You dont have javascript enabled! Please enable it! পাকিস্তানীর দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ | মেজর জেনারেল হাকিম আরশাদ কোরেশী - সংগ্রামের নোটবুক

চূড়ান্ত লজ্জা
মে. জেনারেল হাকিম আরশাদ কোরেশী
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে হাকিম আরশাদ লেফটেন্যান্ট কর্নেল হিসেবে পাকিস্তানের ২৬ এফএফ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন। হাকিম আরশাদ ১৯৩২ সালের ১ নভেম্বর গুজরাটে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দেন। ১৯৯০ সালে তিনি মেজর জেনারেল হিসেবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন। ১৯৭১ সালের যুদ্ধে তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি দ্য ইন্দো-পাক ওয়ার: আ সােলজার’স ন্যারেটিভ (অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০২) নামে বই প্রকাশ করেন। তাঁর বই থেকে ১৭ ডিসেম্বরে এ অঞ্চলে পাকিস্তানের চূড়ান্ত পরাজয়ের দিনে সৈয়দপুরে তার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতির অংশবিশেষ অনূদিত হলাে। তার বইয়ে একজন ভারতীয় সামরিক কর্মকর্তার জবানিতে সৈয়দপুরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বর্ণনা আছে। সেটিও প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় এখানে সংযুক্ত করা হলাে।
এটা ছিল ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, সূর্যোদয়ের ঠিক পরই। আমি আমার প্রতিরক্ষা অবস্থান দ্রুত দেখে নিলাম। আমরা মােটামুটি বেশ সংগঠিত ছিলাম, তবে শত্রুদের বড় কোনাে আকস্মিক আক্রমণ প্রতিরােধ করার জন্য আমাদের প্রস্তুতি যথেষ্ট ছিল না। প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে আমাদের সময়ের প্রয়ােজন ছিল। শত্রুদের খোঁজখবর নিতে আত্রাইয়ে কিছুসংখ্যক সৈন্য পাঠানাে হয় এবং সেখানে। তাদের শত্রু কাছে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে বলা হয়। এদিকে হাজার হাজার। দিনাজপুরবাসীর ভালাে-মন্দ আমাদের দেখতে হচ্ছিল, যারা আমাদের পক্ষে ছিল। আমি আমার সহকারীকে তাদের খাদ্যের আয়ােজন, আমাদের প্রতিরক্ষার মধ্য দিয়ে তাদের চলাচলের ব্যবস্থা এবং ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার ও প্রশাসনের। সহযােগিতায় সৈয়দপুরে তাদের থাকার জায়গা করতে বলেছিলাম।
পৃষ্ঠা: ১১৮

এদিনের সকালটির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল। কোনাে যুদ্ধ ছাড়া একটি বড় শহর (দিনাজপুর) ছেড়ে দেওয়ায় আমরা শারীরিকভাবে ক্লান্ত ছিলাম এবং মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। যেকোনাে প্রত্যাহারের মধ্যেই স্থানচ্যুতি ও পরিবর্তন নিহিত থাকে। নতুন স্থানের বিস্ময়ময়তা এবং নদীর পাড়ের সঁতসেঁতে পরিবেশ—এসব কিছুর সঙ্গে যােগ হয়েছিল সকালের ঠান্ডা।
আমি যখন শুকনা খড়ে ছাওয়া কুঁড়েঘরের মতাে দেখতে আমার কমান্ড পােস্টে ঢুকছিলাম, তখন আমি আমার ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার মুহাম্মদ শফির [২৩ ইনফেনট্রি ব্রিগেডের অধিনায়ক] ফোন পেলাম। কোনাে রকম ভণিতা ছাড়া তিনি আমাকে জানালেন যে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল এ এ কে নিয়াজি শত্রুদের সঙ্গে আপস-মীমাংসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। যুদ্ধ সমাপ্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এবং এর মধ্যে অস্ত্রসমর্পণও রয়েছে। বিস্তারিত জানার জন্য তিনি সাদা পতাকা উত্তোলন করে আমার ভারতীয় কাউন্টারপার্টের সঙ্গে যােগাযােগ করতে বললেন।
এটা অবিশ্বাস্য। আমি আমাকে নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম, আমাকে এ ব্যাপারে আগে কেউ কিছু বলেনি এবং কিছুতেই এই নতুন অবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিলাম না। এটা ছিল নৈতিকভাবে ভুল এবং কৌশলগতভাবে অপ্রয়ােজনীয়। প্রস্তাবিত যুদ্ধবিরতির আকস্মিকতা আমাকে বিস্মিত করে। আমার সন্দেহ হয়েছিল আসলে সংবাদটি সঠিক কি না? আমি আমার ব্রিগেড কমান্ডারকে সংবাদটির উৎস এবং প্রেরকের পরিচয় সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন, এটা তিনি পেয়েছেন ডিভিশনাল কমান্ড ভয়েস থেকে। তিনি আমাকে পড়ে শােনালেন : কমান্ডার ইস্টার্ন কমান্ড ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি করেছেন। কমান্ডিং অফিসারদের তাদের ভারতীয় কাউন্টারপার্টদের সঙ্গে স্থানীয়ভাবে যােগাযােগ করতে বলা হয়েছে। এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এর সঙ্গে অস্ত্র সমর্পণ জড়িত ছিল। অথবা সে রকমই কিছু।
এটা একটা বিস্ময়কর সংবাদ ছিল। এখানে বাস্তবতাকে স্বীকার করা হয়নি। শর্তহীন আত্মসমর্পণকে বলা হয়েছিল যুদ্ধবিরতি এবং এর পাশে যােগ করা হয়েছিল ‘অস্ত্রসমর্পণ’। এতে অস্ত্র, গােলাবারুদ এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ধ্বংসের কোনাে নির্দেশনা দেওয়া হয়নি। এতে পার্শ্ববর্তী কোনাে বন্ধুরাষ্ট্রে পালিয়ে যাওয়ার কোনাে উপদেশ বা উৎসাহ দেওয়া হয়নি। আমি অন্য রকম কিছু চিন্তা করছিলাম। ব্রিগেড কমান্ডারকে আমি বললাম যে অল ইন্ডিয়া রেডিওর অন্যান্য সংবাদের মতাে এই সংবাদটিও হয়তাে জাল। অথবা ডিভিশনাল কমান্ডার হয়তাে শত্রুদের হাতে ধরা পড়েছেন এবং এ ধরনের সংবাদ পাঠাতে তাকে জোর করা হয়েছে। তিনি দ্রুত পরীক্ষা করে দেখলেন
পৃষ্ঠা: ১১৯

এবং আমাকে জানালেন যে এটি প্রকৃত সংবাদ এবং এতে কোনাে রকম জালিয়াতি নেই।
আমি বিরক্তির সঙ্গে খট করে হ্যান্ডসেটটি রাখলাম। আমার মনে হচ্ছিল, আমরা একটি তাসের ঘর বানিয়েছিলাম এবং এখন এটি এর ভিত্তির ওপর ভেঙে পড়ছে। আমার মন পূর্ণ ছিল বিভিন্ন প্রশ্ন, অজানা আশঙ্কা এবং এ রকম একটি হৃদয়হীন সিদ্ধান্তের বেদনায়। আমি অপমানিত ও মনােবলহীন বােধ করছিলাম।
আত্মসমর্পণ করার আদেশটি ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতাে। হঠাৎ করে কোনাে দেশ থাকল না রক্ষা করার জন্য, লক্ষ্য থাকল না হাসিল করার জন্য আর উদ্দেশ্য থাকল না সমাধা করার জন্য। আমি একটি উভয়সংকটের মধ্যে ছিলাম। আমি কি আদেশ উপেক্ষা করব এবং ছেলেদের বলব যুদ্ধ চালিয়ে যাও—শেষ মানুষ, শেষ রাউন্ড পর্যন্ত—নাকি ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও আমরা কোনাে নিরপেক্ষ দেশে প্রবেশ করার চেষ্টা করব? উভয় ক্ষেত্রে আমরা আমাদের অস্ত্র স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে সমর্পণ করা এড়াতে পারতাম এবং যদি এটি আমরা করতাম, তাহলে তা হতাে আমাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের, যাঁদের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের কারণে আজ আমরা বিপর্যয়কর যুদ্ধে পতিত, প্রতি অসম্মান জানানাে।
আত্মসমর্পণ জীবন রক্ষার বিকল্প নয়, যা নীতিনির্ধারকেরা উল্লেখ করেছেন। আসলে আত্মসমর্পণ বিশ্বের কোনাে জায়গায়ই কোনাে সামর্থ্যবান সৈনিকের জন্য বেছে নেওয়ার বিষয় নয়। কোনাে সেনাদলকে অস্ত্রসমর্পণ করার জন্য বলা সেনাবাহিনীর আইনে বিশ্বাসঘাতকতা হিসেবে বিবেচিত। আত্মসমর্পণের আদেশ অমান্য করলে কোনাে দণ্ডের বিধান নেই। পিঠের চামড়া বাচাতে অস্ত্রসমর্পণ বা পালিয়ে যাওয়া তাে দূরে থাক, ইসলামে কৌশলগত সুবিধা ছাড়া পশ্চাদপসরণও গ্রহণযােগ্য নয়। কোনটা বেশি খারাপ? সম্মান ছাড়া বেঁচে থাকা, না কোনাে কারণ ছাড়া মারা যাওয়া? একজন ভয়ার্ত মানুষ, আর যদি সে স্বার্থপর হয়, তার অদ্ভুত যুক্তি থাকে।
পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধের পুরাে সময়জুড়েই আমাদের মধ্যে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মেছিল যে আমাদের টিকে থাকা নির্ভর করে শত্রুর আক্রমণের সরাসরি জবাব দেওয়ার ওপর। আর এই বিশ্বাসই যেকোনাে প্রতিকূলতাকে মােকাবিলা করতে আমাদের দৃঢ় সংকল্পকে জোরদার করেছিল। আমরা নিশ্চিত ছিলাম, আমরা যে কারণে যুদ্ধ করছিলাম, তার কারণটি ছিল যথাযথ, যার জন্য যুদ্ধ করা যায়। এই বিশ্বাসের কারণে যখন দিনাজপুর থেকে আমাদের পশ্চাদপসরণ করতে বলা হলাে এবং তারপর আত্মসমর্পণ করতে বলা হলাে, তখন এটি আমাদের সম্মানের ওপর আঘাত হানল।
পৃষ্ঠা: ১২০

এটি আমাদের আত্মসম্মানের ওপর তীব্র আঘাত হেনেছিল। ৫০ হাজার সৈন্যদলের একজন কমান্ডার কীভাবে তার এবং তার বাহিনীর জন্য এ রকম ঘৃণিত অবস্থান বেছে নিতে পারে? গুরুত্বপূর্ণ কোনাে যুদ্ধে আমরা পরাজিত হইনি। শত্রুরা শুধু আমাদের প্রতিরক্ষার বিভিন্ন ফাঁকফোকর দিয়ে আক্রমণ করার চেষ্টা করছিল। সে সময় আমাদের প্রাধিকারের অতিরিক্ত সৈন্য ও রসদ ছিল। প্রতিটি জায়গায়ই ছিল পর্যাপ্ত পরিমাণ অস্ত্র ও গােলাবারুদ। যুদ্ধ ঘােষণার পর আমরা মাত্র দুজন সৈন্য হারিয়েছিলাম; বাকিরা (৫০ জনের ওপরে) শাহাদতবরণ করেছিলেন ৩ ডিসেম্বরের আগে। আমি ধারণা করি, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধরত অন্য ইউনিটগুলাের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও আমাদের ইউনিটের মতােই ছিল। যা-ই হােক, আত্মসমর্পণের সময় পর্যন্ত পুরাে বাহিনীর প্রায় ৫০ হাজার সৈন্যের মধ্যে ৫ হাজার জনের বেশি সৈন্যকে হারাইনি। সব দিক থেকেই তাই এ ধরনের আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তের কোনাে যৌক্তিকতা বা ন্যায্যতা ছিল না। আমি নিশ্চিত যে ফিল্ড কমান্ডাররা শত্রু বাহিনীর চাপের মুখে ছিলেন না। সম্ভবত নিরাপদ স্বর্গ ঢাকায় বসে তারা ভয় পাচ্ছিলেন ঢাকার চারপাশে বড় কয়েকটি নদীর ওপারে থাকা আগ্রাসনকারীদের। কয়েকজন ছত্রীসেনা নামায় এবং তাদের চারপাশে কয়েকটি দুর্বল বােমা ফাটায় তারা ভীত হয়ে পড়েছিলেন। অথবা তাঁরা আমাদের উদ্দেশ্যের আশাহীন পরিণতি এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আসন্ন ধ্বংস সম্পর্কে ভারতীয় প্রচার-প্রচারণা গিলেছিলেন। এই তাে কিছুদিন আগেও জেনারেল এ এ কে নিয়াজি তাঁর বিখ্যাত হৃদয় জয় করা ঘােষণা দিয়েছিলেন যে শত্রুরা শুধু তাঁর মৃতদেহের ওপর দিয়েই ঢাকায় প্রবেশ করতে পারবে। হঠাৎ করে কী কারণে তার মন বদলে গেল।
আমার একগুচ্ছ প্রাণােচ্ছল তরুণ যােদ্ধা অফিসারকে বিষয়টি জানাতে হয়। তারা এই নির্দেশে অসন্তুষ্ট হলাে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাল। কিন্তু প্রশ্ন ছিল, আমরা কি একা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারব? আমাদের চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা ঠিক করার পূর্বে ওই দিন কিছু পরে প্রেসিডেন্টের নির্ধারিত বক্তৃতা শােনার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমাদের কোনাে তাড়া ছিল না, যেহেতু আমরা দিনাজপুর থেকে পিছিয়ে আসায় শত্রু থেকে একটা অবসর পেয়েছি। তারা নতুন করে আমাদের মুখােমুখি হতে সাবধানতা অবলম্বন করছে।
আমরা জেনারেল ইয়াহিয়ার সম্প্রচারিত বক্তব্য শুনেছিলাম। কী বিভ্রান্তিমূলক বক্তৃতা! একসময় তিনি পূর্বাঞ্চলে আমাদের বিপর্যয়ের কথা বলছিলেন; এরপর তিনি বলছিলেন যে শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে। ফাঁকা বুলি। আমি অনুধাবন করলাম, এ রকম দায়িত্বহীন নেতৃত্বের অধীনে কোনাে কিছু
পৃষ্ঠা: ১২১

করতে যাওয়াই বৃথা। মাতৃভূমিকে রক্ষা করতে আমাদের সর্বসত্তা বিলিয়ে দিতে হয়েছিল, আমরা আমাদের শরীর এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলাম, মুহূর্তের জন্যও কোনাে দ্বিধা ছাড়াই আমাদের নিষ্প্রভ দিনগুলাে পার করেছি। বিশ্বাস করেছিলাম যে এভাবে দেশের জন্য জীবন দেওয়া যথার্থ হবে, আর এখন কিনা আমাদের পায়ের তলা থেকে মাটি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। কোনাে বিতর্ক ছাড়া, কোনাে যুক্তি ছাড়া, পেশাগতভাবে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনাে চেষ্টা ছাড়াই আমরা পরাজয় মেনে নিয়েছি। আমরা এখন কী করব! আমি আমার চারপাশের বেশির ভাগের চোখে-মুখে একটা শূন্য ভাব দেখতে পেলাম। তাদের দলপতি হিসেবে আমাকে একটি সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমি কি আমার ব্রিগেড কমান্ডারের নির্দেশ মানব এবং আত্মসমর্পণ করব, নাকি তাঁর নির্দেশ আমি উপেক্ষা করব এবং খুব কাছের দেশ নেপালে চলে যাব এবং ইতিহাস তৈরি করব? উত্তরে শত্রুসৈন্য মােতায়েন থাকা সত্ত্বেও একজন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং দক্ষ সৈনিক সব ধরনের মানব এবং প্রাকৃতিক বাধা পার হয়ে হয়তাে নেপাল পৌছাতে পারে, কিন্তু বড় একটি সেনাদলের জন্য তা ছিল অসম্ভব, বিশেষ করে যেখানে বেশির ভাগ স্থানীয় মানুষ আমাদের দখলদার বাহিনী হিসেবে মনে করে এবং আমাদের সঙ্গে প্রায় এক বছর ধরে যুদ্ধ করছে। এবং এখন তারা জানে যে আমরা দৌড়ের ওপর আছি। আমার মনে পড়ছিল বিদ্রোহের প্রথম দিকে কেন্দ্র থেকে বিচ্ছিন্ন সৈন্যদলগুলাের দুর্দশার কথা—ঠাকুরগাঁও থেকে সৈন্যদের পশ্চাদপসরণকালে এবং নীলফামারী ও হিলিতে আমরা যে বিপর্যয়ের শিকার হয়েছিলাম। এটা স্পষ্টত প্রতীয়মান যে যখন মস্তিষ্ক’ (পূর্বাঞ্চল কমান্ড) কাজ করা বন্ধ করে দেয়, তখন শরীর (সেনাদল) শুধু কিছুক্ষণের জন্য নড়াচড়া করতে সক্ষম। বিচ্ছিন্নভাবে আমাদের যুদ্ধ করার অন্তঃসারশূন্যতা ধীরে ধীরে আমার মন আচ্ছন্ন করে ফেলল।
আমরা একটি সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে ছিলাম, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। আমি অনুভব করতে পারছিলাম, ধীরে ধীরে আবেগ-অনুভূতি আমার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমি শবদেহের মতাে হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আমার মন নিজের কাপুরুষতার জন্য আমাকে দায়ী করতে থাকে। একের পর এক শহীদদের চেহারা আমার চেতনায় আসতে থাকে। মাটির কবরে তাদের অস্থায়ী বিশ্রামের জায়গা থেকে তারা আমাকে বলতে থাকে, আমরা যেন তাদের সঙ্গে প্রতারণা না করি। ক্যাপ্টেন ফিদা আমাদের বলে, আমরা যেন যুদ্ধ ত্যাগ না করি। ক্যাপ্টেন মুজাহিদ [যুদ্ধে মৃত] আমাদের যুদ্ধ চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। আমার মনে পড়ছিল অনেকগুলাে দাফনের মধ্যে কোনাে এক দাফনকালে কেউ একজন মন্তব্য করেছিল যে সুদখােরের
পৃষ্ঠা: ১২২

শাসনকে স্থায়িত্ব দেওয়া যায় না। পেছনের আরও অনেক স্মৃতি একের পর এক আসতে থাকে। এ ছিল হতাশাব্যঞ্জক অবস্থা।
অধিনায়ক হিসেবে আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি অফিসারদের একত্রে একটি ইউনিট হিসেবে সংগঠিত রাখার জন্য, যেখানে তারা যেন জীবন এবং মৃত্যুর ক্ষেত্রে একে অন্যের ওপর নির্ভর করতে পারে। তাদের বিজয় পর্যন্ত যুদ্ধ করা অথবা চরম পরিণতির মুখােমুখি হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়েছিল, যেহেতু এ ছাড়া আর কোনাে পথ ছিল না।
আমার সাহস ছিল না এসব সাহসী সৈনিকের মুখােমুখি হওয়ার এবং টিকে থাকার নতুন কৌশলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার, যা মূলত ছিল তাদের জন্য অসম্মানজনক। কিন্তু আমি জানতাম যে চরম এই দুর্দিনে আমাকে আরও নিবিড়ভাবে তাদের নেতৃত্ব দিতে হবে।
ঠিক করলাম যে সৈনিকদের আমি ব্যক্তিগতভাবে এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির কথা বলব। পুরাে ইউনিটকে ফাঁপা বর্গাকারের মতাে দাঁড় করানাে হলাে এবং আমি বক্তৃতা দেওয়ার জন্য মাঝখানে দাঁড়ালাম। পরিস্থিতির গুরুত্বের জন্য সতর্কভাবে সবকিছু মােকাবিলা করা দরকার; আমাদের নতুন অবস্থান উপস্থিত সবাইকে কৌশলের সঙ্গে জানিয়ে দেওয়া দরকার। এই ইউনিটের সঙ্গে আমার প্রথম দিককার সম্পর্কের কথা স্মরণ করার মাধ্যমে আমি আমার বক্তব্য শুরু করলাম। আমি তাদের স্মরণ করিয়ে দিলাম শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা এবং প্রতিবিদ্রোহ (কাউন্টার-ইনসারজেন্সি) অভিযান ও যুদ্ধে তাদের প্রশংসনীয় ভূমিকার কথা, যা এই নবীন ইউনিটের টুপিতে পালকসম। যদিও আহত ও নিহত হওয়ায় আমরা বেশ কিছু অতুলনীয় সৈনিককে হারিয়েছি। পেশাগত কারণে যেকোনাে পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে যে পছন্দগুলাে খােলা ছিল, তা আমি আলােচনা করলাম—দেশকে রক্ষা করতে গিয়ে নিজেদের জীবন বিলিয়ে দেওয়া অথবা পালানাের পথে। ভারত সাগরে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া। পার্থক্য হলাে শুধু স্থান, সময় ও মারা যাওয়ার ধরনের মধ্যে, কিন্তু মর্যাদাজনক মৃত্যু ছিল একটি যথাযথ পছন্দ। বিশেষ করে এই মনােভঙ্গির কারণে আমাদের ইউনিটের অনেক আহত সৈনিক পশ্চিম পাকিস্তানে চিকিৎসা নেওয়ার পর স্বেচ্ছায় ফিরে এসেছে। অবশ্যম্ভাবীভাবে সফলতার ব্যাপারে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম। একটি বাহিনী যখন কোনাে একটি উদ্দেশ্যে শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত উজাড় করে লড়াই করার জন্য প্রস্তুত থাকে, তখন তাদের পরাজিত করা সম্ভব নয়। এরপর চূড়ান্ত বিস্ফোরণের জন্য একটি পরিবেশ তৈরি করতে, আমি পুরাে যুদ্ধজুড়ে আমাদের বিপর্যস্ত অবস্থা, ঢাকার অদূরে ভারতীয় ছত্রীসেনার অবতরণ, বিভিন্ন এলাকায় আমাদের সংঘবদ্ধ প্রতিরােধ ভেঙে যাওয়া ইত্যাদির কথা বললাম।
পৃষ্ঠা: ১২৩

তাদেরকে আমাদের বেহাল সামরিক অবস্থা সম্পর্কে একটি ধারণা দেওয়ার পর প্রধান ইস্যুটি বলার সময় এল। আমি বললাম, সামরিক অভিযানের প্রথম দিন থেকেই আমি জোর দিয়েছিলাম—দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে জীবন উৎসর্গ করা অথবা বঙ্গোপসাগরে ডুবে মরার মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার জন্য। যাহােক, এখন অবশ্য আমাদের সামনে তৃতীয় সম্ভাবনার উদ্ভব হয়েছে : আত্মসমর্পণের পথ; একজন যােদ্ধা বা একজন মানুষের জন্য যা চূড়ান্ত লজ্জার। এটা ছিল একটি ধ্বংসাত্মক মুহূর্ত—নিজেকে নিশ্চিহ্ন করার মুহূর্ত।
যুদ্ধ একটি নিষ্ঠুর বিষয়। এই নিষ্ঠুরতা শারীরিক অর্থের চেয়ে আরও অনেক বেশি। শত্রুর গুলির আঘাতে যােদ্ধার মৃত্যু হলাে দৃশ্যমান ধ্বংস। কিন্তু এর চেয়ে বেশি ক্ষতিকর হলাে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও সঠিক লক্ষ্যের উদ্দেশ্যে সংগঠিত একটি যুদ্ধ পরিত্যাগ করার কারণে যুদ্ধরত সৈনিকদের মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পতন। কোনাে সৈনিকের দৈহিক মৃত্যু, যা কিনা অবধারিত সমাপ্তি বা জীবনের স্বাভাবিক পরিণতি, অপেক্ষা জীবনের এই ধ্বংস অধিক ভয়াবহ।
এটা ছিল একটি স্পর্শকাতর মুহূর্ত। কথা বলার সময় চোখের পানি লুকাতে আমি দূরের দিগন্তে তাকিয়ে ছিলাম, কিন্তু আমার কাঁপা কাঁপা কণ্ঠ লুকাতে পারিনি। তারপর আমি উপলব্ধি করলাম, একটি সুশৃঙ্খল বাহিনী হিসেবে আমাদের যে সুনাম রয়েছে, তা অক্ষুন্ন রাখার জন্য সবাইকে আমার সঙ্গে একত্র রাখতে হবে। আমাকে তাদের মুখােমুখি হতে হচ্ছে তাদের আবেগের সঙ্গে সংযুক্ত থাকার জন্য, যাতে পারস্পরিক বিশ্বাসবােধ আবারও সুসংহত হয়। তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম তাদের প্রতিক্রিয়া অনুমান করার জন্য। তারা একমনে নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল, যেন তারা মাটির গভীরে প্রবেশ করে সব অসম্মান ও লজ্জা এড়াতে চাইছে। অথবা তারা ইচ্ছাকৃতভাবেই তাদের কমান্ডিং অফিসারের ভেঙে পড়াকে দেখতে চায়নি। আমি খুব দ্রুত শেষ করলাম এই বলে যে যেহেতু সবাই একসঙ্গে বা আলাদা আলাদাভাবে নেপাল পালিয়ে যাওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই, অথবা একা ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করে কোনাে সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা নেই, তাই আমার কাছে মনে হয় ইস্টার্ন কমান্ড আমাদের যে পথে নিয়ে যেতে চায়, আমাদের সে পথ অনুসরণ করাই বুদ্ধিমানের কাজ। ব্যক্তিগতভাবে একজন ইউনিট কমান্ডার হিসেবে, সম্ভবত, আমার সৈন্যদের ফেলে রেখে নিজের নিরাপত্তার চেষ্টা করতে পারলাম না। তবে কোনাে সন্দেহ নেই যে আমার শেষ সৈন্যটি নিহত হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ করে যেতে পারতাম।
যারা মুক্তির চেষ্টা করতে চায়, তাদের জন্য আমি একটি দরজা খােলা রাখলাম। তাদের অর্থ এবং আনুষঙ্গিক সকল প্রকার সহযােগিতার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলাে। প্রায় কয়েক ডজন সৈন্য পালিয়ে যাওয়ার অনুমতি চাইল এবং
পৃষ্ঠা: ১২৪

তাদের তা দেওয়া হলাে। কেউ কেউ তাদের জীবন হারাল এবং বাকিরা খুব মারাত্মক গুলির আঘাত নিয়ে ইউনিটে ফিরে এল। আমরা খুব দ্রুতই। অনুধাবন করলাম যে আত্মসমর্পণ করার সম্ভাবনায় গ্রাম ও মফস্বল অঞ্চলে অনেক পাকিস্তানবিরােধী শক্তি তৎপর হয়ে উঠেছে। তাদের শত্রুতায় পােশাকধারী পশ্চিম পাকিস্তানির পক্ষে লুকিয়ে চলাচল অসম্ভব করে তােলে। তাই এ রকম একটি বিস্ফোরণােন্মুখ পরিবেশে পালিয়ে যাওয়ার যেকোনাে চেষ্টাই ছিল ঝুঁকিপূর্ণ এবং আত্মঘাতী।
আমাদের চূড়ান্ত লজ্জার দিনের কথা ভেবে আমরা যত বেশি সম্ভব স্পর্শকাতর দলিলপত্র, অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কেউ কেউ বলেছিলেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ পাঠানাে হয়েছে যে এসব কর্মকাণ্ড আত্মসমর্পণ চুক্তির অভিপ্রায়ের বিপরীত।
আমাদের আসন্ন আত্মসমর্পণ নানাভাবে বিভিন্ন শ্রেণি, সম্প্রদায় ও ব্যক্তিকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল। কিছু বাঙালির কাছে এটা ছিল তাদের। স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতি। বিহারিদের জন্য এটি ছিল অপ্রত্যাশিত দুর্দশা। এটা তাদের স্তম্ভিত করে ফেলে। তাদের যাওয়ার কোনাে জায়গা ছিল না—বাংলাদেশিদের কাছে তারা হয়ে পড়ে অগ্রহণযােগ্য, তারা তাদের জন্মভূমিতে ফিরে যেতে পারছিল না, যে জায়গা থেকে ইসলামের নামে দেশভাগের সময় তারা এসেছিল। তারা ছিল সবচেয়ে হতভাগা। তারপর ছিল আমাদের মতাে মানুষ, যারা পােশাকধারী, যাদের কিছু ছিল সেনাবাহিনী থেকে, আর কিছু ইপকাফ [বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনী] থেকে। এদের বেশির ভাগই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানি, ছিটেফোঁটা বিহারি এবং ব্যতিক্রমী বাঙালিও ছিল। এদের মধ্যে কিছুসংখ্যক ছিল, যারা মানসিকভাবে হতােদ্যম হয়ে। পড়েছিল এবং লড়তে প্রস্তুত ছিল না। আর অনেকে এমন ছিল যে তারা তাদের মানসিক এবং শারীরিক সামর্থ্যের শেষ সীমায় পৌঁছে গিয়েছিল এবং তারা প্রায় ভেঙে পড়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল। কিছু কিছু বাহিনী অনেক সৈন্য এবং যুদ্ধাস্ত্র হারিয়েছিল। অন্যরা শুরু থেকেই দৌড়ের ওপর ছিল। শত্রু দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে একদিকের ছিদ্র বন্ধ করছিল, আর একদিকের ফাঁক দখলে রাখছিল; দিনের বেলা আক্রমণ ঠেকাচ্ছিল আর রাতে ব্যুহ ভেঙে বেরােনাের চেষ্টা করছিল। তারপর আর এক শ্রেণিও ছিল, যারা কখনাে পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে ছিল না। যুদ্ধবিরতি ঘটায় এদের মধ্যে একধরনের স্বস্তি এসেছিল। তবে এরা বুঝতে পারেনি এ ধরনের যুদ্ধবিরতির মানেটা কী। ভারতীয় রেডিও ও পত্রপত্রিকায় প্রচারণার ফলে তারা মনে করেছিল আত্মসমর্পণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার মধ্যে সময়ের ব্যবধান খুব কম হবে, শুধু পরিবহনের ব্যবস্থা করতে যতক্ষণ লাগে। এ ধরনের মানুষের
পৃষ্ঠা: ১২৫

মধ্যে একটি দৃশ্যমান পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছিল। তাদের কপাল থেকে গভীর চিন্তার দাগ মুছে গিয়েছিল এবং তাদের চলাফেরায় বসন্তের ভাব দেখা যাচ্ছিল। প্রায় এক বছরের গুমােট আবহাওয়ার পর তাদের হাসির শব্দ শােনা যাচ্ছিল। এটা বেশ অদ্ভুত যে যখন আমরা ধরাশায়ী এবং নিঃশেষিত, তখন। আমরা ভাবতে পছন্দ করছি যে নৈরাশ্যজনক অবস্থার শেষে দ্রুত এবং আনন্দময় সমাপ্তি প্রায় আসন্ন।
কিন্তু বেশির ভাগ তরুণ অফিসার এবং জওয়ান নতুন পরিস্থিতিতে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল ভিন্নভাবে। এই মানুষগুলােই যুদ্ধে জেতার জন্য লড়ছিল; যারা অরক্ষিত পশু জবাই করতে অস্বীকার করে। শুধু ডাল খেয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিল; সত্যিকার পাকিস্তানিদের মতাে আচরণ করে জীবন ও শরীরের ঝুঁকি নিয়েছিল। তারা বুঝতে পেরেছিল, একবার যখন তারা যুদ্ধে নেমেছে, তখন বিজয়ই কেবল জাতির টিকে থাকাকে নিশ্চিত করতে পারে। তারা দেশের বৃহৎ স্বার্থে সব অধীন সৈনিকদের বড় ত্যাগ স্বীকার করতে উদ্বুদ্ধ করে। তারা তাদের মৃতদেহগুলাে সমাহিত করেছে এই আশায় যে শহীদদের রক্ত শক্তিশালী পাকিস্তান গঠন নিশ্চিত করবে এবং পাকিস্তানের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিয়ে আসবে। আর এখন অবমাননাকর সিদ্ধান্তের কারণে সবকিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটা এখন মনে হচ্ছে যে ব্যক্তিজীবন রক্ষার জন্য জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়েছে। আত্মরক্ষার স্বার্থে জাতীয় সীমানাকে মুছে ফেলা হয়েছে। হঠাৎ করেই রক্ষা করা বা প্রাণ দেওয়ার জন্য কোনাে কিছু বাকি রইল না। একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া দ্রব্যের মতাে মৃত মানুষগুলােকে উপেক্ষা করা হলাে, ভুলে যাওয়া হলাে। এই নতুন পরিস্থিতি হজম করা খুব কঠিন ছিল। আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এই সৈন্যদের জন্য ছিল চরম বিস্বাদের।
কয়েক দিন পর আমাদের পেশাদারির শবের ওপর শেষ আনুষ্ঠানিকতাগুলাে সম্পন্ন হয়। যৌথভাবে লজ্জাজনক কাজটি হওয়ায় এর প্রভাব কিছুটা ভোঁতা হয়ে যায়, কিন্তু ব্যক্তিগত পর্যায়ে এই আত্মসমর্পণের মধ্যকার লজ্জা ছিল ভয়াবহ। প্রকৃতি কর্তব্য পালনের মাধ্যমে জীবন দেওয়ার মধ্য দিয়ে আমাদের অমরত্বের সুযােগ দিয়েছিল, অস্ত্রসমর্পণের মাধ্যমে নয়। কিন্তু আমরা সেই গৌরবের কাজটি বেছে নিইনি।
অপমানের সেই চরম মুহূর্তের আগে আমি সারা রাত অস্থিরতার মধ্যে কাটিয়েছিলাম, আমাদের জন্য যে অবমাননাকর অবস্থান, তা মেনে নেওয়ার জন্য। সেদিন আমরা আমাদের সেনাছাউনি থেকে বেরিয়ে অস্ত্রসমর্পণের স্থান, জামজামা বিমানঘাটির [সৈয়দপুর বিমানবন্দরের পূর্ব নাম দিকে অগ্রসর হই। এটি সৈয়দপুরের সৈনিকেরা যুদ্ধের আগে নিজেদের শ্রমে তৈরি করেছিল।
পৃষ্ঠা: ১২৬

এটিকে প্রলম্বিত যাত্রা মনে হচ্ছিল। নিজেকে আমার খুব অরক্ষিত, প্রতিরক্ষাহীন। এবং অনিরাপদ মনে হয়েছিল। প্রতিটি কদম আমাকে জল্লাদের ফাঁসের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল। বিকেলের মধ্যে ২৩ ব্রিগেডের অধীনে বিভিন্ন শাখা ও বাহিনীর কয়েক হাজারের মতাে সৈন্য, যার মধ্যে ইপিসিএএফের সৈন্যরাও ছিল, বিমানঘাঁটিতে জড়াে হয়েছিলাম। এর মধ্যে ২৬ এফএফও ছিল। আমরা একে অপরের কাছাকাছি দাঁড়িয়েছিলাম, প্রত্যেকেই নিজেদের চিন্তায় বিভাের ছিলাম। = ব্রিগেড কমান্ডার এলেন, তার পেছনে এলেন বিজয়ীরা। এরপর যা ঘটেছিল, তা ছিল এমন অবমাননাকর কাজ, যা প্রত্যেকেই নিজের মন থেকে মুছে ফেলতে চাইবে। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের অনেক ভালাে স্মৃতি ছিল, যা আমাদের কষ্টের স্মৃতিগুলাে ভুলিয়ে দিতে পেরেছিল। আমরা শুধু সুখকর স্মৃতিগুলাে ধরে রাখব। কিন্তু এই লজ্জাকর কাজ আমাদের অবচেতন মন থেকে কখনাে মুছে ফেলা যাবে না। যখন-তখন এই দৃশ্যগুলাে হঠাৎ করে। আমাদের স্মৃতির সাগর থেকে জেগে উঠবে, কিছুক্ষণ ভেসে থাকবে এবং তারপর আবার মনের গভীর অন্ধকার গহ্বরে ঝাঁপ দেবে এবং আবার কোনাে রকম সতর্কবাণী ছাড়া জেগে উঠবে।
আমার মনে পড়ে, কমান্ডারের অধীনে আমরা সাধারণ বিন্যাসে অনড়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিনি তাঁর পিস্তল খালি করলেন এবং তা ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিনিধির হাতে তুলে দিলেন। এটা ছিল একটা করুণ দৃশ্য। জীবনে বিভিন্ন যুদ্ধের সাহসী ও অভিজ্ঞ এই যােদ্ধা জনসমক্ষে তাঁর গর্ব ও স্বাধীনতা বিসর্জন দিলেন। যদিও তিনি নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার যথেষ্ট চেষ্টা করেছিলেন, তারপরও আমি তাঁকে কাঁপতে দেখেছিলাম। এটি আমাকে বেশ নাড়া দিল। তারপর সৈন্যদের তাদের অস্ত্রসমর্পণ করার নির্দেশ দেওয়া হলাে। জ্যেষ্ঠ ব্যাটালিয়ন কমান্ডার হিসেবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত কাজটি করার দায়িত্ব আমার ওপর পড়ে।
আমি কোনােমতে আওড়ে গেলাম জামিন ফাঙ, (ভূমি অস্ত্র)। উপস্থিত সবাই তাদের অস্ত্র মাটিতে রাখল। এরপর এক চরম নৈঃশব্দ্য ভর করল। মনে হলাে পৃথিবী স্থবির হয়ে গিয়েছে। আজ আমার আর মনে নেই যে ভারতীয় প্রতিনিধি কোনাে বক্তৃতা করেছিলেন কি না, আমার মনে হয় না তিনি কিছু বলেছিলেন। সময়ের বিবেচনায় এটি ছিল স্বল্প সময়ের আনুষ্ঠানিকতা। বড়জোর কয়েক মিনিটের হবে। কিন্তু মনস্তাত্ত্বিকভাবে পরাজিতদের জন্য এটা ছিল সীমাহীন অগ্নিপরীক্ষা। স্বাধীনতা থেকে দাসত্বে রূপান্তরের সময় হয়তাে কয়েক সেকেন্ড স্থায়ী ছিল, কিন্তু এই অবমাননা ছিল অন্তহীন।
আমরা যেমন নীরবে জড়াে হয়েছিলাম, তেমন নীরবেই চলে গিয়েছিলাম। এই গভীর বেদনাময় ঘটনার বাহ্যিক প্রতিক্রিয়া ছিল বিভিন্ন রকম। কেউ কেউ
পৃষ্ঠা: ১২৭

খােলাখুলি কেঁদেছিলেন, অন্যরা কপট হাসির আড়ালে তাঁদের আবেগ লুকাতে চেয়েছিলেন, আর যুদ্ধে অবশ্যম্ভাবী পরাজয় নিয়ে কথা বলছিলেন। অন্যরা এ দুরবস্থা এবং অসম্মানের জন্য তাদের উপরস্থদের দায়ী করে বিলাপ করছিল। সবাই অপমান বােধ করছিল। তা যেকোনাে পরিস্থিতিতে আত্মসমর্পণ হলাে অপমানজনক। আমাদের ক্ষেত্রে, এটা কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশে পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সিদ্ধান্তে হয়েছিল, তা মূল বিষয় ছিল না। এর মতাে লজ্জাকর আর কিছু নেই, যখন কারও লড়াই করার সামর্থ্য থাকে অথচ যুদ্ধ ছেড়ে দেয়। আমরা হয়তাে এ রকম ঘৃণ্য ঘটনাকে এভাবে জায়েজ করতে পারি যে আমাদের লড়াই করার মতাে কোনাে যথাযথ কারণ নেই, অথবা বলতে চেষ্টা করতে পারি যে এই আত্মসমর্পণ ছিল হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচানাের জন্য। অথবা বলতে পারি যুদ্ধের সফল পরিণতি অসম্ভব। কিন্তু এ ধরনের যুক্তি বিশ্বাসযােগ্য নয়। দৃশ্যত সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ইতিহাসবােধের অভাব ছিল। আমরা যদি যুদ্ধ করতে করতে মারা যেতাম অথবা আমাদের প্রতিরােধের সব পথ শেষ হওয়ার পর যদি আমরা বন্দী হতাম, তখন জাতি মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারত। আমরা আমাদের উত্তরপুরুষদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারতাম। হাইকমান্ড কি কখনাে অনুধাবন করেছিল যে এ ধরনের স্বেচ্ছাপ্রণােদিত কর্ম আমাদের জাতীয় মনােবলের ওপর কী ধরনের আঘাত হানতে পারে!
‘সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ’—লেফটেন্যান্ট কর্নেল দলজিৎ সিং ১৬ বছর আগে এটি ঘটেছিল, কিন্তু এখনাে আমি পরিষ্কারভাবে দিনটি স্মরণ করতে পারি। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজি বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে তাঁর শেষ বার্তায় অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দিলেন। এরই ফলে ১৭ ডিসেম্বর ১৫:৩০ ঘটিকায় সৈয়দপুরে জামজামা বিমানঘাঁটিতে পাকিস্তানের ২৩ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড, ভারতীয় ৭১ মাউন্টেইন ব্রিগেডের কাছে আত্মসমর্পণ করে।
সৈয়দপুরের আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে যােগ দেওয়ার জন্য আমরা মেজর কে কে মিত্তাল চালিত একটি হেলিকপ্টারযােগে রওনা দিলাম। যা ভেবেছিলাম, তা-ই দেখা গেল, ভারতীয় সৈন্যরা বিজয়ের আনন্দে সব ধরনের গােলাগুলি আকাশ লক্ষ্য করে ফুটিয়ে যাচ্ছিল। মিত্তাল হেলিকপ্টারটি নিরাপদ উচ্চতায়। নিয়ে গেল, কারণ বিজয়ী সৈনিকদের গুলি দুই চোখ খােলা রেখে ছুড়লেও লক্ষ্যবস্তুতে লেগে যেতে পারে। শফি তার সহচরসহ জামজামা বিমানঘাঁটিতে
পৃষ্ঠা: ১২৮

উপস্থিত ছিল বেদনাদায়ক অনুষ্ঠানের জন্য। সেখানে বিখ্যাত পাকিস্তানি রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসাররা ঝকঝকে খাকি পােশাকে সারিবদ্ধভাবে দাড়িয়ে ছিলেন।
আমি শফিকে স্যালুট করলাম এবং সে আমার সঙ্গে হাতে হাত মেলাল। আমি বললাম, আমাদের কোনাে আনন্দঘন অনুষ্ঠানে দেখা হলে ভালাে হতাে। সে আমার দিকে তাকাল এবং মৃদুভাবে জবাব দিল, ‘এগুলাে হলাে যুদ্ধের অদৃষ্ট। আমি মাত্র পাঁচ দিন আগে এখানের দায়িত্ব (নেতৃত্ব) নিয়েছি।’
পাকিস্তানি সেনারা সারি বেঁধে দাড়িয়ে ছিল। সে অনেক দুঃখভারাক্রান্তভাবে তার অনুসারীদের দিকে তাকাল এবং তার কাঁধের অলংকরণ ও তার পিস্তল স্পর্শ করে আত্মসমর্পিত সুরে বলল : ‘খুব শিগগির এই ভার আমার সঙ্গে থাকবে না।’ আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের সময় সে তার ডান কাঁধ থেকে পদবির। অলংকার খুলে ফেলে প্রতীকীভাবে পিস্তল খালি করল এবং এগুলাে ভারতীয় কমান্ডারের কাছে প্রদান করল।
সব জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি সামরিক অফিসার ঘেঁষাঘেঁষি করে দাড়িয়ে ছিল, যেন ঘনিষ্ঠতা কঠিন পরীক্ষা মােকাবিলায় তাদের মধ্যে শক্তি সঞ্চারিত করছে। সৈন্যরা হয়তাে মৃত্যু অথবা বড় পরাজয়কে ভয় পায়, কিন্তু এটা ছিল লজ্জা, যার জন্য তারা কাপছিল। বেশির ভাগ অফিসার ছিল শান্ত এবং চুপচাপ, যদিও তাদের কেউ কেউ উদাসীনভাবে তাদের চিন্তার মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল। ২৯ ক্যাভালরির একজন তরুণ অফিসার কাদছিল আর জুতার অগ্রভাগ দিয়ে। মাটি খুঁড়ছিল, যেন তা তার অশ্রুকে শুষে নিতে পারে।
সাতটি স্যাফি ট্যাংক, ১২টি ১০৫ মিলিমিটার ইতালীয় কামান, ৪টি ১২০ মিলিমিটার মর্টারসহ প্রায় ৫ হাজার পাকিস্তানি সেনা, যার মধ্যে ছিল ৯৮ জন অফিসার এবং ১১৪ জন জেসিও, সৈয়দপুরে আত্মসমর্পণ করেছিল। দিল্লি থেকে আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে ছবি তােলা অনুমােদিত ছিল না। কে অস্বীকার করতে পারে যে আমাদের ইতিহাসবােধের অভাব রয়েছে? ( ১৬.০০ ঘটিকায় অনুষ্ঠান শুরু হয়। পাকিস্তানি সেনাদের মতাে সুশৃঙ্খল ও গর্বিত বাহিনীকে উচ্চনাদে ‘হাতিয়ার বার জামিন’ (অস্ত্র মাটিতে রাখাে) নির্দেশটি পালনে কুণ্ঠিত দেখাচ্ছিল, যা দেখা আমাদের জন্য বেশ যন্ত্রণাদায়ক। ছিল। অনুষ্ঠানের পর ২৬ এফএফের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল হাকিম আরশাদ কোরেশীর চোখ লাল ছিল। তাঁর প্রবল অশ্রুধারা তাঁর গোঁফ ভিজিয়ে দিয়েছিল।
কোরেশী দীর্ঘ সময় ধরে কাঁদছিলেন এবং তাঁর চোখ শুকিয়ে গিয়েছিল। তাঁর কণ্ঠ ছিল ভেজা। এটা দেখা সত্যিই খুব কষ্ট ছিল যে প্রাপ্তবয়স্ক, পদকপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ যােদ্ধারা শিশুর মতাে কাঁদছিলেন। অনুষ্ঠানের পর
পৃষ্ঠা: ১২৯

পাকিস্তানি সেনারা যখন স্থান ছেড়ে গিয়েছিলেন, তখন জায়গাটি ভেজা ভেজা লাগছিল যেন সদ্য পানি ছড়ানাে হয়েছে। ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর পেছন ফিরে তাকালেন এবং জোরে চিৎকার করে বললেন, ‘হানজাও উইচ সরষাে নাহি উগতি’ (চোখের নােনতা পানিতে ভেজা মাটিতে সরিষা জন্মে না)।
আমরা যখন চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন আমাদের সাহসী প্রতিপক্ষের নতজানু হওয়া দেখে আমরা দুঃখিত না হয়ে পারিনি।
(হিন্দুস্তান টাইমস, ২২ ডিসেম্বর ১৯৮৭)
অনুবাদ : আজিজুল রাসেল
Reference:
১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে, সম্পাদনা : মতিউর রহমান