You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজ্য-রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে বেশি প্রয়ােজন সংগঠন - বরুণ সেনগুপ্ত - সংগ্রামের নোটবুক

রাজ্য-রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায়ে বেশি প্রয়ােজন সংগঠন

— বরুণ সেনগুপ্ত

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম পর্যায় কার্যত শেষ । এরপর শুরু হবে দ্বিতীয় পর্যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ের মধ্যে ঠিক কতদিনের প্রস্তুতি পর্ব চলবে এখনই তা বলা কঠিন। সামরিক প্রস্তুতির প্রশ্নতাে আছেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির ঘটনাপ্রবাহের উপরও পরবর্তী পর্যায়ের লড়াইয়ের দিনক্ষণ অনেকটা নির্ভর করবে।  প্রথম পর্যায়ের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বলা চলে স্বতস্ফূর্ত প্রতিরােধের পর্যায়। কোনও প্রস্তুতি ছাড়াই এই পর্যায়ে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ, বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবকরা, বাংলাদেশের বাঙালী সৈনিক ও পুলিশ যে বীরত্বপূর্ণ লড়াই চালিয়েছেন তার তুলনা নেই। দীর্ঘ প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে খুব সামান্য অস্ত্র সম্বল করে এবং অতি সামান্য সাহায্য নিয়ে তারা যেভাবে সর্বপ্রকারের আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত এবং লড়াইয়ের কলাকৌশলে শিক্ষিত ও সংগঠিত একটা বিরাট দানবীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই চালিয়েছেন তা বিশ্বের সব বাঙালীর পক্ষেই গৌরবের। | প্রস্তুতি তাদের ছিল না বললেই চলে। রাজনৈতিক নেতারা প্রস্তুতি গড়ার জন্য আরও কিছুটা সময় নিতে চেয়েছিলেন। শােনা যায়, শেখ মুজিবুর রহমান ভেবেছিলেন, দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাতে নিয়ে একবছরের মধ্যেই বাংলাদেশে একটি মুক্তিসেনাবাহিনী গড়ে তুলবেন। আপাতত তিনি ছয় দফা দাবির ভিত্তিতেই দেশের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব হাতে নিতে চেয়েছিলেন। আপাতত পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামাের মধ্যে থাকতে তার আপত্তি ছিল না। পুর্ণ স্বাধীনতার দাবী তুলতেন আগামী বছর। ইতিমধ্যে গড়ে উঠত মুক্তি সেনাবাহিনী। সরকারী ক্ষমতা হাতে থাকলে এই মুক্তি সেনাবাহিনী গড়ার কাজেও প্রচুর সুবিধা হত। শােনা যায়, তারপর অনিচ্ছুক পাক কর্তৃপক্ষের হাত থেকে জোর করে পূর্ণ স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়াই ছিল শেখ সাহেবের পকিল্পনা।

কিন্তু সে পরিকল্পনা মত এগােতে পারলেন না। কারণ, প্রথমত পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ নির্বাচনের রায় মানতেই রাজি হলেন না। তারা জাতীয় পরিষদের বৈঠক বন্ধ করে দিলেন। এবং দ্বিতীয়ত, জনসাধারণের একাংশ, বিশেষ করে ছাত্ররা অবিলম্বে স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য চাপ দিলেন। ফলে, শেখ সাহেবকে তাঁর  পরিকল্পনার চেয়েও দ্রুত গতিতে এগিয়ে যেতে হল। | তারপর যা হল সেটা ইয়াহিয়া খাঁর চাতুরীর সাফল্য এবং শেখ সাহেবের সততার পরিণতি। ইয়াহিয়া খ দিনের পর দিন বসে শেখ সাহেব এবং আওয়ামী লীগকে ভুল বােঝালেন। শেখ সাহেব যা দাবী করেন, ইয়াহিয়া তার চেয়েও বেশী মেনে নেন। ইয়াহিয়া বারবার শেখ সাহেবকে বলেন ? আপনিই তাে উজিরে আজম হবেন, আপনার দয়ার উপরইতাে আমাকে নির্ভর করতে হবে, আপনার দাবি না মেনে পারি। সর্বতােভাবে আওয়ামী লীগকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করলেন ইয়াহিয়া খা।

সেদিন একজন বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতাকে জিজ্ঞেস করা হয়, “আচ্ছা আপনারা ইয়াহিয়ার চক্রান্তটা ধরতে পারলেন না কেন?” সেই নেতা বিস্তারিতভাবে বললেন সব ঘটনা। তারপর বললেন ঃ এইভাবে কোনও মানুষ ছলনা করতে পারে, মিথ্যাচারণ করতে পারে তা আমরা একবারও বুঝতে পারিনি। কোনও মানুষের পক্ষে তা বােঝা সম্ভব নয়। তিনি আরও বললেন ঃ যখন সমগ্র বিশ্ব এই আলােচনার বিবরণ জানতে পারবে তখন বুঝবে ওঁরা কত অসৎ, কত বড় মিথ্যাবাদী। সময় হলে সুযােগ এলে আমাদের নেতাই বিশ্ববাসীকে সব জানাবেন। বললেন, আমরা ভুল করেছিলাম সন্দেহ নেই। এখন তা কারওই বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু ইয়াহিয়া গােষ্ঠী ওই দশদিন যেভাবে কথাবার্তা বলেছেন, যেভাবে আচরণ করেছেন তাতে অনেকেই এমন ভুল করতেন। কোনও মানুষের মুখের সব কথা অবিশ্বাস করা যায় কী করে বলুন। | ওঁরা অর্থাৎ আওয়ামী লীগ নেতারা গােড়াতেই একটা বড় ভুল করেছিলেন। ওঁরা বুঝতে পারেননি ইয়াহিয়া এবং পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠী কী। পরবর্তী ঘটনাবলী অবশ্য সমগ্র বিশ্বের কাছে প্রমাণ করেছে, ওরা পশুর চেয়েও অধম। 

২৫ মারচ বিকেলে আওয়ামী লীগ নেতারা সবটা বুঝতে পারলেন। তখন অবশ্য চুড়ান্ত মুহূর্তের কয়েকঘণ্টা মাত্র বাকি। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ তখন সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত। আওয়ামী লীগের পালটা প্রস্তুতির তখন আর কোনও সময় নেই। | যদি আওয়ামী লীগ নেতারা আগে থেকে প্রস্তুত হয়ে থাকতে পারতেন, তা হলে প্রথম পর্যায়ের লড়াইটা শুধু স্বতস্ফূর্ত প্রতিরােধ না হয়ে হত সংগঠিত গণ-প্রতিরােধ । যদি তারা আগে থেকেই গােটা পূর্ব বাংলার বাঙালী সৈনিক ও ই পি আর জওয়ানদের সঙ্গে যােগাযােগ করে রাখতেন, যদি পূর্ব বাংলার সেনাবাহিনী ও ই পি আরের বাঙালী অংশ, আনসার, মােজাহিদ এবং পুলিশ বাহিনীর মধ্যে আগে থেকেই একটা বােঝাপড়া হয়ে থাকত, তাহলে প্রথম পর্যায়ের লড়াইটা আরও জোর হত- পাক হানাদাররা আরও বড় আঘাত পেত। ভারী অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসাররা সরিয়ে নিতে পারত না। আর, পাক বাহিনী যেমন সমগ্র পূর্ববাংলায় ঠিক হাতে পেলেন তাই নিয়েই। তখন করেছে তেমনি মুক্তি বাহিনীও সর্বত্র এই সঙ্গে প্রতিআক্রমণ শুরু করতে পারতেন।

কিন্তু আগে থেকে কোনও যােগাযােগ না থাকায় তা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রামে যখন প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু হয়েছে তখনও ঢাকায় প্রতি আক্রমণ শুরু হতে পারেনি। আবার, ঢাকা এবং চট্টগ্রামে যখন লড়াই চলেছে তখনও অধিকাংশ জেলা শহরে সেনাবাহিনী প্রায় এক তরফা আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছে। যখন সর্বত্র প্রতিরােধ লাড়ই শুরু হল, যখন অধিকাংশ বাঙালী সেনা, ই পি আর, আনসার, মােজাহিদ এবং পুলিশ পশ্চিম পাকিস্তানী। হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যােগ দিলেন তখনও তাদের মধ্যে একটা সুষ্ঠ কমাণ্ড গড়ে উঠতে পারল না। তারা যে যেমন পারলেন লড়াইয়ে নেমে পড়লেন। ছাত্র এবং যুবকরাও তাদের সঙ্গে এসে যােগ দিলেন। যে যা হাতে পেলেন তাই নিয়েই তখন কমাণ্ড এবং নিজস্ব যােগাযােগ গড়ে তােলার মত সময় এবং সুযােগ তাদের ছিল না।

 তার উপর তাদের হাতে শুধু হালকা অস্ত্র। তাও গােলাগুলির অভাব। পারস্পরিক যােগাযােগের বেতার যন্ত্র নেই, নেই দ্রুত একস্থান থেকে অন্যত্র যাওয়ার মত প্রয়ােজনীয় সংখ্যায় গাড়ি। অন্যদিকে পাক সেনাবাহিনীর হাতে রয়েছে সব। তারা আগে থেকেই প্রস্তুত। তাদের অফুরন্ত গােলাগুলি। তাদের সঙ্গে অসংখ্য গাড়ি। তাদের রয়েছে ট্যাঙ্ক। সর্বোপরি তাদের হাতে প্রচুর ভারী ও দূরপাল্লার কামান এবং জঙ্গী বিমান। এইসব অসুবিধা সত্ত্বেও মুক্তি সেনাবাহিনী যেভাবে গত প্রায় একমাস যাবত লড়াই করছেন তার তুলনা নেই। এই লড়াই তারা চালাতে পেরেছেন কারণ এটা তাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম- কারণ এই সংগ্রামে তাঁদের সঙ্গে সাড়ে সাত কোটি মানুষ।

দ্বিতীয় পর্যায়ের মুক্তিযুদ্ধ কিন্তু হবে সুসংগঠিত সংগ্রাম। এই লড়াই মুক্তি যােদ্ধাদের একটা কমাণ্ড থাকবে। থাকবে অনেক বেশি হাতিয়ার, ভাল যােগাযােগ ব্যবস্থা এবং সর্বোপরি লড়াইয়ের একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনা। তখনও অস্ত্রশস্ত্রে তারা পাক হানাদারদের চেয়ে দুর্বল থাকবেন, এখনও তাদের জঙ্গী বিমান ছাড়াই লড়তে হবে। কিন্তু তবু এই লড়াইয়ে তারা অনেক বেশি সাফল্য করবেন বর্ষা তাদের পক্ষে যাবে। বর্ষা পাকিস্তানী ফেীজের চলাচলে ব্যাঘাত ঘটাবে। বর্ষা জঙ্গীবিমানকে অনেকটা বেকায়দায় ফেলবে। বর্ষায় ছােট ছােট স্থানীয় ফৌজের চলাচলে সুবিধা হবে। তাই, পাকিস্তানী ফৌজকে এবার অনেক বেশী বেকায়দায় পড়তে হবে। তবে, এসব সত্ত্বেও যতক্ষণ না মুক্তিবাহিনীর হাতে ভারী ও দূরপাল্লার কামান আসছে ততক্ষণ পাক সেনাবাহিনীকে বড় বড় মজবুত ক্যান্টনমেন্টগুলি থেকে একেবারে বিতাড়িত করা সহজ হবে না।  দ্বিতীয় পর্যায়ে লড়াইয়ের জন্য মুক্তি বাহিনীকে যেমন সামরিকভাবে সবরকমে প্রস্তুত হতে হবে, তেমনি গােটাদেশে অসামরিক সংগঠন গড়া এবং সুষ্ঠু সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করার দিকেও বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতাদের বিশেষ নজর দিতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন মনে করেন, এ দুর্দিনেও বাংলাদেশের সরকার তাদের যথাসম্ভব সাহায্য করছেন। বাঙ্গালা দেশের মানুষের উপর নারকীয় অত্যাচার চলেছে এবং চলবে। বিপর্যস্ত অর্থনীতি তাদের  আরও বড় বিপদে ফেলেছে। আজ তাদের সবকিছুরই প্রচণ্ড অভাব। আজ তাদের বড় দুর্দিন। এই সুযােগে সাধারণ মানুষের মনােবল ভাঙ্গার জন্য পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং তাদের অনুচররা সর্বতােভাবে চেষ্টা করবে। বাংলাদেশের সরকারকে এই ব্যাপারে সবচেয়ে বেশী সক্রিয় ও সচেতন হতে হবে। এইজন্য একদিকে যেমন চালাতে হবে সামরিক প্রস্তুতি, অন্যদিকে তেমনই গড়ে তুলতে হবে অসামরিক সংগঠন- যে সংগঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্ট যতটা সম্ভব লাঘবের চেষ্টা করতে হবে, তাদের কাছে পৌছে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে সবরকমের সাহায্য।

২৩ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা