রাজধানী রাজনীতি বাংলাদেশের ব্যাপারে এশিয়া এবং আফরিকার দেশগুলি নীরব কেন?
— রণজিৎ রায়
আওয়ামি লীগ বাংলাদেশে সরকার গঠন করায় সার্বভৌমত্ব অর্জনের যুদ্ধ এক নতুন পর্যায়ে উপনীত হল। পাকিস্তান রেডিও অবশ্য দিন-রাত তারস্বরে ঘােষণা করছে যে বাংলাদেশে অবস্থা একেবারে স্বাভাবিক হয়ে গিয়েছে;; জনগণের সাহায্য ও সহযােগিতায় বদমায়েস এবং রাষ্ট্রবিরােধীদের শায়েস্তা করা হয়েছেইত্যাদি ইত্যাদি। ইয়াহিয়ার দল পৃথিবীর লােককে বােঝাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছে বাংলাদেশের মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে সর্বস্ব পণ করে যে লড়াই চালাচ্ছে তা ঠিক নয়; ওর সবটাই ভারতের সংবাদপত্রগুলির এবং বেতার মস্তিষ্কপ্রসূত ব্যাপার।
কিন্তু পৃথিবীর মানুষকে একথা গিলিয়ে দেওয়া একেবারেই অসম্ভব। ইয়াহিয়া যে রাত্রে তার সেনাদের বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেন, সে দিনই সব বিদেশী সাংবাদিকদের প্রথমে অন্তরীণ ও পরে বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করে দেওয়া হয়। কিন্তু ঐ অল্প সময়ের মধ্যেই তারা চোখের সামনে দেখে এসেছেন ইয়াহিয়া বাহিনীর নারকীয় অত্যাচারের, নির্বিচার গণহত্যার দৃশ্য। ফলে বাংলাদেশে কী ঘটেছে তা পৃথিবীর কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা যায়নি। তাছাড়া অনেক বিদেশী সাংবাদিকও পরেও ভারতের সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছেন, সংগ্রহ করে এনেছেন যুদ্ধের ও পাক বাহিনীর অত্যাচারের টাটকা খবর। তারা স্বচক্ষে দেখা যেসব বিবরণ দিয়েছেন তাতে পাকিস্তানীদের বিবরণ ডাহা মিথ্যা বলেই প্রমাণিত হয়। ঢাকা বেতার কেন্দ্রের উপর যে ইসলামাবাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে দিনের পর দিন সামরিক শাসন কর্তৃপক্ষের নানা ফতােয়া ঘােষণা করা হচ্ছে। আর তার দ্বারাই স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে ইসলামাবাদ যা বলছে তা কত শূন্যগর্ভ। কয়েকদিন ধরে ঐ বেতার কেন্দ্র থেকে বলা হচ্ছে- মারচ মাসের শেষ সপ্তাহে আটক-করা সব লরি ঢাকার রমনা পারকে রাখা হয়েছে, মালিকরা এসে যেন তদের লরি নিয়ে যায়।
কিন্তু ঐ ঘােষণা শুনে বিশেষ কেউ লরি নিতে আসছেন বলে মনে হয়না। কারণ মালিকদের অধিকাংশই হয় মারা গিয়েছেন, আর না হয় ঢাকা ছেড়ে চলে গিয়েছেন। ঢাকা বর্তমানে মৃতের শহর। স্কুল কলেজ বন্ধ । ভীষণ শাস্তির ভয় দেখিয়ে সরকারী অফিস, মিউনিসিপালিটি ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের কাজে যােগ দেওয়ার জন্য পাক কর্তৃপক্ষ বারবার আদেশ জারি করছে। কিন্তু তাতে কোন ফল হচ্ছে না। বিবিসি গত সােমবার এক বিশেষ বেতার ঘােষণায় বাংলাদেশে অবস্থানকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের যত শীঘ্র সম্ভব বাংলাদেশের বাইরে নিরাপদ জায়গায় চলে যাবার জন্য উপদেশ দিয়েছে। ইসলামাবাদ বাংলাদেশ সম্পর্কে যা বলছে তা যদি সত্য হত, তাহলে ব্রিটিশ সরকার নিশ্চয়ই এভাবে বেতারের মাধ্যমে নিজের। নাগরিকদের এ ধরনের উপদেশ দেওয়ার প্রয়ােজন বােধ করতেন না। তিন সপ্তাহকাল ব্যাপক গণহত্যা চালাবার পরও কিন্তু ইয়াহিয়ার বাহিনী মুষ্টিমেয় কয়েকটি শহর ছাড়া বাংলাদেশের কিছুই দখলে রাখতে পারেনি। গ্রামাঞ্চলে ওদের আদৌ আধিপত্য নেই। বিভিন্ন এলাকার মধ্যে। যােগাযােগের যে অসুবিধায় সম্মুখীন মুক্তিফৌজকে হতে হয়েছিল তা তারা এখন কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন। ২৫ মারচের পর ইয়াহিয়া বাংলাদেশে এক ডিভিশন সৈন্য পাঠিয়েছেন। অর্থাৎ বাংলাদেশে বর্তমানে মােট চার ডিভিশন পাকিস্তানী সৈন্য থাকার কথা। কিন্তু ঐ বিশাল বাহিনী শহরাঞ্চল এবং ছাউনি এলাকা ছেড়ে নড়তে সহস করছে না। চট্টগ্রাম বন্দর ছেড়ে মুক্ত এলাকায় প্রবেশ করাও ওদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। পাকিস্তানী বাহিনীর সংযােগসূত্র একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। এতাবৎ যুদ্ধে যে মুক্তি ফৌজেরই জয় হয়েছে বাংলাদেশ সরকার গঠনের মধ্যে তারই সাক্ষ্য পাওয়া যাচ্ছে। অনুমান করা যেতে পারে যে মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ এলাকার মধ্যে সংযােগসূত্র গড়ে তুলতে পেরেছে। সামরিক দিক থেকে অবস্থা ইসলামাবাদের অনুকূলে আদৌ নয়; বরং উল্টোটাই সত্য। রাজনীতিক দিক থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন গােষ্ঠির মধ্যে বিদ্বেষ সৃষ্টির চাল চেলেও ইয়াহিয়া বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারেননি। দালাল গােছের যারা তার পক্ষ অবলম্ব করেছে বাংলাদেশে তাদের কোন আধিপত্য নেই।
বাংলাদেশে শান্তি বিরাজ করছে- পৃথিবীর মানুষকে এহেন টোপ গেলাতে না পেরে ইসলামাবাদ ভারতের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে নেমে পড়েছে, বলছে- ভারত বাংলাদেশে হিন্দু প্রাধান্য স্থাপন করে। পাকিস্তানকে বানচাল করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে সশস্ত্র বাহিনী পাঠাচ্ছে। এ অপপ্রচারে চীন ছাড়া আর কেউ বিভ্রান্ত হয়নি। পাকিস্তানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে চীনও ভারত পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে। বলে অভিযােগ এনেছে। পাকিস্তান বেতার থেকে সােমবার বলা হয়- ভারত আক্রমণ করলে চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করবে বলে চৌ এন লাই ইয়াহিয়াকে আশ্বাস দিয়েছেন। তার এই সমর্থনের প্রকৃতি কী তা অবশ্য চৌ এন-লাই স্পষ্ট করে বলেননি। | সােভিয়েত ইউনিয়নের পর আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে ব্যাপক হত্যাকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে, এবং যুদ্ধ থামিয়ে “শান্তিপূর্ণ বােঝাপড়া খোঁজার কথা বলেছে। আমেরিকার যে মতামত কূটনীতিক সূত্রের মাধ্যমে ইসলামাবাদকে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে তাতে জেনারেল ইয়াহিয়া নিশ্চয়ই সন্তুষ্ট নন। আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি তার পররাষ্ট্র দফতর সংবাদপত্রকেও জানিয়ে দিয়েছে। তার অর্থ অবশ্য এই নয় যে, আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র দেওয়া বন্ধ করেছে। অন্তত নয়াদিল্লিতে সে রকম কোন খবর আসেনি। তবে পাকিস্তানকে আমেরিকা যাতে আর সামরিক সাহায্য না দেয় তার জন্য নানা মহল থেকে চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বাংলাদেশের। ঘটনায় লনডনও যে উদ্বিগ্ন কুটনীতিক মহল তা জানেন। ভারত মুজিবর রহমানের সমর্থনে একটা সুস্পষ্ট ‘স্ট্যানড’ নিয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়ায় আমেরিকা বারেবারেই ভুল পক্ষকে সমর্থন করে এসেছে।
তা করা হয়েছে কমিউনিজম নিরােধের নামে। ওয়াশিংটনের বিপন্নতা খুবই গভীর। পৃথিবীর প্রায় সকল কূটনীতিক মহলই এখন বিশ্বাস করেন যে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছিন্ন হওয়াটা শুধু কিছু সময়ের ব্যাপার। শেখ মুজিবর নিজে কমিউনিস্ট নন; কোন কমিউনিস্ট আন্দোলনকে তিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন না। তাঁর আন্দোলন পুরােনাে দিনের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যদি ক্ষমতা হারায় তাহলে কমিউনিস্টরাই ক্ষমতা দখল করে নিতে পারে। তা যাতে না ঘটে সে সম্পর্কে ওয়াশিংটন নিশ্চয়ই আগ্রহী। সে জন্যই শেখ মুজিবের সঙ্গে মিটমাট করে নেওয়ার জন্য ইয়াহিয়ার উপর চাপ দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশের যুদ্ধের ব্যাপারে সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হল প্রায় সকল আফরাে-এশীয় দেশের নীরবতা। ভারত ঐ সব দেশের বিবেক জাগ্রত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু খুব একটা সফল হয়নি। এ পর্যন্ত কেবল রেঙ্গুন ইয়াহিয়াকে যুদ্ধের জন্য তেল দেবে না বলে ঘােষণা করেছে। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার কয়েকটি সংবাদপত্রে বাংলাদেশে পাক বাহিনী যা করছে তার জন্য ইসলামাবাদের বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করা হয়েছে। এতে ঐসব দেশের উদ্বেগ পরােক্ষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে বলে ধরা যায় । কিন্তু সকল আরব দেশ তথা ইরান ও তুরস্ক নীরবে ঘটনাধারা নিরীক্ষণ করে চলেছে। নিপীড়িত মানবতার দরদী বলে পরিচিত ইউএআর পর্যন্ত কোন মত প্রকাশ করেনি।
বাংলাদেশে সরকার গঠিত হয়েছে। ঐ সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে স্বীকৃতির আবেদন নিশ্চয়ই জানাবে। কিন্তু কোন্ কোন্ রাষ্ট্র তাকে স্বীকৃতি দেবে তা এখনি বলা কঠিন। ভারতের পক্ষে সঙ্গে সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়ে দেওয়া সহজ নয়। সে এ ব্যাপারে অন্যান্য কয়েকটি দেশকে নিজের মতের সপক্ষে আনার চেষ্টা করবে, যাতে সকলে একত্রে বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি জানাতে পারে। ভারত এবং ইসলামাবাদের সম্পর্কের তিক্ততা আগের চেয়েও বেড়ে গিয়েছে। পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে অস্ত্র পাঠানাের অভিযােগ এনেছে। কয়েকদিন আগে সীমান্ত এলাকা পাকিস্তানীরা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর যে তিনজন সদস্যকে অপহরণ করে নিয়ে গিয়েছে ভারত কড়া ভাষায় লিখিত এক নােটে তাদের অবিলম্বে ফেরত পাঠাবার দাবি জানিয়েছে। নয়াদিল্লি আশা করে- এধরনের প্ররােচনামূলক কাজের ফল যে কী দারুণ হয়ে দাঁড়াতে পারে পাকিস্তান সেটা উপলব্ধি করতে পারবে।
১৪ এপ্রিল, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা