You dont have javascript enabled! Please enable it!

কয়েকটি ছােটখাটো জরুরি বিষয়

—  নীললােহিত

ভূতপূর্ব পূর্ব পাকিস্তান থেকে যখন কোনাে কবি, গল্পকার বা অধ্যাপক কলকাতায় আসতেন, তখন তাদের সঙ্গে আলাপের প্রথম কয়েকটি মুহূর্তে একটা সূক্ষ্ম অসুবিধে বােধ করতাম। পরস্পর নাম জানাজানির পর প্রথম সম্বোধনটা কি রকমভাবে হবে?  হিন্দু পরিবারভুক্ত বাঙালীরা সদ্য পরিচয়ের পর হাত তুলে বলে, নমস্কার। করতল দুটি যুক্ত হয়ে, কপাল বা বুকের কাছে চলে আসে। অভ্যেসবশত আমিও প্রথম প্রথম তাই করতাম। কিন্তু লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের মুসলমানদের মধ্যে হাত জোড় করে নমস্কার প্রথা সাধারণভাবে প্রচলিত নেই। কেউ কেউ আমার নমস্কারের উত্তরে ঐ ভঙ্গিতে প্রতি নমস্কার করেননি।

তারপর থেকে আমি পূর্ব বাংলার সদ্য পরিচিত মুসলমান বন্ধুদের দেখাদেখি শুধু ডান হাতখানা কপালের কাছাকাছি তুলে সেলামের ভঙ্গি করতাম সম্প্রীতির বিনিময় একই প্রকারের না হলে ঠিক সাবলীল হওয়া যায় মাঝখানে একটু ব্যবধান থেকেই যায়। সাহেবদের সঙ্গে পরিচয় হলে আমরা তাদেরই প্রথায় শেক হ্যান্ড করি। পশ্চিম বাংলার অনেক মুসলমান বন্ধু আমাদের সঙ্গে ঠিক একইভাবে হাত তুলে বলেন, নমস্কার । যদিও, পশ্চিম বাঙলার গ্রামে-মফঃস্বলে সাধারণ অপরিচিত মুসলমানকে কখনাে হাত তুলে নমস্কার করতে দেখিনি। সাধারণ হিন্দুও ডান হাত তুলে সেলাম করতে চায়না। দু’একদিন আগে স্বাধীন বাংলার একজন মুক্তিসেনার সঙ্গে পরিচয় হবার পর, আমরা দুজনেই দু’এক মুহূর্ত দ্বিধা করার পর দুজনেই হাত বাড়িয়ে করমর্দন করলাম। তারপর থেকেই ভাবছি, স্বাধীনবাংলা ও পশ্চিম বাংলায় সমস্ত হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে সম্বােধন ও প্রীতি বিনিময়ের একটি সাধারণ প্রথা থাকা কি উচিত নয়? সাহেবদের সঙ্গে করমর্দন করি, তারা খৃষ্টান বলে নয়অখৃষ্টান সমাজতান্ত্রিক দেশের সাহেবদের সঙ্গেও ঐ একই রকম ব্যবহার। সাহেবদের থেকে আমাদের কালচার একেবারে আলাদা। এদিকে দুই বাংলার মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে আমরা এই ভাষা ও কালচারের অধীন। সাধারণ সামাজিক আচার ব্যবহারে আমাদের সবরকম ব্যবধান দূর করে ফেলা উচিত।’ আজ নববর্ষ। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। স্বাধীন বাংলাদেশের মুসলমান-হিন্দু এবং পশ্চিম বাংলার সঙ্গে তার সাবলীল নিকট সম্পর্ক স্থাপনের জন্য এই সব ছােটখাটো গরমিলগুলাে দূর করার উপায়। এক্ষুণি খুঁজে দেখা দরকার।

হাত জোড় করে নমস্কারের ভঙ্গি এবং কথাটার মধ্যে কোনাে হিন্দুয়ানি আছে কিনা আমি জানি না। খৃষ্টানরা গীর্জায় গিয়ে ঐ একই ভঙ্গিতে অনেক সময় হাত জোড় করে। যদিও, হিন্দুরা মূর্তি পূজা কিংবা অন্য কোনাে পূজার সময় নমস্কার কথাটা সচরাচর ব্যবহার করে না, সেক্ষেত্রে বলে প্রণাম । তাহলে, ধর্মনির্বিশেষে  বাঙালীর পক্ষে নমস্কার কথাটি কি গ্রহণযােগ্য হতে পারে? অপরপক্ষে, কপালের কাছে ডান হাত ঠেকিয়ে সালাম আলেকুম বলা সারা পৃথিবীর মুসলমানদের মধ্যে পরিচিত। সাহেবদের সঙ্গে মুসলমানরা করমর্দন। করে, হিন্দুদের সঙ্গে নমস্কার করেনা। আবার বাঙালী হিন্দু যদি দারােয়ান বা বেয়ারার চাকরি নেয়, তখন সে বড়সাহেবকে দেখলেই (হােক না কালাে রঙের বাঙালী হিন্দু সাহেব) কপালে এক হাত ছুঁইয়ে অবিকল সেলামের ভঙ্গী করে। কিন্তু সে তার সমঅবস্থার মুসলমান প্রতিবেশীকে সেলাম জানায় না। | নমস্কার বা সেলামের বদলে যে করমর্দনও সধারণ বাঙালীর প্রীতি বিনিময়ের রীতি হয়, তাহলেও আপত্তি জানাবার কোনাে কারণ নেই। ব্যক্তিগত রুচির কথা আলাদা, কিন্তু সামাজিক ভাবে একটা নির্দিষ্ট রীতি থাকা ভালাে। তাতে বিভেদ অনেক কমে। সেই রীতিটি কি হওয়া উচিত সে সম্পর্কে আমার মতামত দেওয়ার কোনাে অধিকার নেই, দেশের সুধী ব্যক্তিরা ঠিক করুন। | সৌভাগ্যের বিষয়, স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পশ্চিম বাংলার মধ্যে ভাষার তফাৎ একটুও নেই। একই বাংলা ভাষা হয়েও দু’দিকে আলাদা হতে পারতাে। সেটা হয়নি, তার কারণ, পূর্ববাংলার শিক্ষিত মানুষ সাহিত্য ও যােগাযােগের ভাষা হিসেবে কলকাতার ভাষাকে গ্রহণ করেছিলেন। ফলে, পূর্ব বাংলার খবরের। কাগজ, রেডিও, টেলিভিশনে এই কলকাতার ভাষা প্রচারিত হবার ফলে সমস্ত শিক্ষিত বাঙালীর কাছে আজ  এই ভাষা বােধগম্য। কলকাতার ভাষা’ মােটেই পশ্চিমবঙ্গের ভাষা বা হিন্দুদের ভাষা নয়। এটাই এখন বাংলা সাহিত্যের ভাষা।

এবং এটা ঠিক হয়েছে, স্বাধীনতা বা ভারতভাগের অনেক আগে মােটামুটি হিসেবে বলা যায়, যেদিন রবীন্দ্রনাথ ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন। বাঙালী হিন্দু অনাত্মীয় পরিচিত পুরুষদের নামের পরে বাবু যােগ করে সম্বােধন করে-ঘনশ্যামবাবু কি বটকৃষ্ণবাবু ইত্যাদি। মুসলমানদের নামের সঙ্গে বাবু যােগ করার প্রথা নেই। অনেক হিন্দু বাঙালী অবশ্য পরস্পরের সঙ্গে মিঃ বােস কিংবা মিঃ চ্যাটার্জি বলে সম্বােধন করেন। কিন্তু সেটাকে সংস্কৃতির বিকৃতি ছাড়া আর কি বলা যায়? মুসলমানের সঙ্গে অবশ্য অনেক সময় আমরা বাধ্য হয়েই মিঃ আতাহার বা মিঃ রহমান। বলি, ইউরােপীয়দের সঙ্গে করমর্দনের মতন। এক্ষেত্রে সাধারণ কোনাে সম্বােধনের কথা ভাবা যায় না যা হিন্দু মুসলমান সবার ক্ষেত্রে প্রযােজ্য? মুসলমানদের নামের সঙ্গে অনেক সময় সাহেব যােগ করে ডাকার রেওয়াজ আছে যেমন রহমান সাহেব বা আতাহার সাহেব। কিন্তু আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর মত বিদগ্ধ ব্যক্তি একবার জানিয়েছিলেন যে তিনি আইয়ুব সাহেব এরকম সম্বােধন পছন্দ করেন না, এবং বাঙালী মুসলমানের নামের সঙ্গে সাহেব যােগ করার কোনাে যুক্তি নেই। পূর্ব বাংলার অনেকে তাই যােগ করেন, যেমন- রহমানভাই, আতাহার ভাই। শুনেছি একসময় বাঙালী ব্রাহ্মণরাও এরকম করতেন।

পােষাকের দিক থেকে হিন্দু-মুসলমানের বিশেষ কোনাে গরমিল নেই। পাজামা-পাঞ্জাবী বাঙালী হিন্দুদের মধ্যেও বেশ প্রচলিত। অনেকেই বাড়ীতে লুঙ্গি পরেন। তবে লুঙ্গি পরে বাইরে যাতায়াত করার তেমন রেওয়াজ নেই হিন্দুদের মধ্যে। আবার বাঙালী মুসলমান সাধারণত ধুতি পরেন না। সে যাই হােক, ধুতির ব্যবহার তাে প্রায় উঠেই যাচ্ছে। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব ছেলে, ছােকরা, চাকুরিজীবি ও ব্যবসায়ীরা সার্ট-প্যান্টালুন পড়ে। চাষী মজুর ও নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে মুসলমানরা শুধু লুঙ্গি ও হিন্দুরা ছােট ধুতি ব্যবহার করে। কিন্তু অর্থনীতির চাপে পিষ্ট গরীব মানুষের পােষাক আসাকের তফাতের মতন ছােট-খাটো ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামাবার সময়ই পায় না। এবং শিক্ষিত সমাজের ছোঁয়া তাদের মধ্যে আস্তে আস্তে আসবেই। আজ থেকে পাঁচ কি দশ বছর বাদে, যদি বাংলাদেশের মধ্যে চাষীদের খাটো প্যান্ট পরে চাষবাস করতে দেখা যায়, তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই কারণ সেটাই সস্তা ও সুবিধাজনক। ভিয়েতনামের গরীব চাষীরাও তাই পরে।

আমার নিবেদন, দেশের সুখী ব্যক্তিরা এইসব ছােটখাটো ব্যাপার নিয়ে একটু ভাবুন। একথা অবশ্য ঠিক, মুষ্টিমেয় কয়েকজন মিলে ঠিক করে দিলেই যে দেশের বিরাট সংখ্যক মানুষ রুচি ও আচার ব্যবহার  পাল্টে ফেলবে, তার কোনাে মানে নেই। কিন্তু ইতিহাসের কোনাে কোনাে আবেগময় মুহূর্তে এরকম ঘটে। যায়। এখন সেই রকম সময়- এ যেন আমরা চিনতে না ভুল করি। এখন মিলনের ইচ্ছা আন্তরিক।আর একটা ব্যাপারে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্ব আছে। সাধারণত শিক্ষিত বাঙালী মুসলমান মাত্রই কিছু কিছু রামায়ণ মহাভারত ও রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক গান ইত্যাদির কথা জানেন। কারণ কাব্য সাহিত্যে এসবের বহুল ব্যবহার। কিন্তু অনেক শিক্ষিত হিন্দু বাঙালীও কোরান হাদিস বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ। অনেকে সূফী-দরবেশের জীবনী, এমনকি বিষাদসিন্ধুর মতন অমর কাব্যেরও খোঁজ রাখেন না। এজন্য, পশ্চিম বাংলার প্রাথমিক শিক্ষার স্তর থেকেই, স্কুল পাঠ্য পুস্তকেই এসব বিষয়ে কিছু কিছু রচনা অবশ্য থাকা দরকার । এবং এই সিদ্ধান্ত। নিতে হবে অবিলম্বে নইলে ইতিহাসের এই মূল্যবান মুহূর্তটি অবহেলা করে আমরা আর একবার অন্ধত্বের পরিচয় দেবাে।

১৫ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!