You dont have javascript enabled! Please enable it!

পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহ এবং ভারত

— রণজিৎ রায়

দেশ বিভাগের অব্যবহিত পর থেকেই ভারত এবং পাকিস্তানের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটানা শনির দৃষ্টি চলেছে। উভয়েই উভয়কে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একঘরে এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষেত্রে দুর্বল করে তােলার চেষ্টা করেছে। ১৯৬৫ সালে কচ্ছের রাণ অঞ্চলে ছােট ধরনের লড়াই ছাড়াও দেশ দুটি দুবার পুরােদস্তুর যুদ্ধ করেছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। তাতে সমস্যা কিছুই কমেনি; বরং নতুন সমস্যার সংখ্যা বৃদ্ধি ঘটেছে। বাণিজ্যিক সম্পর্কের দ্বারা দু’দেশই লাভবান হতে পারে। কিন্তু যুদ্ধের পর থেকে তা বন্ধ। সাম্প্রদায়িক রক্ত না থাকলে একের অভ্যন্তরীণ গােলযােগে অন্যে উদ্বিগ্ন হয়নি কখনাে। পশ্চিম পাকিস্তানের মাথায় ভারত-রূপ ব্যথাটি তাে নিত্য কামড়াচ্ছে। অভ্যন্তরীণ সমস্যার তুপ থেকে লােকের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেবার জন্য ইসলামাবাদ ভারত-বৈরিতাকে সব সময়েই কাজে লাগাচ্ছেন। গণতান্ত্রিক অধিকার কেড়ে নিয়ে জঙ্গী শাসন বলবৎ করার ব্যাপারেও পাকিস্তানী জঙ্গী নেতারা ভারত-বৈরিতার টোপ পাকিস্তানের মানুষকে গিলিয়েছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের পানজাবিদের কাছে এ ধরনের সামরিক শাসনই পরম উপাদেয়। এর দ্বারা তারা পূর্ব পাকিস্তানকে উপনিবেশ হিসাবে ব্যবহার করে তার সম্পদ লুটে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের ঋদ্ধি বাড়াতে পেরেছেন।

শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই বলেছেনঃ এমন এক সময় ছিল যখন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের উপর যে শােষণ এবং নির্যাতন চালানাে হয়েছে তার থেকে তাদের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভারত-বিরােধিতাকে কাজে লাগিয়েছে। পুরাে দুই দশক ধরে-পূর্বপাকিস্তানের ন্যায্য দাবি দমিয়ে দেওয়ার জন্য পশ্চিম পাকিস্তান তিন প্রধানমন্ত্রী সমেত পূর্ব পাকিস্তানের অনুগত নেতাদের কাজে লাগিয়েছে। মাঝে মাঝে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি সােচ্চার হয়ে উঠেছে। নিষ্ঠুরভাবে সে দাবির কণ্ঠরােধ করে দেওয়া হয়েছে। অবশেষে এসেছে হিসাব-নিকাশের দিন। পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ অতীতে এ ব্যাপারে এক গৌরবজনক ভূমিকা নিয়েছেন; নিচ্ছেন এখনাে। ১৯৪৮ সালেই ওদের কণ্ঠে বিদ্রোহের ধ্বনিত হয়। মােহাম্মদ আলি জিন্না পূর্ববঙ্গের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পূর্ববঙ্গের বহু ছাত্র নিজেদের জীবন বলি দিয়ে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে গিয়েছেন।

ভাষার প্রশ্নে যে বাঙালী জাতীয়তাবােধের জন্ম তা শীঘ্রই প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে পানজাবি প্রভুত্বের বিরুদ্ধেও বাষ্ময় হতে শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের দ্বারা অর্জিত বিদেশী মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের ভােগে লাগান হতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিমী মালিকদের কলকারখানা থেকে লম্বা মুনাফাও পশ্চিমে চালান হয়ে যায়। এমন কি বিদেশী সাহায্যেরও অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানকেই দিয়ে দেওয়া হয়। ফলে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য দ্রুত প্রকট হয়ে উঠতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ ক্রমশ দরিদ্রতর আর পশ্চিম পাকিস্তান সমৃদ্ধতর হয়ে উঠতে থাকে।  পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলন অনেকগুলি পর্যায় পেরিয়ে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পানজাবি প্রভুরা এই আন্দোলন দমনে হেন কৌশল নেই যে প্রয়ােগ করেনি। কিন্তু আন্দোলন দমিত তাে হয়নিই, বরং প্রতি পর্যায়ে তা আরাে জোরদার হয়ে উঠেছে। এ আন্দোলন দমনের সর্বশেষ কৌশলটি করেছিলেন প্রেসিডেন্ট আয়ুব খাঁ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়ে। কিন্তু তার কৌশল তাকেই হেনেছে। আয়ুব খা ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে বাধ্য হয়েছেন; আর যে মুজিবুর রহমানকে ভারতের চর বলে জেলে পুরে দিয়েছিলেন সেই শেখ জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতারূপে।

বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ পশ্চিমের শােষণমুক্ত হওয়া এবং স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য মরণপণ লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এবং জনাব ভুট্টো আপসের সব রাস্তাই বন্ধ করে দিয়েছেন। কিন্তু মুজিবুর তার ছয় দফা দাবিতে অটল। বর্তমান গােলযােগের পরও দুই পাকিস্তান এক রাষ্ট্র হিসাবেই  হয়ত টিকে থাকবে; কিন্তু আওয়ামী লীগের শর্ত মেনে না নিলে বাংলাদেশের (অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের সম্পর্ক অবশ্যই আর আগের মত থাকবে না।

পাশ্চাত্যের কূটনীতিবিদূরা মােটামুটি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে আগামী দু’এক বছরের মধ্যে পাকিস্তান টুকরাে হয়ে যাবে; তা যদি না যায় তা হলেও মূল ক্ষমতা প্রদেশগুলির হাতেই চলে যাবে। পূর্ব পাকিস্তানের দাবি যদি গৃহীত হয়, তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের নানা ভাষাভাষি সম্প্রদায়ও তাদের দাবি নিয়ে এগিয়ে আসতে বাধ্য। পশ্চিম পাকিস্তানে অনেকেই শ্রীভুট্টোকে এই বলে সমালােচনা করেছেন যে, তার একগুয়ে মনােভাবের ফলে পাকিস্তান ভেঙে যেতে বসেছে। শ্রীভুট্টো নিজে সিনধি। পানজাবিরা পূর্ব পাকিস্তানকে দমিয়ে রাখার জন্য কিছুকাল হয়তাে তাকে কাজে লাগাতে পারবেন কিন্তু পাঠান বা বালুচিরা এ নীতি মেনে নিয়ে চুপ করে প্লাকবেন না। তাদেরও উচ্চাকাঙক্ষা আছে।

পাকিস্তানের ঘটনাধারা, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের প্রচণ্ড বিক্ষোভের চেহারায় নয়াদিললিও খুশি। সাধারণত পাকিস্তানে গােলযােগ বাধলে দিললি খুশিই হয়; কারণ, তার দ্বারা পাকিস্তানের পক্ষ থেকে ঝামেলার আশংকা কমে। কিন্তু এবারের ঘটনার প্রকৃতি স্বতন্ত্র। পাকিস্তান যদি দু’ভাগ হয়ে যায়, কিংবা পূর্ব পাকিস্তান যদি সত্যিকারের রাজনীতিক ও অর্থনীতিক স্বায়ত্তাধিকার লাভ করে, তা হলে ভারতের উপর তা গভীর প্রভাব ফেলবে। | ভারত অবশ্য গণতান্ত্রিক দেশ। কিন্তু অর্থনীতিক সংগঠনের দিক থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে তার বিশেষ কোন পার্থক্য নেই। আমরা সর্বশক্তিমান কেন্দ্রের অধীনে এক কেন্দ্রীকৃত অর্থব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। এ ব্যবস্থায় কতগুলি রাজ্য অন্যান্য রাজ্যের সম্পদ পেয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরা যাক। সে প্রচুর পরিমাণ সম্পদ উৎপাদন করে এবং বিদেশী মুদ্রা দেশে আনে। কিন্তু ১৯৪৭ সালের তুলনায় তার অবস্থা ক্রমশই খারাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আঞ্চলিক বৈরিতা ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠেছে। রাজ্যের হাতে অধিকতর আর্থিক অধিকার দেবার দাবিও বর্তমান। ভারত যে বর্তমানে এক সংকটজনক অবস্থার মধ্যে দিয়ে চলেছে তা অত্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের বিদ্রোহে ভারত সরকার কিছুটা নিশ্চিন্ত ঃ সীমান্তে কিছুদিন গােলযােগ কম থাকবে। কিন্তু যারা পাকিস্তান দু’ভাগ হয়ে যাবে মনে করে ভারত সরকার তাদের দলে নেই। পাকিস্তানে নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার দিন কয়েক পর ভারত সরকারের জনৈক অফিসার কয়েকজন সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেন, “পাকিস্তান টুকরাে টুকরাে হয়ে যাক- এটা আমরা চাইনা।” তিনি কী বলেছিলেন সে সম্পর্কে তিনি নিশ্চয়ই সচেতন ছিলেন।

পূর্ব পাকিস্তান যদি পৃথক দেশ হয়ে দাঁড়ায় তা হলে সে ভারতের সীমান্তে একটি আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের  ঘাঁটি হয়ে দাঁড়াবে। আমেরিকা, চীন, সােভিয়েত ইউনিয়ন- সকলেই তাকে হাত করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে। তাছাড়া, নয়া দিলির ধারণা ও পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র বা পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনাধিকার সম্পন্ন হয়ে। দাড়ালে পুরাে উপমহাদেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাবে। | দেশের পূর্বাঞ্চলে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে প্রথমে এর প্রভাব পড়বে। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিক সফরকালে শ্ৰীমতী গান্ধী দেখে এসেছেন সে রাজ্যের তরুণ সম্প্রদায়, এমন কী যুব কংগ্রেসের সদস্যরাও পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় উত্তেজিত। সি পি এম ইতিমধ্যেই পশ্চিমবঙ্গের জন্যে অধিকতর ক্ষমতার দাবি জানিয়েছে। শ্লোগানটা গেয়ে গেলে নয়াদিললির পক্ষে তা কঠিন সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। পশ্চিমবঙ্গের দৃষ্টান্ত অন্যান্য রাজ্যও অনুসরণ করতে পারে। সুতরাং পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনায় ভারত সরকারের উদ্বিগ্ন বােধ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

১০ মার্চ, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!