You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.13 | সাত কোটি বাঙালীরে - সন্তোষকুমার ঘােষ | ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১, আনন্দবাজার পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

সাত কোটি বাঙালীরে

— সন্তোষকুমার ঘােষ

ধুরন্ধর ব্রিটিশ নায়ক চার্চিল একদা বলেছিলেন, এম্পায়ার লাটে তুলে দেবার জন্য তিনি মহামান্য সম্রাটের প্রথম অমাত্য হননি। পিণ্ডির প্রাসাদকুটে পায়চারি করতে করতে ইয়াহিয়া সম্ভবত নিজেকে আজ ওই মন্ত্রটাই জপাচ্ছেন। সত্যিই তাে, সুবে বাংলার বিরাট মহাল আর জমিদারি বিনাবাক্যে বিকিয়ে বা বিলিয়েই দেবেন। যদি, তবে ইয়াহিয়া আয়ুবকে হটিয়ে পাকিস্তানের তখৃতটি সেদিন হাত করেছিলেন কেন? দেবেন না, কেউ দেয় না। কোনও স্বৈরাচারী স্বেচ্ছায় গদি ছেড়েছেন, তামাম ইতিহাসে তার নজির নেই। জঙ্গীতন্ত্র জনগণকে ন্যাস বলুন, ক্ষমতা বলুন, কিছু প্রত্যর্পণ করেনা। মাঝে মাঝে ফিরিয়ে দেওয়ার কথা ভাবে। ইয়াহিয়াও হয়তাে কখনও বা ভেবেছিলেন। কিন্তু পিণ্ডির জবরদস্ত জঙ্গী নায়কেরা সঙ্গে সঙ্গে সেই ভাবনাকে আঁতুড়ে টুটি টিপে মেরেছে। সব সদিচ্ছা এখন ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। 

জঙ্গীশাহী ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়ার কথা মাঝে মাঝে মুখে বলে, জনতাকে স্তোক দিতে। কেউ ভােলে, কেউ ভােলে না। স্বয়ং মুজিব ভুলেছিলেন কিনা অচিরাৎ জানা যাবেনা । কিন্তু পূর্ববঙ্গ তথা বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষ যে ভােলেনি তার প্রমাণ গত তিন সপ্তাহে রক্তের অক্ষরে চিরকালের জন্য লেখা হয়ে আছে। ইয়াহিয়া এতটা জানতেন না। কিংবা জানলেও তার উপায় ছিল না। হিংস্র বাঘের সওয়ার যারা, তাদের উপায় থাকে না। “মুজিবই ভাবী প্রাইম মিনিসটার” ঝোঁকের মাথায় অথবা বিবেকের ফুসলানিতে বলে ফেলেই তিনি জিভ কেটেছেন-তওবা। পিছন থেকে আচকানে টান পড়েছে। “না যাইলে বধে রাম, যাইলে ভূজঙ্গ”- পিণ্ডির মারীচকুরঙ্গটির সেই দশা। মুজিবরের হস্তে ভার ন্যস্ত করলে নির্ঘাৎ তার গদি যেত। সুতরাং তিনি চাইলেন সেই গদি বাচাতে। সেই সঙ্গে নিজেকে। নিজের প্রাণের দাম যদি লক্ষ লক্ষ প্রাণ হয়, সেও কবুল। আত্মরক্ষাই যাদের ইস্ট, এমন আর দশটা স্বাভাবিক মানুষ যা করে, ইয়াহিয়াও অবিকল তাই করেছেন। করতে চাইছেন।

স্বাভাবিকতা মানে এক্ষেত্রে কাপুরুষও। আমি যদি বাংলাদেশে পাক ফৌজের কোনও অধ্যক্ষ হতাম, তবে আমার রণনীতি ঠিক এমনই হত। সত্তর হাজার সৈন্য সাত কোটি মানুষের দেশে ছারপােকার মতাে মারা পড়বে। তাই গর্তে ঢুকে পড়তাম, বেরােতম সময় বুঝে, রসদ এসে পড়লে। আকাশ কাঁপিয়ে, মাটি ঝাঁপিয়ে । সব কিছু মাড়িয়ে, হুড়মুড়িয়ে। জিজ্ঞাসা করতাম না, কেন এ যে সেই লড়াই যা জিতলেও জেতা যায় না, হিংসাক্ত মন থেকে এই সত্যকে মুছে ফেলতাম। যদিও জানি, শেষ হার আমাদেরই। আজ জিতলেও দখলদার হয়েই থাকব। কিন্তু কতদিন? দুমাস? দুবছর? যত দিনই হােক, পাকিস্তান নামে আস্ত একটা রাষ্ট্র আর থাকবে না। আমি যদি ব্রিটিশ নীতির নিয়ামক হতাম, তবে হুবহু তাই করতাম, লনডনের হীথ অ্যান্ড কোং যা করছেন, অথবা বলা যায়, যা করছেন না। সাধের পাকিস্তানী নৌকাটি তারাই একদা স্রোতে ভাসিয়েছিলেন। সেই নৌকাটি খাখা হতে দেখলে বুকে, আহা, ব্যথা বাজতেই পারে। অতীত নীতির ব্যর্থতার ভূত ঘাড়ে চেপে মুখ ভ্যাংচায়। সুতরাং হীথ-হিউম প্রভৃতি এখন ভয়ে ভয়ে চোখ বুজে আছেন। অন্ধ ধৃতরাষ্টের মতাে। সংসদীয় গণতন্ত্র রূপী দ্রৌপদীর উপর বর্ণনাতীত অত্যাচার দেখেও চোখ খুলছেন না। হাত তােলা তাে আরও পরের ব্যাপার। তবে বেনের জাত তাে! হিসাবী। জনবুল জানে জনবল যদিও পূর্ববঙ্গে বেশী, বাহুবলে বলীয়ান পিন্ডিই। যদি বাংলাদেশের কাছে সেই বাহুবলের পরাজয় ঘটে, তবে কিন্তু চোখ খুলতে ওদের দেরি হবে না। কোনদিকে পাল্লা-ভারি সেটা সেই সুনিশ্চিত জানাবেন অমনই লকলকে রসনা লালায় লালায় “বাংলাদেশের দু’পা ভিজিয়ে দেবে, দেরি হবে না। 

আমি যদি এই মুহূর্তে মারকিন স্টেট ডিপারমেনট কিংবা পেন্টাগনে হাজির থাকতুম, আমারও তেলামি বেড়ে যেতাে। “আর্মস পলিসির” এই শােচনীয় পরিণতি দেখে বাঙনিষ্পত্তি হতাে না। যদিও এই দেখা প্রথম দেখা নয়, এশীয় ভূখণ্ডেই দেখা গেছে আরও কয়েকবার। কমিউনিজম ঠেকানাের অস্ত্র পাকিস্তান প্রথম প্রয়ােগ করেছে ভারতে। এখন স্বরাষ্ট্রেরই আর একটি অংশকে সবংশে নিধন করতে কাজে লাগাচ্ছে। “মুক্ত দুনিয়ার” স্ব-নির্বাচিত অছি আমেরিকা তবু কথাটি কবে না। যেচে আর একটা ভিয়োমের ঝুঁকি কে নিতে চায়। একমাত্র ক্রেমলিনে গিয়েই আমি বরং একটু জোর গলায় কথা বলব। কেননা পিন্ডির ভয়ঙ্কর কায়ার পিছনে পিকিং-এর ছায়া দেখতে পাব। আর পিকিং থাকলে? এতক্ষণে লাল বাইবেলটির উপর উপুড় হয়ে পড়েছি, পাতি খুঁজছি। পেয়েছি, পেয়েছি। জাতীয় বুর্জোয়াজির দ্বারা প্রকৃত বিপ্লব সম্ভব, একথা পুঁথিতে তাে লেখে না। এটা যে আদৌ একটা মুক্তি সংগ্রাম, তাও বিশ্বাস করতাম না। আমি যদি দিল্লিতে যাই, তাহলে পড়ব দোটানায়। সহানুভুতি? জানাব আলবৎ, আলবৎ, কিন্তু তার বেশী কিছু না, বিশেষ বেশী না । সংগ্রামী সরকারকে স্বীকৃতি? তখন আন্তর্জাতিক আইনকানুনের পৃষ্ঠার মাছির মত লেপৃটে থাকব। আগে ওরা আঞ্চলিক ভূখণ্ডের উপরে সুনিশ্চিত আধিপত্য বিস্তার করুন, তবে তাে স্বীকৃতি! ভুলে যাব  দাগলের নজির। তিনি যখন স্বীকৃতি পান, তখন খাস ফ্রান্সের সুচাগ্র মেদিনীতেও কি তার পা রাখার ঠাই ছিল? ভুলে যাব আলজেরিয়া টিউনিস ইত্যাদি। এদের প্রত্যেকেই কিন্তু আদিতে পরবাসী ছিল।

আসলে দিল্লিবাসী আমি মনে মনে ভয় পাচ্ছি। জোরে জোরে হাত তালি দিয়ে সেই ভয়টাই চাপতে চাইছি। সেদিনকার বিচ্ছিন্নতাকামী এম কে’র দাবি আমি ভুলিনি। আমার মনে চোখ রাঙাচ্ছে দুই বাংলা এক হওয়ার জুজু। ওই বাংলা, আর এই বাংলার তুলনা যে হয় না, ওরা স্বরাষ্ট্রে গরিষ্ঠ, গরিষ্ঠের উপর আজ উদ্ধৃত লঘিষ্ট উপগত, এই সত্যটা স্নায়বিক ভীতিতে বেমালুম ভুলে যাব। তা ছাড়া যুদ্ধের অভিজ্ঞতাহীন নিরস্ত্র-প্রায় জনসমাজের কাছে পাকাপােক্ত মিলিটারির পরাভব- যে কোনও রাষ্ট্রশক্তির অবচেতন মনে এই সম্ভাবনাও ভয়ঙ্কর। একদিকে এই অবাঞ্ছিত সম্ভাবনা, অন্যদিকে চীনে’র আবির্ভাবের দুর্ভাবনা- দিল্লিতে থাকলে এই দোটানার অস্থিরতা থেকে বেরােবার পথ পাওয়া সহজ হতনা। “প্রিজনার অব ইনডিসিসান” কিংকর্তব্যবিমূঢ়তার কয়েদি হয়ে থাকাই হত অবধারিত। অস্বস্তির হেতুটা একবার খতিয়ে দেখুন প্রতিবেশী মুলুকে বিজয়ী এক মুক্তিবাহিনী, সেখানে প্রাণের মূল্যে যারা স্বাধীনতার দাম দিতে শিখেছে। রক্তস্নানে পরিশুদ্ধ হয়েছে। এমন একটা জাতির যার ঘরে ঘরে আজ তৈরী হয়েছে গেরিলা-পাশাপাশি অস্তিত্ব রক্ষার ভাবনাও প্রতিষ্ঠিত কোনও রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে অস্বস্তিকর। অস্বস্তি বিকল্পেও কম নয়। ‘বাংলাদেশ’ পরাস্ত হলে শরনাগত তরঙ্গের আঘাত আমাদের তটেই আছড়ে পড়বে। আজ যে মানবতার নামে পাকিস্তানকে ধিক্কার দিচ্ছি, সেদিন সেই মানবতার দরবারে দায়ভাগী হব আমরাও যদি স্থান না দিই, যদি দুয়ার খুলে না রাখি। আজ বাংলাদেশকে বাঁচাতে এগিয়ে না এলেও দুর্নামের হাত থেকে রেহাই নেই, এগিয়ে যেতেও শত বাধা, সংকোচ, ভয়। নেতৃত্ব বেহাত হয়ে যেতে পারে। জাতীয়তাবাদের যে নির্ভুল স্বাক্ষরে এই সংগ্রাম আজ চিহ্নিত; সুযােগসন্ধানীদের স্থূল হস্তাবলেপে সেই চিহ্ন মুছে যেতে পারে। দিল্লির ভয় উভয়ত, দিল্লির দ্বিধা বহুবিধ।।

একমাত্র আমি যদি আজ ‘বাংলাদেশে’ থাকতাম, আমার কোন ভয়, কোনও সাবধানী হিসাব থাকত না। বিপুল আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতাম, সেই রক্তক্ষরা জীবন-মরণের লড়াইয়ে কোনও জিজ্ঞাসা থাকত না, অথবা সব জিজ্ঞাসা একটি নির্ভুল ও নির্ভীক উত্তরের আশ্রয়ে নিশ্চিত হয়ে থাকত। আমাদের যখন বয়স কম, তখন এই কলকাতাতে শুনেছি, অনেকেই হালকা গলায় বলে “বাঙালী না মুসলমান?” এই অর্থহীন প্রশ্নের সার্থক উত্তর ওঁরা এতদিনে দিয়েছেন। বাঙালী, পরে মুসলমান। আমরা প্রস্তাব পাস করে ‘সেকুলার’ হয়েছি, ওঁরা কবে যেন, কী করে যেন, বিনা প্রস্তাবে, বিনা প্রস্তুতিতে সবাই সত্যকার ‘সেকুলার’। ওঁরাই বাঙালী, নব জাতীয়তায় জাগ্রত। আমরা এখানে ছােট শরিক মাত্র । শুধু কি জাতীয়ত্ব? ওঁদের বাঙালীত্ব তারচেয়েও বেশি মনুষ্যত্বের ভিত্তিতে সুকঠিন প্রতিষ্ঠিত। “রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি?”- ভুল, ভুল, একেবারে ভুল। সাত কোটি বাঙালীরে “জননী”  মানুষও করেছেন, রবীন্দ্রনাথের ভুলটা ধরা পড়েছে এত দিনে- ওঁরা ধরিয়ে দিলেন, আমরা কৃতজ্ঞ।

 ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা