পূর্ববাংলার সংগ্রামের নীতি ও কৌশল।
— পান্নালাল দাশগুপ্ত
পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গােষ্ঠী আজ যে মুখখামুখি এক মারমুখী মােকাবিলার সম্মুখীন, তার পরিণাম সম্বন্ধে আজ সবাই উকর্ণ ও উদ্বিগ্ন। ইয়াহিয়া খান মাঝখান থেকে নিজেকে নিরপেক্ষ বলে চালাবার চেষ্টা করেন, যখন তিনি বলেন যে, এ হলাে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে মুখােমুখি মােকাবিলা, তার সঙ্গে পূর্ববাংলার বিরােধ এটা নয়। তিনি কী করবেন, পূর্ব পাকিস্তানের যেমন একচ্ছত্র প্রতিনিধি শেখ মুজিবর রহমান, পশ্চিম পাকিস্তানের তেমনি একচ্ছত্র প্রতিনিধি কি জনাব জুলফিকার ভুয়ো নন? এখন ভুট্টো সাহেব যখন বলছেন (হুমকি দিচ্ছেন) যে, যদি ৩রা মারচ তারিখেই পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় এসেমবলী ডাকা হয়, তবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে তছনছ কাণ্ড করার জন্যে ডাক দেবেন ইত্যাদি, তখন কি করতে পারেন ইয়াহিয়া খান? অতএব ইয়াহিয়া খানের বিচারে, পশ্চিম পাকিস্তানের সম্ভাব্য তাণ্ডৰ এড়াতে ভুয়োর পরামর্শমত এসেমবলীর বৈঠকের দিন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখতে হুকুম দিয়েছিলেন। | আসলে এটা একটা চালাকি মাত্র। মুজিবর রহমানই দেখিয়ে দিলেন যে, সমগ্র পাকিস্তানের এসেমবলীতে যে দল সংখ্যাগুরু (অর্থাৎ আওয়ামী লীগ) তার পরামর্শ না নিয়ে সংখ্যালঘু একটি দলের (পাকিস্তান পিপলস পারটি) পরামর্শ মত হঠাৎ পাক গণপরিষদের বৈঠক বন্ধ করে দিয়ে ইয়াহিয়া খান যে আসলে অ-গণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী তারই আর এক দফা প্রমাণ দিলেন। অর্থাৎ পাক-শাসক গােষ্ঠী ও সামরিক গােষ্ঠী ততক্ষণই গণতান্ত্রিক যতক্ষণ গণতন্ত্র তাদের কায়েমী স্বার্থকে বিপন্ন না করবে, কিন্তু যে মুহূর্তে তাদের। আঁতে ঘা পড়বার সম্ভাবনা, সে মুহুর্তেই তারা তাদের আসল রূপ প্রকাশ করতে কুণ্ঠিত হবেনা। এই আসল রূপটা যে কি, তার প্রমাণ পাওয়া গেল, পাক-পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার জঙ্গী হুকুমের বিরুদ্ধে যখন পূর্ববাংলার লােকেরা বিক্ষোভ দেখাতে গেলাে, সামরিক বাহিনী তখন রাস্তায় রাস্তায় বেপরােয়া গুলি চালিয়ে শতশত ব্যক্তির প্রাণ নিলাে।
| এই বেপরােয়া গুলিবর্ষণ সামরিক শাসনের পক্ষে বিদায়কালীন পদাঘাত রূপে ইতিহাসে প্রমাণিত হয় কিনা, সেটা একটা দেখবার মত বিষয়। সমস্ত পৃথিবী আজ এই সরক্ত পদাঘাতটির আশু পরিণামের দিকে তাকিয়ে আছে। | ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলায় যেখানে যে পথ দিয়ে যতটা পারে সৈন্য সামন্ত পাঠাচ্ছেন। নিজের মােটা বুদ্ধির জন্য হয়তাে তিনি এখন আপশােষ করছেন এই বলে যে, ভারতের বিমান ডাকাতিটাকে অমন করে প্রশ্রয় দেওয়া তঁার হয়তাে ঠিক হয়নি, এই সময়ে অন্তত ভারতের আকাশ দিয়ে সৈন্যবাহিনী ও রণসঙ্কর পূর্ব পাকিস্তানে অবাধে পাচার করা যেত। তবে ইয়াহিয়া খান যে একদম অপ্রস্তুত তা নয়, দুই ডিভিসন সৈন্যযারা প্রায় সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে আগে থেকেই পূর্বপাকিস্তানে মােতায়েন করা আছে; তদুপরি আধাসামরিক কতগুলি বাহিনীতাে আছেই। যাই হােক পূর্ববাংলার আপামর জনসাধারণের তীব্র প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ দমনের জন্য নির্বিচারে যে গুলিবর্ষণ করে সৈন্যরা রাস্তায় নেমে, তার দ্বারা মাথা মােটা সামরিক কর্তৃপক্ষ হয়তাে বাঙালীদের বােঝাতে চেয়েছেন, এর পরে তাদের ভাগ্যে আরও কত কি আছে, এতাে কেবল সন্ধ্যা সারারাত বাকী! সামরিক শাসন তাে উঠবেই না, সারা বাংলাদেশের বুকের উপর চেপে বসে থাকবে অনির্দিষ্টকালের জন্য। সামরিক শক্তি ওখানে তাে আছেই, বহু বছর থেকেই মােতায়েন আছে- সামরিক বাহিনী প্রত্যক্ষ কার্যকলাপ এর চেহারা কেমন হতে পারে তা ভেবে বাঙালীরা আতঙ্কিত হােক, সাবধান হােক- এই হলাে সামরিক বিচার বুব্ধির চিরাচরিত চিন্তাধারা। | এই সম্ভাব্য সামগ্রিক সমনপর্ব মােকাবিলা করার জন্য আওয়ামী লীগ কী পন্থায় সংগ্রাম করছেন ও অধিকতর বেপােরােয়া আক্রমণ পরাস্ত করার জন্য কী জাতীয় প্রস্তুতি নিয়েছেন, সেটাই আজ সর্বদেশের বিপ্লবীদের দেখার মত বিষয়। এখানে পূর্ববাংলার সর্বাধিনায়ক’ (বাস্তবে আজ সর্বসমর্থিত নায়কই তিনি) মুজিবর রহমান এমন একটি পথ ধরেছেন যা আমাদের সকলের একটু বিশেষ নজর দিয়ে বােঝবার চেষ্টা করা উচিত। বর্তমানে পূর্ববাংলার প্রতিরােধ আন্দোলনের কতগুলি বিশেষ বৈশিষ্ট আছে, যেগুলির তাৎপর্য অনুধাবনযােগ্য- যা পূর্বেকার বিক্ষোভ, বিদ্রোহ ও উত্তাল জনসমুদ্রের স্বতস্ফুর্ততার চেয়ে স্বতন্ত্র, আলাদা।
পূর্ব পাকিস্তানে গত এক যুগ ধরে দলে দলে জনসমুদ্রের উত্তাল বিক্ষোভ ও ম্যাস ভায়ােলেনসের বিস্ফোরণ আমরা দেখেছি। দিন কয়েকের জন্য উত্তাল কাণ্ডকারখানা, লক্ষ লক্ষ লােকের জনসমাবেশ, এখানে সেখানে অগ্নিকাণ্ড, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদি স্বতঃস্ফুর্ততা জনসাধারণের নির্ভীকতা ও ভয়হীনতার পরিচয় পূর্ব পাকিস্তানী রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে কয়েকবারই দেখা গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানেও এ জাতীয় বিদ্রোহী বিক্ষোভ দেখা দিয়েছিল আয়ুবশাহীর পতনের পূর্বক্ষণে। কিন্তু এ জাতীয় স্বতঃস্ফূর্ত সহিংস বিক্ষোভ প্রদর্শনের শক্তির একটা সীমা বারে বারেই ধরা পড়ে। আপন অরাজকতায় এই জাতীয় বিদ্রোহ আপনাআপনি ক্লান্ত ও স্তব্ধ হয়ে যায়। তাই বারে বারেই এ প্রশ্ন পূর্ব পাকিস্তানী স্বায়ত্তশাসনকামী সংগ্রামী জনতার কাছে উপস্থিত হয়েছে। তার পরে কী? বিদ্রোহ ও বিক্ষোভকে একটা স্থায়ী অথচ ক্রমবর্ধমান অপ্রতিরােধ্য শক্তি হিসেবে কী করে গড়ে তােলা যায়? অতঃপর কী এ প্রশ্নটির উত্তর যদি বিপ্লবী ও বিদ্রোহীরা আবিষ্কার করতে না পারেন, তবে এবারেও তাে আর এক রাউনডের পর সব স্তব্ধ হয়ে যাবে, সামরিক শাসন আরও কঠোর ভাবে চেপে বসবে। বিদ্রোহী বাঙালীরা এরপর সামগ্রিক সামরিক আক্রমণের মুখে কী করতে পারে, এইটা হচ্ছে প্রশ্ন বা বৃহত্তম জাতীয় জিজ্ঞাসা ৰা অনুসন্ধান। এ প্রশ্ন তাদের কাছে বারে বারে উপস্থিত হয়েছে। তারা প্রথমত ভেবেছিলেন হয়তাে আন্তর্জাতিক সাহায্য চাওয়া ও পাওয়া যেতে পারে, হয়তাে ভারত, চীন, রাশিয়া, অথবা আমেরিকা বা যুক্তজাতিসংঘ তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের সংগ্রামকে সমর্থন ও সাহায্য করতে পারে। বহু তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে তারা এতদিনে বুঝতে পেরেছেন যে, ওসব দিক থেকে সত্যিই কোন সাহায্য ও সমর্থন আসবে না।
তারপর পূর্ব পাকিস্তানের একদল রাজনৈতিক (ভাসানী সহ) মনে করেন হয়তাে সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনসাধারণের যে আশা-আকাঙ্গথা ও সংগ্রাম ধুমায়িত হয়ে আছে তার পূর্ণ বিকাশের জন্য পূর্ব পাকিস্তানকে অপেক্ষা করতে হবে, সমগ্র পাকিস্তানই যদি একদিন গণতান্ত্রিক হয়, সেই গণতান্ত্রিক নিখিল পাকিস্তানই হয়েতাে একদিন পূর্ব পাকিস্তানের আত্মনিয়ন্ত্রণ বা স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে মেনে নেবে। দেখা গেলাে এ স্বপ্নও যেন মিথ্যা, কেন না একদিন আয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানেও বিরাট বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়, আয়ুব খান নিজে পদত্যাগ করে ইয়াহিয়া খানকে বসিয়ে দেন, ইয়াহিয়া খান অদুর ভবিষ্যতে আবার গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র চালু করে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতিও দেন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে মেনে নেয় না, ভারত বিরােধী জিগিরের আশ্রয় নিয়ে সে আন্দোলনের কর্ণধার হয়ে পড়েন ভুট্টো। ভুট্টোর মুখে সমাজতন্ত্রের বুলি বুদবুদ করে বটে, তার চীন প্রীতিও সােচ্চার, কায়েমী স্বার্থের বিরুদ্ধে উগার সবই আছে, কিন্তু পূর্বপাকিস্তানের ছয় দফা দাবি মানতে নারাজ। অতএব দেখা গেলাে, পশ্চিম পাকিস্তানের তথাকথিত গণতান্ত্রিক আন্দোলনের উপরেও পূর্বপাকিস্তানীদের ভরসা করার উপায় নেই। তবে আর পথ কি?
“সশস্ত্র সংগ্রামের পথে যাবাে বলেও পূর্ব বাংলার ছােটখাটো নানা উপদল প্ররােচনা দিয়ে বেড়াচ্ছেন। তারা মনে করেন এই সামরিক শাসন ও পরাধীনতার হাত থেকে রেহাই পাবার কোন গণতান্ত্রিক কৌশল নেই। দেশে দেশে-চীন দেশে, কিউবাতে, দক্ষিণ আমেরিকাতে, ভিয়েতনামে যে নানা ধরনের পারটিসান ওয়ারের কৌশল কার্যকরী হয়েছে তারই কোন একটা বাঙালীদের এবারে বেছে নিতে হবে। বর্তমানে মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে যে প্রতিরােধ ও অসহযােগ আন্দোলন চলছে, তাতে কী হবে, এই তাদের প্রশ্ন। মুজিবর সাহেব কেন সবাইকে অস্ত্র ধরতে বলছেন না এই তাদের অভিযােগ। এটাকে বলা যায় তৃতীয় পন্থা।
এই তৃতীয় সশস্ত্র সংগ্রামের পন্থাই শেষ পর্যন্ত পূর্ব বাংলাকে নিতে হবে কিনা, সেটা হয়তাে কিছুদিনের মধ্যে দেখা যাবে। কিন্তু একটা কথা এই যে, যতদিন পর্যন্ত আজকের এই সামগ্রিক প্রতিরােধ ও অসহযােগ সংগ্রাম জোরদার থাকবে, নিরস্ত্র আক্রমণ বজায় রাখা চলবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সশস্ত্র পকেট সৃষ্টি করে আন্দোলন। ৰা সংগ্রামকে রক্ষা করার প্রশ্ন থাকলেও আশু প্রয়ােজন হয়না। অগ্রগমনের পথ যদি রুদ্ধ হয়ে যায়, প্রতিপক্ষের আক্রমণ যদি ক্রমবর্ধমান হারে কার্যকরী হতে থাকে, তবেই বিপ্লবীদের আত্মরক্ষামুলক মুক্তাঞ্চলের সংগ্রাম ও গেরিলা যুদ্ধ শুরু হতে পারে। সমগ্র পূর্ববাংলা যেখানে আজ বিদ্রোহী, কোন বেসামরিক সরকারী ব্যবস্থার উপরে যেখানে ইয়াহিয়া খানের কোন হাত নেই, সেখানে সেখানকার সংগ্রামী জনতা সমগ্র বাংলাদেশ থেকে সরে গিয়ে গােটা কয়েক সশস্ত্র ঘাটিতে নিজেদের কেন গুটিয়ে নেবেন। তাতে কয়েক পা পিছিয়েই যাওয়া হবে, এগুনাে হবেনা।
একথা আজ সর্বমহল থেকে সমর্থিত যে, পূর্ববাংলার সাধারণ নাগরিক জীবনের উপর, সরকারের উপর ব্যবসা-বাণিজ্যের উপর, যাতায়াত যােগাযােগ ব্যবস্থার উপর, ইয়াহিয়া খানের সামরিক বাহিনীর কোন হাত নেই আজ আর। কেন্দ্রীয় সরকার আছে কোথায়? আছে একমাত্র সৈন্য ব্যারাকগুলিতে, এমন কি পুলিশ ব্যারাকেও নয়। ঐ ব্যারাকের মধ্যেই যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবহিনীকে আবদ্ধ করে রাখা যায়, তারা আর বের হতে না পারে, বের হয়েও বেসরকারী ও সরকারী ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে না পারে, তবে সামরিক শক্তি সেখানে এমননিতেই অচল হয়ে যেতে পারে। কোন সামরিক শক্তিই বেসামরিক সরকারী যন্ত্র ছাড়া বেশীদিন তিষ্ঠোতে পারেনা। আর এই অবস্থা সৃষ্টি করতে পারে যদি বাঙালীরা ওখানে একটা সার্বিক অবরােধ সংগঠিত করে রাখতে পারে সামরিক ঘাটিগুলির বিরুদ্ধে।
| অথচ নাগরিক জীবন বিপন্ন করার কোনও নীতি সেখানে নেওয়া হচ্ছে না। এই অসহযােগ সংগ্রাম নির্বিচারে চালু করা হয়নি। কেন্দ্রীয় সরকারের শক্তিতে অবরােধ করা, অচল করা তার লক্ষ্য, নিজেদের চলাফেরা কাজ করার বিরুদ্ধে সে শক্তি প্রযুক্ত করা হচ্ছে না। রেল চলবে, বাস চলবে, গাড়ী ঘােড়া নিত্যনৈমিত্তিক নাগরিক প্রয়ােজনের যাবতীয় দিক সুরক্ষিত থাকবে, শান্তি শৃঙ্খলা রক্ষা করা, চোর ডাকাত দমন করা, ডাক তার (দেশের ভিতরে) সব চালু রাখা, দেশের ভিতরকার ব্যাংকের কাজকর্ম যথাসম্ভব ঠিক রাখা সবই চলবে- কেবল চলবে না সামরিক সম্ভার ও সৈন্যবাহিনীর চলাফেরা পূর্ব থেকে পঃ পাকিস্তানে মাল, টাকা পয়সা, লােকজন পাচার করার বা প্রবেশ করবার অধিকার। এ এক অদ্ভুত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন সংগ্রাম- যে সংগ্রামে জনসাধারণ নিজেরা ক্ষতিগ্রস্ত হবেনা, বরং দিন দিন তাদের প্রতিরােধ ও আত্মশক্তি বেড়ে যাবে। মােটকথা পূর্ববাংলায় স্বতঃস্ফূর্ত বিশৃঙ্খলা বিপ্লবের ডাক দেওয়া হয়নি, সবটার ভিতর দিয়ে একটা পালটা সরকার দাঁড় করিয়ে ফেলা হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাপী একটি বিদ্রোহী পাল্টা সরকার সৃষ্টি করেই যেন পঃ পাকিস্তান সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কৌশল ও নীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে।
একটা তুলনা দিয়ে না বােঝালে এই সংগ্রামের বৈশিষ্ট্য ও তাৎপর্যটুকু ধরা সম্ভব নয়। ভারতে এবং পশ্চিম বাংলায় আমরা বহুবার বহুরকমের এই স্বতঃস্ফুর্ত গণবিক্ষোভের সংগ্রাম দেখেছি। বন্ধ বা হরতাল জাতীয় আন্দোলন অনেক সময় বিস্ফোরণে ফেটে পড়েছে। তখন দেখেছি, আমাদেরই নেতারা শুধু রেল বাস ট্রাম বন্ধ করে দিয়ে ক্ষান্ত থাকেন না, বিক্ষুব্ধ জনতাকে রেলগাড়ি, বাস-ট্রাম পােড়াতে দেন। ডাক তার ব্যবস্থা নষ্ট হতে দেন। এতে কিন্তু প্রতিপক্ষের আঘাত করার ক্ষমতা লুপ্ত হয় না, তাদের নিজেদের যােগাযােগ ব্যাবস্থা ও খবরাখবর রাখার ব্যবস্থা পুলিশ যান, বেতার যন্ত্র ইত্যাদির সাহায্যে দিব্যি চালিয়ে যান ও দমন যন্ত্র অটুট থাকে। মরতে মরণ হয় শেষ পর্যন্ত জনসাধারণেরই, জনশক্তিরই। যােগাযােগ ব্যবস্থা নিজেরাই নষ্ট করে দেবার ফলে এক অঞ্চলের লােক জানতেই পারে না অপর অঞ্চলে কি হচ্ছে; জনসাধারণের ঐক্য যায় কার্যত নষ্ট হয়ে, পরস্পর পরস্পরের সহায়তায় আসতে পারে না, বিক্ষোভ শেষ পর্যন্ত ত্রাসে পরিণত হয় সরকারী সন্ত্রাসের সম্মুখে। অর্থাৎ অরাজকতা সৃষ্টি করে আমরাই নিজেদের পায়েই নিজেরা কুড়াল চালিয়ে দিই। এ-জাতীয় বিক্ষোভের দৌড় শেষ পর্যন্ত তিন চার দিনের বেশী হয় না। এজাতীয় আন্দোলনের ধারা এই দেশে (১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনেই বিশেষ করে) সৃষ্টি হয়। এ জাতীয় সংগ্রামের কৌশল পূর্বপাকিস্তানেও কমবেশী অনুকরণ করা হয়। কিন্তু পূর্ব বাংলার বাঙালীরা এ সংগ্রামের সীমা ও দুর্বলতা দুটোই ধরতে পেরেছেন- তিক্ত ও রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। তাই আজ যে পূর্ব বাংলার সার্বিক অসহযােগের আন্দোলন সৃষ্টি হয়েছে সঙ্গে সঙ্গে পালটা সরকার ও পালটা হুকুমের কেন্দ্র সৃষ্টি করা হচ্ছে, শাসন ব্যাপারে নিজেরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চলেছে যে সরকার (বেসামরিক) আছে তাকে করায়ত্ত করে ফেলার উপক্রম করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে হাজার মাইল দূর থেকে সশস্ত্র সংগ্রাম চালনা করা ইয়াহিয়া খানের পক্ষে অসম্ভব হতে বাধ্য। হাজার খানেক লােককে রাস্তায় রাস্তায় গুলী করে মেরে ইয়াহিয়া খান যে হুমকি দিতে চেয়েছিলেন সেটা ব্যর্থ হয়েছে, কার্যত সামরিক বহিনী ব্যারাকে ফিরে গেছে। ভুট্টোর সুর নরম হয়ে গেছে। পশ্চিম পাকিস্তানেই অন্যান্য দলের নেতারা মুজিবরের সঙ্গে বােঝাপড়া করার জন্য এবং মুজিবরের দাবি মেনে নেবার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কোন মুখে আজ ইয়াহিয়া খান ঢাকায় গিয়ে মুজিবরের সঙ্গে দেখা করেন সেটাই বােধহয় সমস্যা।
রাজনৈতিক কলা কৌশল বা ট্যাকটিকস এর দিক থেকেও মুজিবর রহমান খুবই বুদ্ধিমানের মত চলতে পারছেন বলে মন হয়। প্রতিটি চালে অপরাধটা বা অন্যায়টা যে প্রতিপক্ষের, এটা দেখতে পারাই হলাে রাজনৈতিক কৌশলের সার্থকতা। মুজিবর সাহেব ইয়াহিয়া খানের “স্থগিত প্রস্তাবের ভুল ধারণা করেছেন। এবং ইচ্ছা করেই পূর্ব পাকিস্তানে অরাজকতার ডাক দিয়েছেন, এ-অভিযোেগ আজ আর টেকে না। বৃহত্তম দেশের নেতার সঙ্গে পরামর্শ না করে, কেন ইয়াহিয়া খান অপেক্ষাকৃত ছােট দলের নেতার পরামর্শে অধিবেশন স্থগিত রাখলেন, সে যুক্তি ইয়াহিয়া খান দেখাতে পারেননি। ফলে অপরাধটা গিয়ে বর্তালাে ইয়াহিয়া খানেরই উপর। দ্বিতীয়ত ভুট্টোকেই পশ্চিম পাকিস্তানের একমাত্র প্রবক্তা বলে স্বীকার করার যৌক্তিকতা দেখনাে মুশকিল। কেননা পশ্চিম পাকিস্তান বলে কোন একটি ইউনিট আজ আর নেই, সেখানে আছে চারিটি প্রদেশ- যথা পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশ। এই চারিটি প্রদেশের মাত্র দুটি প্রদেশে বর্তমান যে পিপলস পারটি তার নেতাকে চারিটি প্রদেশের প্রবক্তা বলা চলে না। উপরন্তু সেখানে অন্য কয়েকটি দল পাক-গণপরিষদে যােগ দেবার জন্য ঢাকায় পৌছে পর্যন্ত গিয়েছিলেন। তৃতীয়ত। পূর্ববাংলার অন্যান্য দল যথা, ন্যাপ ও তার নেতা ভাসানী, গণতান্ত্রিক ফ্রনটের আয়ুর রহমান, নুরুল আমিন এদের সকলকেও এই জাতীয় সংকটের দিনে মুজিবুর রহমান স্বতঃপ্রণােদিত হয়ে ডাকেন ও তাদের সকলের সমর্থন নেন- অর্থাৎ বাংলাদেশে কোন ভিন্ন সুর বা বেসুর রাখতে দেননি। এতে বাঙালীর একতা সম্পূর্ণ রক্ষা করা গেছে। চতুর্থত, পূর্ববাংলার আজ যেসব অতিবাম উপদল আছেন, যারা নকশালদের মত অস্ত্র ধরার। পক্ষপাতী, তাদের পাল থেকেও হাওয়া কেড়ে নিতে পেরেছেন মুজিবর রহমান- অন্তত যে পর্যন্ত বর্তমান সংগ্রাম জোরদার থাকবে, ক্রমবর্ধমান থাকবে, পালটা সরকার শক্তিমান ও স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এদের বিশেষ কোন স্বতন্ত্র ভূমিকা থাকা সম্ভব নয়। অতএব বলেছিলাম, আজ পূর্ববাংলার যে সংগ্রাম চালু হয়েছে, তা আপন ক্রমবর্ধমান শক্তিতে যেমন দূর্বার তেমন শৃঙ্খলাবােধ- সংযত ও দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন। এর কাছে নতিস্বীকার করা ছাড়া ভূট্টো অথবা ইয়াহিয়া খানের কাছে অন্য কোন পথ আছে বলে মনে হয় না।
২৩ মার্চ, ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা