You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.03.30 | অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইন কী বলে - ইন্দ্রনীল - সংগ্রামের নোটবুক

অস্থায়ী সরকারের স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক আইন কী বলে

— ইন্দ্রনীল

বাংলাদেশে একটি অস্থায়ী সরকার গঠিত হয়েছে। স্বীকৃতি লাভের জন্য বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। | দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন এবং মিত্রপক্ষের অন্যান্য দেশ ইউরােপের বহু দেশের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। ইউরােপের কয়েকটি দেশের অস্থায়ী সরকারের হেডকোয়ারটার ছিল ইংলনডে। আন্তর্জাতিক আইনে গৃহযুদ্ধ নিষিদ্ধ নয়। যখন কোন দেশের দুটি অংশের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়; এবং দেশের একটি অংশ মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উদ্যোগী হয় তখন সেই নতুন রাষ্ট্র স্বীকৃতির জন্য বিশ্বের দরবারে আবেদন জানায়। আন্তর্জাতিক আইনে বলা হয়েছে, কতকগুলি শর্ত পূর্ণ করা হলে মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্নতাকামী গৃহযুদ্ধেরত অংশকে যুদ্ধরত শক্তি বলে স্বীকৃতি দেওয়া যেতে পারে। গৃহযুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে যদি ব্যাপক আকারে লড়াই শুরু হয়, বিদ্রোহীরা রাষ্ট্রের একটা বড় অংশ দখল করে নিজেদের প্রশাসন চালু করে, তাদের নিজস্ব সরকার গঠিত হয় এবং দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষের অধীনে থেকে তারা যুদ্ধের নিয়মকানুন মেনে চলে, তা হলে তাদের যুদ্ধরত শক্তি বলে মেনে নেওয়া যেতে পারে।

অন্যান্য রাষ্ট্র বিদ্রোহীদের অস্থায়ী সরকারকে স্বীকার করে নিয়ে তাদের যুদ্ধরত শক্তি বলে স্বীকার করে নিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তারা যুদ্ধরত দেশের সকল রকম সুযােগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য দাবী জানাতে পারে। অবশ্য স্থায়ী সরকারকে স্বীকার করে নেওয়া এবং নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়া এক কথা নয়। বিপ্লবের ফলে যে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় তাকে স্বীকৃতি দেওয়া সম্পর্কে আন্তর্জাতিক আইনে কোন ধরাবাধা নিয়ম নেই। বিপ্লবী রাষ্ট্র যদি মূল রাষ্ট্র বিপ্লবী রাষ্ট্রকে অধীনে রাখার চেষ্টা ত্যাগ করে বা প্রাণপণ চেষ্টা করেও তাকে অধীনে রাখতে না পারে তাহলে নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতিদানের প্রয়ােজনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয় এবং আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী অন্যান্য রাষ্ট্র বিপ্লবী রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে পারে। অবশ্য মূল রাষ্ট্র যদি বিপ্লবী রাষ্ট্রকে স্বীকার করে নেয় তাহলে নতুন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন প্রশ্নই দেখা দেয় না। ব্রিটেন এবং মারকিন যুক্তরাষ্ট্র অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে নতুন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে থাকেন। বিপ্লবী রষ্ট্রের সরকারের পিছনে দেশের অধিকাংশ মানুষের সমর্থন রয়েছে এবং দেশের জনগণ বৈপ্লবিক পরিবর্তনের দাবি স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছেন-কোন দেশে এই পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলে নতুন রাষ্ট্র ও তার সরকার ন্যায়সঙ্গত ভাবে স্বীকৃতির জন্য দাবী জানাতে পারে এবং বাস্তব অবস্থা স্বীকার করে নিয়ে অন্যান্য রাষ্ট্র ও নতুন রাষ্ট্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন।

আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞেরা বলেন, নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র ও তার সরকারের আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা  পূরণ করার ক্ষমতা আছে কিনা, স্বীকৃতি দেওয়ার আগে তাও বিবেচনা করে দেখা উচিত। বাস্তবে অন্যান্য রাষ্ট্র প্রথমে নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দেন এবং পরে তাকে আন্তর্জাতিক আইন কানুন মেনে চলতে বলেন। নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র যতদিন না আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলার যােগ্যতা অর্জন করেন বা মেনে চলতে চান ততদিন অন্যান্য রাষ্ট্র তাকে কার্যত স্বীকৃতি দেন কিন্তু আইন অনুযায়ী স্বীকৃতি। দিতে চান না। De Facto বা কার্যত স্বীকৃতিদান এবং De jure বা আইনানুগ স্বীকৃতি দানের মধ্যে বাস্তবে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। কোন রাষ্ট্রকে যদি de facto স্বীকৃতি দেওয়া হয় তাহলে সে আন্তর্জাতিক রাষ্ট্র পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হয় এবং প্রায় সবরকম সুযােগ সুবিধাই পায়। তবে De facto স্বীকৃতি অস্থায়ী এবং যে কোন সময়ে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হতে পারে । de jure স্বীকৃতির ক্ষেত্রে তা করা সম্ভব নয়।

আন্তর্জতিক আইনে বিপ্লবের মাধ্যমে উদ্ভূত নতুন রাষ্ট্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দানের ব্যাপারে যে সব শর্তের কথা বলা হয়েছে নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও তার অস্থায়ী সরকার সে সব শর্ততাে পূর্ণ করেইছে উপরন্তু বাংলাদেশ’ নামে নতুন রাষ্ট্রটির উদ্ভব ঘটায় মূল রাষ্ট্র পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিতর্কের বিষয় হয়ে পড়েছে। সাধারণত দেশের একটা অংশ বিপ্লবের মাধ্যমে মূল রাষ্ট্র থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। 

করে থাকে। বাংলাদেশর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের বড় শরিক পূর্ব পাকিস্তান বাংলাদেশ নামে নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিপ্লব শুরু করেছে এবং এক অস্থায়ী সরকার গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশকে বাদ দিলে পাকিস্তানের। যে অংশ পড়ে থাকে তাকে মূল রাষ্ট্র বলা চলে কিনা, আন্তর্জাতিক আইন বিশেষজ্ঞদের তা বিবেচনা করে দেখা উচিত। পাকিস্তানের দশ কোটি মানুষের মধ্যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ নতুন রাষ্ট্রের পিছনে রয়েছেন। এই অবস্থায় আড়াই কোটি মানুষের রাষ্ট্রকে কি মূল রাষ্ট্রের মর্যাদা দেওয়া ঠিক হবে? ওই আড়াই কোটি মানুষের একটা বড় অংশ আবার পাকিস্তানের সামরিক শাসকগােষ্ঠীর নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। মূল রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের দাবি স্বীকার করে নেওয়ার সময় ওই কথাই মনে রাখতে হবে।

আন্তর্জাতিক আইনে নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র ও তার সরকারকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে যে সব শর্তের কথা উল্লেখ করা হয়েছে তার একটি হল ঃ নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র ও তার সরকারের পিছনে বিপুল জনসমর্থন আছে কিনা? বাংলাদেশ ও তার সরকারের পিছনে যে অভূতপূর্ব জনসমর্থন রয়েছে, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনই তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। বাংলাদেশের সর্বত্রই যে জনগণ প্রচণ্ড বিপদের ঝুঁকি নিয়েও অস্থায়ী সরকারের নির্দেশ মেনে চলছেন, তা বােধহয় প্রমাণের অপেক্ষা রাখেনা। নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র বাংলাদেশ এবং তার অস্থায়ী সরকার যে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতা পূর্ণ করতে ইচ্ছুক ও সক্ষম তা প্রমাণও পাওয়া যাচ্ছে। | দেখা যাচ্ছে আন্তর্জাতিক আইনে নতুন বিপ্লবী রাষ্ট্র ও তার সরকারের স্বীকৃতি লাভের পক্ষে যে যােগ্যতার কথা বলা হয়েছে বাংলাদেশ ও তার অস্থায়ী সরকার সব দিক থেকে সেই যােগ্যতার অধিকারী।  এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ও তার সরকারকে স্বীকৃতি দিলে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ীই কাজ করা হবে। বাংলাদেশে যে গণহত্যা চলেছে তা মনে রেখেই ভারত এবং অন্যান্য রাষ্ট্র যদি বাংলাদেশ ও তার অস্থায়ী সরকারকে তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দেন, তাহলে অগণিত অমূল্য প্রাণ রক্ষা পেতে পারে।

৩০ মার্চ, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা