় সবাই যখন ভারাক্রান্ত সেই সময় স্বাধীনতা যযাদ্ধাদের মনােবল ফিরিয়ে আনতে ও জয়লাভে উদ্বুদ্ধ করতে ইংরেজ লেখক টমস পেইন যে পুস্তিকা লিখেছিলেন, আমেরিকাবাসীর মনে তা অভূতপূর্ব উদ্দীপনার সঞ্চার করেছিল। শােনা যায়,  সৈন্যশিবিরে বসে যুদ্ধদামামার চামড়ার ওপর পেইন এই মৃতসঞ্জবনীসম কথাগুলি লিখেছিলেন। জরজ ওয়াশিংটন নিজে পড়ে অভিভূত হয়েছিলেন, সৈন্যদলের কাছে উচ্চকণ্ঠে পাঠ করে শােনানাের ব্যবস্থ করেছিলেন। এই লেখা সেদিন স্বাধীনতার সৈনিকদের উৎসাহিত করেছিল। সর্বদেশে এবং সর্বকালে মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে এটি প্রাণমাতানাে আহ্বান। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর কাছে মনে হবে এটি তাদেরই উদ্দেশ্যে রচিত এক উদার দেশ প্রেমিকের বিদ্যুৎসঞ্চারী বাণী। ‘সংকট’ শীর্ষক রচনার প্রথম ও শেষ অংশের অনুবাদ দিচ্ছি ।

এই সময় মানুষের অন্তরাত্মার পরীক্ষার সময়। সুদিনের সৈনিক (সামার সাের্জার) ও সুখান্বেষী দেশ প্রেমিক (সানসাইন পেট্রিয়ট) এই সংকটকালে দেশের সেবা থেকে পিছিয়ে পড়বে কিন্তু যে ব্যক্তি এই সময়ে বুক ফুলিয়ে রুখে দাঁড়াবে, সে-ই নরনারীর ভালবাসা ও ধন্যবাদের যােগ্য। স্বৈরাচার নরকের অত্যাচারের মত সহজেই দমিত হয় না; তবু আমাদের এই সান্ত্বনা আছে যে, সংগ্রাম যত কঠিন হবে, বিজয় হবে তত গৌরবময় । যা আমরা অল্পয়াসে অর্জন করতে পারি, তার মূল্য দিই খুব কম। যে জিনিস যত মহার্ঘ, তা তত মূল্যবান। কোন্ জিনিসের কি রকম মূল্য নির্ধারণ করতে হয়, তা ঈশ্বরের জানা। যদি স্বাধীনতার মত স্বর্গীয় বস্তুর জন্য উচ্চমূল্য নির্দিষ্ট না হত, তবে তা সত্যই বিস্ময়ের ব্যাপার হত। বৃটেনের তার স্বৈরাচার প্রয়ােগ। করার জন্য সৈন্যবাহিনী নিয়ে ঘােষণা করেছে, আমাদের সর্বপ্রকারে বেঁধে রাখার অধিকার তার আছে। এইভাবে বন্ধন অবস্থা যদি দাসত্ব না হয়, তবে পৃথিবীতে দাসত্ব বলে কিছু নেই। আমরা আবার মিলিত হয়েছি। আমাদের মহাদেশের উত্তর ও দক্ষিণ অংশে নূতন সৈন্য সংগ্রহের কাজ চলছে। অস্ত্রে ও পােষাকপরিচ্ছদে সজ্জিত ৬০ হাজার সৈন্য নিয়ে আমরা পরবর্তী অভিযান আরম্ভ করতে পারব। এই হল আমাদের অবস্থা। ধৈর্য ও অধ্যবসায় প্রয়ােগ করে আমরা আশা করতে পারি গৌরবােজ্জ্বল। সুফল। ভীরুতা ও আত্মসমর্পণের ফল হবে নানা দুর্ভোগ বিধ্বস্ত দেশ, জনশূন্য নগর,- নিরাপত্তাবিহীন। বাসস্থান, আশাহীন দাসত্বআমাদের বাড়িগুলি হবে দখলদার সৈন্যদের আবাস ও কুৎসিত লীলাক্ষেত্র আর আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর হবে পিতৃত্বের পরিচয়হীন। এই চিত্র অবলােকন করুন, এর জন্য অশ্রুপাত করুন। তা সত্ত্বেও যদি এমন কোন মূঢ় নরাধম থাকে যে এগুলি বিশ্বাস করে না, তার ফল সে ভােগ করুক; তার জন্য কেউ বিন্দুমাত্র শােক করবে না।-টমাস পেইন, ডিসেম্বর ২৩, ১৭৭৬ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে, এই সত্য প্রমাণিত হল। জীবন, স্বাধীনতা সুখানুসরণের অধিকার অর্জন করতে আমেরিকানরা যে দুঃখদুর্দশা ও সংকটের সম্মুখীন হয়েছিলেন, আজকের বাংলাদেশের অধিবাসীরা ঠিক সেই সংকটের আবর্তে। সেদিন ফ্রান্স লা-ফায়েতের অধিনায়কত্বে স্বেচ্ছাসৈনিক নিয়ে মারকিন মুক্তি ফৌজের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশের পাশে এখনাে কোন মানবদরদী লা-ফায়েৎ আসেননি। কিন্তু ইতিহাসের নিয়ম যদি অমােঘ হয়, বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম হবে না।

২৭ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা