You dont have javascript enabled! Please enable it!

রাজধানী-রাজনীতি স্বাধিকারের দাবি ও দেশে, এ দেশে

— রণজিৎ রায়

তামিলনাড়ুর ডি-এম-কে রাজ্যগুলির হাতে অধিকতর ক্ষমতা দেওয়ার দাবির অভিযান নতুন করে শুরু করেছে। ঐ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এর জন্য সংবিধান সংশােধন করার কথা বলেছেন। পঞ্চাশের দশকে ঐ দল। ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার যে মনােভাব পােষণ করত, এখনকার দাবির সঙ্গে তার অনেক ফারাক। পুরােনাে সেই দাবিকে তৃতীয় সাধারণ নির্বাচনের পরই ডি-এম-কে বিদায় দেয়। ভারত সরকার হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। | তবু, শ্ৰী করুণানিধি রাজ্যের স্বায়ত্তাধিকার সম্পর্কে যা বলেছেন তা নতুন কিছু। সাম্প্রতিক এক ভাষণে তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন যে, গত মারচ মাসে শ্রীমতী গান্ধী যখন ডি-এম-কের সঙ্গে নির্বাচনী আঁতাত করেন তখন প্রধানমন্ত্রী তামিলনাড়ুর এই দলটির মনােভাব ভালাে করেই জানতেন। ভারত বিশাল দেশ। তার 

বিভিন্নরাজ্য উন্নয়নের বিভিন্ন স্তরে রয়েছে। এমতাবস্থায় বিভিন্ন রাজ্যে অসন্তোষ দেখা দিতে বাধ্য। রাজ্যের স্বায়ত্তাধিকার সংক্রান্ত দাবির প্রশ্নটি নয়াদিল্লি একটা অবস্থা পর্যন্ত প্রশ্রয়ের মনােভাব নিয়ে দেখতে রাজি। তবু নয়াদিল্লিতে এ প্রশ্নে নতুন উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। তার কারণ- শ্রীকরুণানিধি ভারত সরকারকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে বলে দিয়েছেন। এধরনের বিবৃতি থেকে স্বভাবতই মনে হয়- ডি-এম-কের মতে রাজ্যগুলিকে অধিকতর ক্ষমতা না দিলে ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রবণতা দেখা দিতে পারে। তুলনাটা নয়াদিল্লির মােটেই পচ্ছন্দ নয়; কিন্তু তুলনাটা একেবারে বস্তুশূন্যও নয়।

ভারতে অবশ্য নাগাভূমি এবং মিজোপাহাড়ের কোন কোন এলাকা বাদ দিলে অন্য কোথাও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন নেই। কাশ্মীরের কথা স্বতন্ত্র। পানজাবি সুবা আন্দোলন এক সময় যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়িয়েছিল; কিন্তু হরিয়ানা রাজ্যের সৃষ্টির পর তা কেটে গিয়েছে। সীমানা নিয়ে পানজাবের কিছু অসন্তোষ অবশ্য আছে। কিন্তু সে সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম। বাংলাদেশের ঘটনা প্রথমে পশ্চিমবঙ্গে এবং পরে ভারতের অন্যান্য রাজ্যে অবাঞ্ছিত প্রভাব ফেলতে পারে, কোন কোন মহলে আশংকা দেখা দিয়েছে। সাম্প্রতিক কালে সি পি এম পশ্চিমবঙ্গকে নয়াদিল্লির উপনিবেশ বলে বর্ণনা করে তার হাতে অধিকতর আর্থনীতিক ও রাজনীতিক ক্ষমতা তুলে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

তবে সি পি এম যে পশ্চিমবঙ্গকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চায় না সে কথাটা ঐ দলের নেতারা। প্রায় পরিষ্কার করেই বলে দিচ্ছেন। সম্প্রতি নয়দিল্লির এক সভায় সি. পি. এম. নেতা শ্রীজ্যোতিবসু বলেছেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রতি দিল্লির আচরণের সঙ্গে বাংলাদেশের প্রতি ইসলামাবাদের আচরণের গুণগত পার্থক্য আছে। তিনি তার বক্তব্য ব্যাখ্যা করেন নি; তবে একথা বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের ন্যায়বিচারের দাবির অর্থ রাজনীতিক বিচ্ছিন্নতা নয়; তার অর্থ এমন এক সংবিধান যা রাজ্যগুলিকে আরাে ক্ষমতা দেবে। | সংবিধান সংশােধনের কথা নব কংগ্রেসও বলছে, তবে তা অন্য কারণে। কেন্দ্রকে আরাে শক্তিশালী করার জন্য। দক্ষিণপন্থী দলগুলিও তাই চায়। তবে, নব কংগ্রেস মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত ধারাগুলিও সংশােধন করতে চাওয়ায় ওসব দলের যত আপত্তি। সংবিধান চালু হওয়ার পর থেকে নানা সংশােধনের দ্বারা কংগ্রেস দল কেন্দ্রের হাতে অনেক ক্ষমতা তুলে। 

দিয়েছে। কিন্তু ১৯৬৭ সালে কংগ্রেসের গরিষ্ঠতা কমে যাওয়ার পর থেকে তা করা অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। তবে, গত চার বছরে বিশেষ বিশেষ ধারার নতুন ব্যাখ্যার দ্বারা কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যপালদের হাতে অনেক ক্ষমতা তুলে দিয়েছেন; সঙ্গে সঙ্গে রাজ্যগুলির ক্ষমতা সঙ্কুচিত হয়ে এসেছে। | রাজ্যের হাতে বেশী ক্ষমতা দেওয়ার জন্য ডি, এম, কে যে দাবি তুলেছে সি, পি, এম নেতা শ্রীনামবুদিরিপাদ তাকে স্বাগত জানিয়েছেন। ডি, এম, কে একই দাবি তােলায় সি, পি, এমের দাবি আরাে শক্তি পাবে বলে সি-পি-এম নেতারা মনে করেছেন। কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্ক বিবেচনা করা এবং সংবিধান নির্দেশিত পথে রাজ্যগুলিকে তাদের কর্তব্য পূরণ করতে হলে সংবিধানের কী ধরনের সংশােধন প্রয়ােজন তা স্থির করার জন্য শ্রীকরুণানিধি একটি কমিশন গঠন করেছেন। কমিশনের রিপােরট এখনাে প্রকাশিত হয়নি। ইতিমধ্যে তামিলনাড়ুর মূখ্যমন্ত্রী তার রাজ্যের জন্য একটি পৃথক যােজনা কমিশন গঠন করেছেন। ব্যাপারটা নয়াদিল্লির মনঃপূত হয়নি। শুধু ডি, এম, কে এবং সি.পি. এমই রাজ্যগুলির জন্য অধিকতর ক্ষমতা চায় ভাবলে ভূল করা হবে। কোন রাজ্যই চলতি ব্যবস্থায় সন্তুষ্ট নয়। এব্যাপারে কংগ্রেসী আর অকংগ্রেসী রাজ্যে কোন পার্থক্য নেই। প্রত্যেক ফিনানস কমিশনকেই টাকার জন্য কাড়াকাড়ি দেখতে হয়। জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের প্রতি বৈঠকেই কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের ছবি ফুটে ওঠে। শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রে যেসব রাজ্যের রাজনীতিক ব্যাকিং’ আছে তারাই পকেট ভরতে পারে। তাছাড়া নিজের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিমাণ করে অন্যদের মধ্যে কিছু কিছু করুণা। বিতরণ করে- এমন একটা অভিযোেগও বহু পুরােনাে।

কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিটি বাজেট রাজ্যগুলির বাজেটকে তছনছ করে দেয়। প্রচুর মুদ্রাস্ফীতি এবং পরােক্ষ করের দায় রাজ্যের উপর এসে পড়ে। এতে রাজ্যের আর্থিক ও প্রশাসনিক দায় অনেক বেড়ে যায়। অথচ এ ব্যাপারে রাজ্যের পরামর্শ নেওয়া হয় না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কেন্দ্র নিয়মিত নিজের কর্মীদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে; কিন্তু রাজ্যগুলি তা করতে গেলেই কেন্দ্রের কপাল কুঁচকে ওঠে। দ্রব্যমূল্য। বাড়ার ফলে শ্রমিক অশান্তি দেখা দেয়; তা সামলাবার দায় রাজ্যের। রাজ্য তার সেবামূলক কাজের জন্য। বেশি দাম আদায় করতে বাধ্য হয়। লােকের রাগ গিয়ে পড়ে রাজ্য সরকারের উপর।  কেন্দ্রকে যে শক্তিশালী করা দরকার সে সম্পর্কে কোন সংশয় নেই। কিন্তু যে পদ্ধতিতে তা করা হচ্ছে অনেকেরই আপত্তি সে সম্পর্কে । শ্রীকরুণনিধির মতে রাজ্যগুলি দুর্বল হয়ে পড়ে থাকলে কেন্দ্র কখনাে শক্তিশালী হতে পারবে না। কথাটা প্রায় কুড়ি বছর আগে শ্রী বিধান চন্দ্র রায়ও বলে গিয়েছেন- বালির ভিতের উপর অট্টালিকা গড়ার চেষ্টা বােকামি।

ব্রিটিশ শাসকরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার সময় কংগ্রেস দল শক্তিশালী কেন্দ্রই চেয়েছিল। কংগ্রেস লড়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের জন্য। কিন্তু ক্ষমতায় এসে সে দল এমন এক সংবিধান খাড়া যা শুধু নামেই যুক্তরাষ্ট্রীয়; কার্যত সকল কার্যকর ক্ষমতা দেওয়া হল কেন্দ্রকে। সমাজ সেবামূলক কাজের দায়িত্ব রাজ্যের; কিন্তু তা করার জন্য যে সম্পদ দরকার তা থেকে তাদের বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে। সংবিধান সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ কমিটি যে সব সুপারিশ করেছেন কংগ্রেস দল সেগুলি মেনে নিলে রাজ্যগুলি তাদের দায়িত্ব আরাে ভালােভাবে পালনের জন্য অর্থ হাতে পেতাে। | কেন্দ্র-রাজ্য বিবাদের সম্ভাবনা আমাদের সংবিধানেই অন্তর্লীন হয়ে আছে। কেন্দ্র বেশী করে ক্ষমতা অর্জন করে এ সব অসুবিধা কাটিয়ে উঠতে চায়। রাজ্যগুলি প্রকাশ্যেই হােক, আর অপ্রকাশ্যেই হােক, এ মনােভাবের বিরােধী। এর সন্তোষজনক সমাধান আশু হবে বলে মনে হচ্ছেনা। তবে এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের উদাহরণ টেনে এনে শ্রী করুণানিধি কেন্দ্র রাজ্য সম্পর্কের মধ্যে এক নতুন তীব্রতা সঞ্চার করে দিয়েছেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছা বােধহয় সেরকম ছিল না।

২৮ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!