পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েকটি দিক
— চন্ডিকাপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়
গত দু’সপ্তাহ ধরে পূর্ববাংলায় (যার নতুন নামকরণ হয়েছে বাংলাদেশ) যে সকল ঘটনা-পরস্পরা প্রবহমানতা অবিসংবাদিতভাবে স্বাধীনতা সগ্রামে পর্যবসিত হয়েছে; এই সংগ্রাম নিছক গৃহযুদ্ধ নয়। কারণ এখানে রাষ্ট্রশক্তি আয়ত্তে আনার জন্য সরকার ও বিদ্রোহী দলে মধ্যে লড়াই হচ্ছে না, এখানে পূর্ববাংলার অধিবাসীদের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আওয়ামী দল স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে- জঙ্গীশাহী পাকিস্তান সরকারের অতর্কিত ও বিনা প্ররােচনায় তার সশস্ত্র বাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে।
এই কয়েকদিনে বাংলাদেশের ব্যাপক অংশে অবিরাম রক্তস্রোত প্রবাহিত হয়েছে। আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকবাহিনীর নিদারুণ ও নির্মম আক্রমণের সামনে হাজার হাজার বাঙালী আবালবৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে প্রাণ বিসর্জন করেছে। বর্বর নৃশংসতায় ও রক্তপিপাসুতায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী প্রাচীন যুগের আসিরীয় ও আধুনিক যুগের নাৎসী বাহিনীকেও ছাড়িয়ে গেছে। অপরপক্ষে শেখ মুজিবর রহমানের সিংহবিক্রম অনুগামীদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও শৌর্যে থার্মপলি ও হলদিঘাটের অমরকাহিনীর স্মৃতিকে পুণর্জাগ্রত করেছে বললে একটুও অত্যুক্তি হয় না। স্বাধীনতা-স্পৃহা ও সেই স্বাধীনতার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারে বাংলাদেশের অধিবাসীরা আজ এক নতুন ইতিহাস রচনা করেছে। একদিকে যেমন পদ্মা, কপােতাক্ষ, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা ও তিস্তার-জল নিরপরাধ ও নিরস্ত্র জনগণের রক্তে রাঙা হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি বাংলাদেশের জীর্ণ কুটির আজ-রূপান্তরিত হয়েছে দূর্ভেদ্য দূর্গে এবং সেখানকার নরনারী ও কিশাের-কিশােরী মহামানবতার মহিমায় ভাস্বর হয়ে উঠেছে। পূর্ববাংলার এই স্বাধীনতা সংগ্রামে পশ্চিম বাংলা তথা ভারতবর্ষের সকল অধিবাসী অকুণ্ঠ সমর্থনে সােচ্চার হয়ে উঠেছে এবং ভারত সরকারকে সেখানকার অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দেবার জন্য এবং সর্ববিধ সাহায্যের জন্য প্রতিনিয়তই অনুরােধ-উপরােধ জানাচ্ছে। বাংলাদেশের অধিবাসীরা যেমন পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ ও শাসন থেকে চিরদিনের মত শক্তিপাবার জন্য বদ্ধপরিকর। ও ঐক্যবদ্ধ, তেমনি ভারতের প্রতিটি নরনারী চরম আশাবাদী বাংলাদেশের এই বিপ্লবের সার্থক পরিণতি দেখবার জন্য।
| দুর্ভাগ্যক্রমে একদিকে স্বাধীনতা অর্জনের ইস্পাত কঠিন, দুর্দমনীয় সঙ্কল্প এবং অপরদিকে সেই সঙ্কল্পের সােৎসাহ সমর্থন-মাত্র এই দুটি মনােভাবের সহাবস্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে তরান্বিত করবে না, পর্যালােচনা করলে দেখা যাবে যে, এই সংগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে তিনটি প্রসঙ্গ- বৃহত্ৰাষ্ট্রগুলির মনােভাব, ভারতবর্ষের কর্মপন্থা ও পূর্ববাংলার নিজস্ব শক্তি। এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে যে, বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রগুলি সম্মিলিতভাবে বা এককভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসেনি। এর প্রকৃত কারণ হলাে বৃহৎ চতুঃশক্তি- সােভিয়েত রাশিয়া, মর্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও গ্রেট ব্রিটেন সকলেই দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের একটি সার্থক ভূমিকার ধারক ও বাহক- তা ভারসাম্য রক্ষার জন্যই হােক, বা ভারতবর্ষের প্রতি প্রচ্ছন্ন বিয়ােগের জন্যই হােক। সূতরাং তারা কেউই ভূতপূর্ব পূর্বপাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা ও স্বাতন্ত্রের পক্ষপাতী নয়- বিশেষত চীন। ইতিমধ্যেই চীন ভারতবর্ষের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অভিযােগ উপস্থাপিত করেছে। এ পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে একমাত্র সােভিয়েত রাশিয়াই পাকিস্তান সরকারকে পূর্ব বাংলায় সামরিক তৎপরতা বন্ধের জন্য জোরালাে অনুরােধ জানিয়েছে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, রাশিয়া পূর্ববাংলার সংগ্রামীদের প্রত্যক্ষ সাহায্য দান করবে, উপরন্তু কয়েকটি মুসলিম রাষ্ট্র (যথা মালয়েশিয়া) সুস্পষ্টভাবে অভিমত জানিয়েছে যে, বাংলাদেশের রক্তস্রাবী সংগ্রাম পাকিস্তানের অভ্যন্তর ব্যাপার। পাকিস্তানের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলির (যথা আফগানিস্তান, ইরান, ব্রহ্ম, সিংহল, নেপাল) কেউই এখনাে পাকিস্তানের গণহত্যার প্রতিবাদ জ্ঞাপন বা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্বন্ধে কোন উচ্চবাচ্য করেনি। রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকেও এ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি। ভারতবর্ষের আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও সেকরেটারি জেনারেল উথানটের তৃষ্ণীদ্ভাব যেমন বিস্ময়কর, তেমনি মর্মান্তিক।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনের কোনও কোনও মহল থেকে পাকিস্তানী বাহিনীর বেপরােয়া নিষ্ঠুরতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ এসেছে বটে, কিন্তু এদের সরকারী মনােভাব এখনও অস্পষ্ট। হয়তাে মারকিন ও ব্রিটিশ সরকার এখনও আশা রাখে যে, শেষ পর্যন্ত পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে একটা বােঝাপড়া হতে পারে। এবং পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের আনুষ্ঠানিক অখণ্ডতা (ফেডারেশন বা কনফেডারেশনের মাধ্যমে) বজায় রাখা যাবে। মনে হচ্ছে, রাশিয়ার চিন্তাধারাও অনেকটা এই পথে। এরমধ্যে একটা কথা সুস্পষ্ট পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা প্রাপ্তি ও পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতার কথা বৃহৎ রাষ্ট্রগুলি এখনও চিন্তা করছে না। পাকিস্তান দ্বিধাবিভক্ত হলে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ভারতবর্ষ হয়তাে বলীয়ান হয়ে উঠবে, এটা তাদের মােটেই মনঃপূত নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে চীন উভয় সঙ্কটে পড়েছে; চীনের শাসকগােষ্ঠী। ইয়াহিয়া খা ও তার কট্টর যুদ্ধবাজদের উৎসাহী সমর্থক এবং সেটা বােধ করি প্রধানত ভারতীবিদ্বেষসস্তৃত। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানী সৈন্যদের বিধ্বংসী ও ভয়াল মারণাস্ত্র যার মুখে কয়েক লক্ষ বাঙালী ইতিমধ্যেই প্রাণ। বিসর্জন দিয়েছে-বেশীর ভাগই পিকিং থেকে লব্ধ। অথচ চীনের বহুঘােষিত নীতি হচ্ছে, শৃঙ্খলিত। বিশ্বমানবতার সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্য, আজ চীন যদি নীরব দর্শক বা পিন্ডির প্রশ্রয়দাতার ভূমিকা গ্রহণ করে,
তবে মুক্তিবাদী মানবতার নেতা হিসাবে তার গৌরব ম্লান হতে বাধ্য। স্বাধীনতাপ্রাপ্ত বাংলাদেশও সহজে ভুলবে না যে, বিশ্বমানবতার শৃঙখলামুক্তির সরব সমর্থক চীন পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠীকে মদত জুগিয়েছে। পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে দ্বিতীয় প্রসঙ্গটি হলাে- ভারতবর্ষের নীতি ও কর্মপদ্ধতি। ইন্দিরা সরকারের তীব্রতম সমালােচকরা আজ স্বীকার করতে বাধ্য যে, এপর্যন্ত ভারতবর্ষ পূর্ববাংলার ঘটনাবলীর পরিপ্রেক্ষিতে যে কূটনেতিক আচরণ অনুশীলন করে এসেছে, তা মােটের উপর সফল ও প্রশংসনীয়। ভারত সরকার অবশ্য এখনও বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেননি বা তাকে সামরিক সাহায্য দিতেও এগিয়ে আসেননি, কিন্তু প্রকাশ্যে নৈতিক সমর্থন ও প্রচ্ছন্ন কূটনৈতিক পৃষ্ঠপােষকতা- এই দুই ভাগেই ভারত সরকার বাংলাদেশকে যা সাহায্য করেছেন তা শুধু উল্লেখযােগ্যই নয়, অনন্য সাধারণও বটে। বিশ্ববিবেক যখন দ্বিধাজড়িত, সেই সময় ভারত সরকার দ্বিধাহীনভাবে ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে স্বাগত জানিয়েছেন। সন্দেহ নেই, ভারত সরকার ও ভারতীয় জনগণের কাছে পূর্ববাংলার এই আন্দোলন সর্বাংশে সমর্থনযােগ্য। প্রথমত মানবতাবােধ ভারতবর্ষকে পূর্ববাংলার সঙ্গে অকুণ্ঠ একাত্মতার যােগসূত্রে বন্ধন করেছে। দ্বিতীয়ত বাংলাদেশের অধিবাসীদের মরণপণ স্বাধীনতা সংগ্রামের ফলে জিন্নার দ্বিজাতিতত্ত্ব- যার ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল চব্বিশ বছর পূর্বে তা আজ টুকরাে টুকরাে হয়ে ধূলিসাৎ হয়েছে। পূর্ববাংলার মুসলমান অধিবাসীরা আজ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী কীভাবে ধর্মের আফিম খাইয়ে তাদের শুধু প্রতারণা ও শােষণ করে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে নিহিত রয়েছে আধুনিক গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের রাজনীতির জয় ঘােষণা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে শুধু যে পশ্চিম ও পূর্বপাকিস্তানের মধ্যে কৃত্রিম ও অসম বন্ধন ছিন্ন হবে তাই নয়, ভারতবর্ষের পূর্ব সীমান্তে বিরাজ করবে চিরন্তন শান্তি ও সৌহার্দ্য। কিন্তু এতদসত্ত্বেও ভারতবর্ষকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পদক্ষেপ করতে হচ্ছে, কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের গতি এতই প্রবল ও প্রচণ্ড যে, ভারতবর্ষকে হয়তাে অনতিবিলম্বে আরও কয়েকপা এগিয়ে যেতে হবে। চীনের মত ভারতবর্ষেরও উভয় সংকট সােনার বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম যদি শেষ পর্যন্ত একটি রক্তক্ষয়ী বিফল বিদ্রোহে পর্যবষিত হয় তা হবে ভারতের পক্ষে নিতান্ত ক্ষোভ ও বেদনার বিষয়। অপরদিকে প্রকাশ্যভাবে হস্তক্ষেপ করলে এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার কার্যকরী ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার আগেই তাকে স্বীকৃতি দিয়ে ভারতের আচরণ নিছক পাকিস্তান বিদ্বেষ এবং আন্তর্জাতিক আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে গণ্য হতে পারে।
তৃতীয় ও শেষ প্রশ্নটি হলাে-পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতৃবৃন্দ এবং সেখানকার স্বাধীনতাকামী অধিবাসীরা ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী ও জালিমশাহী সরকারের লক্ষাধিক রণদুর্মদ সৈন্য বাহিনীকে কতােদিনঠেকিয়ে রাখতে পারবে? আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পশ্চিম পাকবাহিনী আজ জিঘাংসা ও বাঙালী হননের নেশায় উন্মত্ত হয়ে উঠেছে এবং বাংলাদেশের গ্রামে-গঞ্জে, খেতে-খামারে আজ বয়ে চলেছে অবিরাম রক্তপ্রবাহ। বাইরে থেকে সামরিক সাহায্য না পেলে বা অন্যান্য রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপে পাকিস্তান সরকার তার দানবীয় দস্যুতা বন্ধ না করলে এই সংগ্রামের পরিণতি কী হবে কে জানে! তাছাড়া শােনা যাচ্ছে যে, পুর্ববাংলার জমিয়ৎ-ই-ইসলামী ও মুসলিম লীগের অনুগামীরা গােপনে পশ্চিম পাকবাহিনীকে সাহায্য করছে। আশা করা যাচ্ছে যে, বর্ষার প্রাদুর্ভাব হলে সামরিক পরিস্থিতি সংগ্রামী বাংলাদেশের অনুকূলে যাবে, কিন্তু বর্ষার তাে এখনও দেরী আছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নতুন সৈন্য ও বিমান আমদানি বন্ধ না করলে পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে পারে। | বাংলাদেশের এই স্বাধীনতা সংগ্রাম ভারতীয় উপমহাদেশ ও এশিয়ার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায়। ইতিহাসের পাতায় বাঙালীর এই স্বাধীনতা সংগ্রাম সােনার অক্ষরে লেখা থাকবে এবং ইতিহাসের অমােঘবিধানে এ সংগ্রাম জয়যুক্ত হবেই। আশা করছি, জাগ্রত বিশ্ববিবেক বাংলাদেশের রক্তাক্ত অ্যুত্থানের পাশে এসে দাঁড়াবে।
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা