এক নির্দয় দয়েল পাখি
— সুভাষ মুখােপাধ্যায়
আগের আগের দিন রাত্রে মােমবাতির আলােয় সাতক্ষীরায় মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে বসে আমি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা পড়ছিলাম। আমার মাথায় তখন একটা আইডিয়া ঘুরছিল-জীবনানন্দের বাংলাদেশ নিয়ে একটা ডকুমেন্টারি ছবি করার। ইমেজ ইন্ডিয়ার জ্যোতি রায় ছিলেন আমাদের সঙ্গে। আমার ইচ্ছের কথা বলায় জ্যোতি তৎক্ষণাৎ রাজী হয়ে গেল। রাত্রে বসে বসে আমি তাই জীবনানন্দের কবিতা থেকে চিত্রকল্পের মালা গাঁথছিলাম। বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ/খুঁজিতে যাই না আর…’ এই কথাগুলাে পেরিয়ে আসবার পর আমার চিত্রনাট্যের বাদিকের স্তম্ভে লিখলাম ও অন্ধকার জেগে উঠে ডুমুরের গাছে/চেয়ে দেখি। ছাতার মতন বড়াে পাতাটির নিচে বসে আছে/ভােরের দয়েল পাখি।’ ‘ইস্ট পাকিস্তান রাইফস’-এর মুক্তিযােদ্ধা হক সাহেব বসে গল্প করছিলেন। লেখা থামিয়ে হক সাহেবকে আমি জিগ্যেস করলাম-আচ্ছা, হক সাহেব এদিকে দয়েল পাখি দেখতে পাওয়া যায়? কুমিল্লার লােক হলেও বেশ কিছুদিন তার কেটেছে যশাের ক্যান্টনমেন্টে। বললেন, নিশ্চয় পাবেন । জ্যোতিকে জিগ্যেস করলাম-ডােরবেলা, ডুমুরগাছ, বড় পাতার নিচে বসে থাকা দয়েল পাখি, এসব কী। ক্যামেরায় তােলা সম্ভব? ক্যামেরাম্যান সত্যবাবু বললেন, নিশ্চয় সম্ভব। | বিজ্ঞাপন কোম্পানির আংশিক সময়ের চাকরিটা আসবার ঠিক আগে রাগ করে ছেড়ে দিয়ে এসেছি। কাজেই ডকুমেন্টারি ছবি তােলার ব্যাপারটা আমার মনের মধ্যে বেশ তােলপাড় করছিল। নইলে শুধু বই লিখে তাে আর সংসার চালাতে পারব না। দয়েল পাখি দেখতে কেমন? কিছুতেই মনে পড়ছিল না। আরও খানিকক্ষণ লেখালেখি করে মােমবাতি নিবিয়ে শুয়ে পড়লাম। তার ঠিক একদিন পরে সকালবেলায় যশাের শহরের উপকণ্ঠে ইটখােলার মাঠে নাকে কাপড় দিয়ে হক সাহেব হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘ঐ দেখুন, দয়েল পাখি।’ দয়েল পাখি। হঁ্যা, সত্যিই দয়েল পাখি । আশপাশের গ্রামের লােকজনও তাই বলল ।
একটা দয়েল পাখি । অর্ধভুক্ত একটা শবদেহের ওপর বসে তার গা থেকে খুঁটে খুঁটে খাচ্ছিল কৃমি। কয়েক হাত দুরে আরেকটা শবদেহ । তন্ময় হয়ে তার পায়ের দিকটা ছিড়ে খাচ্ছিল একটিমাত্র কুকুর। আমরা খুব কাছে নাকে রুমাল দিয়ে দাঁড়িয়ে। জোরে জোরে কথা বলছি। দয়েলপাখি কিংবা কুকুরটার কোনাে ভ্রুক্ষেপ নেই। | চারদিকে তাকালাম। অনেকখানি দূরে মাঠের মধ্যে চুপচাপ বসে রয়েছে একদল কুকুর। ধারে কাছে। চিল বা শকুনের কোনাে চিহ্ন নেই। একজন বলল, আগে আগে আকাশ কালাে করে শকুনের দল ঘুরে। বেড়াত। খেয়ে খেয়ে এখন ওদের অরুচি ধরে গেছে। বাড়ির পােষা কুকুরগুলাে এখন আর বাড়ির ভাত খায় । তারা দিনরাত মাঠেঘাটে ঘুরে মড়া খেয়ে বেড়ায় । ইটখােলার মাঠ যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে শহরের ময়লানিকাশের বাঁধানাে একসার নর্দমা আর গর্ত । রাস্তার ঠিক ধারেই স্তুপাকার হয়ে রয়েছে কয়েক ডজন মাথার খুলি। পাক ফৌজ থাকার সময় গাছের গায়ে। দড়ি টাঙিয়ে মাথার খুলির মালা টাঙানাে থাকত। যাবার আগে সেসব মুণ্ডমালা ওরা খুলে নিয়ে এদিকে সেদিকে খালেবিলে ফেলে দিয়ে গেছে। ঠাইনাড়া করতে গিয়ে যে কয়েকটা গাড়ির তলায় গড়িয়ে পড়েছিল, সেই কয়েকটাই এখন রাস্তার ধারে দেখতে পাওয়া যাবে। | একটা কথা বলে রাখা ভাল-সাতক্ষীরা কিংবা যশােরে যেসব জায়গায় নরকঙ্কাল কিংবা শবদেহ। স্তুপাকারে ছড়িয়ে আছে, আমি তার একটা কী দুটো জায়গার বেশি দেখিনি। সঙ্গে গিয়ে দেখে আসার জন্যে গ্রামের লােকজনেরা টানাটানি করেছে। কিন্তু দুটো একটা জায়গার বেশি যাইনি। যেতে ইচ্ছে করেনি।
পঞ্চাশের মন্বন্তরের কথা মনে আছে। সে সময় মেদিনীপুর আর বিক্রমপুরের গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। লােকে যেখানেই ডেকে নিয়ে গেছে গিয়েছি। দুর্ভিক্ষ আর মহামারীতে মৃত মানুষের মিছিল দেখে সেদিন যত না কষ্ট পেয়েছি, তার চেয়ে ঢের বেশি মন খারাপ হয়েছে এবার নিহত মানুষের হাড়ের পাহাড় দেখে। তাই নানা অছিলায় এবার গ্রাম শহরের বধ্যভূমিগুলাে এড়িয়ে গিয়েছি। একেবারে এড়ানাে সম্ভব নয়। যশােরে এসে পৌঁছনাের দিন সার্কিট হাউসের ভেতরে গাড়ি রেখে সবে নেমে দাঁড়িয়েছি, বন্দুকধারী একজন মুক্তিসেনা আমাদের ডেকে বললেন, এই গ্যারেজটার পেছন দিকে একবার আসুন। পেছনে যাওয়ামাত্র নাকে রুমাল চাপা দিতে হল। ইট চাপা দেওয়া একটা গর্তের ভেতর থেকে গন্ধ আসছিল। গর্তের বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কয়েকটা ছেড়া কাপড়, লুঙ্গি আর গেঞ্জি। তার তিন হাত দূরে বাঙ্কারের মুখে কয়েকটা বালির বস্তা। তার গায়ে ভন্ ভন্ করছে মাছি। | ইটখােলার আশপাশে ময়লানিকাশী গর্তগুলাে বাসি ছিল ইস্কুলবাড়ি। পাক ফেীজ আর রাজাকারদের হাতে পড়ে লােকমুখে ইস্কুলবাড়িটার নতুন নাম হয়েছিল কশাইখানা।
এই কশাইখানায় খুন-হওয়া ঐ এলাকার তিন হাজার জনের মধ্যে একজন ছিলেন চৌবেড়ের প্রবীণ ধর্মপ্রাণ মানুষ আফসার হাফিজ। তাকে ধরে এনে দিনের বেলায় ইস্কুলের সামনের উঠোনে জবাই করে ছেড়ে দেওয়া হয়। সারা রাত শুয়ে শুয়ে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি কলমা পড়েছেন। রাস্তা দিয়ে যেতে আসতে গাঁয়ের লােকে শুনেছে। | পরদিন সকালেও তিনি বিড় বিড় করে কলমা পড়ছিলেন। তারপর তাকে যখন গর্ত খুঁড়ে শুইয়ে দেওয়া হল, তখনও তিনি কলমা পড়ে যাচ্ছিলেন। শুধু মাটি চাপা দেবার ঠিক আগের মুহূর্তটিতে দুহাত দিয়ে তিনি তার চোখদুটো ঢেকে দিয়েছিলেন। যশােরে আহম্মদ খানের ইটের ভাটার দক্ষিণ-পশ্চিমে আরেকটি ইটের ভাটা তাহের আলীর। এখানেও সেই একই দৃশ্য। গর্তের মধ্যে পচাগলা শবদেহ। মাঠের মধ্যে ইতস্তত মড়া ছিড়ে খাচ্ছে তিন-চারটে ঘাড়েগর্দানে হওয়া কুকুর। এখানে সেখানে ছাড়িয়ে আছে টুকরাে কাপড়, লুঙ্গি, গেঞ্জি। নতুনের মধ্যে শুধু একটা উলে-বােনা পুলওভার। কিন্তু আশ্চর্য, এক পাটি জুতােও কিন্তু কোথাও পড়ে থাকতে দেখিনি। | ইটখােলার আসবার রাস্তায় হঠাৎ দেখা হয়ে গেল নিউ টাউনের উত্তরে বাহাদুরপুরের লুৎফর রহমানের সঙ্গে। বছর কুড়ি বয়স । রক্তহীন ফ্যাকাশে চেহারা। একজন তার শার্টের বােতাম খুলে ডান কাঁধের দিকে কণ্ঠার হাড়ের কাছটা দেখাল । ডুমাে ডুমাে হওয়া ক্ষতবিক্ষত দাগ। ঘা এখনও পুরাে শুকোয়নি। তার শুকিয়েযাওয়া দুর্বল শরীরটার দিকে তাকিয়ে খুব মায়া লাগছিল। ছােরা না বেয়নেট? উঁহু। বলে এবার পিঠের দিকে দেখাল দুটো ফুটোর দাগ।
লুৎফরকে ওরা গুলি করে মারতেই চেয়েছিল। একা লুঙ্করকে নয়। একসঙ্গে চল্লিশ জনকে। গুলি খেয়েও কপালের জোরে বেঁচে গিয়েছিল চারজন। সেই চারজনের একজন লুৎফর। চাষীর ছেলে লুৎফর। চৈত্র সংক্রান্তির দিন হাল দিয়েছিল মাঠে। তারপর বীজ বােনার পালা। পয়লা বৈশাখ সকালবেলা গাঁসুদ্ধ লােক যে যার বাড়িতেই ছিল। হঠাৎ বাহাদুরপুর গ্রামে এসে হানা দিল চব্বিশজন পাক সেপাই । লুৎফরকে তারা গ্রামের রাস্তাতেই পাকড়াও করেছিল। বলেছিল কোন্ কোন্ বাড়িতে হিন্দুরা থাকে দেখিয়ে দাও। লুঙ্কর বলেছিল, হিন্দু যারা ছিল তারা অনেক আগেই গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছে। তাই বলে লুৎফরকে তারা ছাড়েনি। বাঙালী মুসলমানদের বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে জোয়ান-মরদ চল্লিশ জনকে ধরে তারা গ্রামের বাইরে মাঠের মধ্যে নিয়ে গেল। তারপর তাদের লাইন বেঁধে কী দাঁড় করিয়ে দিল? না। কনুইতে ভর দিয়ে তাদের শুয়ে পড়তে বলা হল। তারপর সামনে থেকে গুলি করল? না। গুলি করল পেছন থেকে। লুফরের পিছে দুটো ফুটো সেইজন্যেই । গুলি দুটো বেরিয়ে গিয়েছিল কণ্ঠার হাড় ভেঙে। | গুলি লাগার পর লুফরের যে খুব যন্ত্রণা হয়েছিল তা নয়। পুরাে হুঁশ ছিল লুঙ্করের। সে দেখতে পেল যারা দু-দুটো গুলি খেয়ে আধমরা হয়ে কাতরাচ্ছিল, তাদের কাছে এসে পাক সেপাইরা আরও দু-চারটে গুলি করে তাদের চিৎকার বন্ধ করে দিচ্ছিল। লুঙ্কর তাই দেখে একেবারে মড়ার মতাে ঘাপটি মেরে পড়ে থাকল। সেপাইরা চলে যাবার আধঘণ্টা পরে লুঙ্কর তার ক্ষতস্থানে গেঞ্জি গুজে দিয়ে কোনরকমে টলতে টলতে গ্রামে ফেরে। ঢুকবার মুখে প্রথম যে বাড়ি, সেই বাড়িতে এসে যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায়। হাসপাতালে তাকে থাকতে হয়েছিল একটানা ছ’ মাস। | ম্লানমুখে লুৎফর বলল-ডান হাতটা এখন আর আমি ওঠাতে পারি না। কেমন করে আর চাষের কাজ করব বলেন তাে? | ইটখােলার ভেতর কাঁচা কবরগুলাে দেখছিলাম, তাকিয়ে দেখি একজন চশমাচোখে বুড়াে ইটের পাঁজার। গায়ে দাঁড়িয়ে। বলল, আমার বৃত্তান্তটা একটু লিখে নেন।
কী নাম? কালাই শেখ। বয়স কত? আশী। কালাই শেখ থাকতেন বাহাদুরপুর গ্রামে জামাইয়ের বাড়িতে। জামাই করত চাষের কাজ। আর ঐ গ্রামেই কালাই শেখের ছেলের একটা ছােট দোকান ছিল। সেপাহিরা বাহাদুরপুরে ঢুকে দোকানটা লুঠ করে । কালাই শেখের ছিল জমানাে সত্তরটা টাকা। সেটাও তারা লুঠ করে নিয়ে যায়। আর যাবার সময় ধরে নিয়ে যায় তার ছেলে আর জামাইকে। গুলি খেয়েও জামাই কোনরকমে প্রাণে বেঁচে যায়। কিন্তু জীবনে তার সে। চাষের কাজ করতে পারবে না। দুটো হাতই তার অকেজো হয়ে গেছে। গুলি খেয়ে মারা গেছে কালাই শেখের অন্ধের নড়ি ছেলেটা। দিনের খানিকটা সময় কালাই শেখ ছেলের দোকানে গিয়ে বসতেন। এখন? জামাইয়ের সংসারও তাে অচল, কালাই শেখকে তাই বুড়াে বয়সে ভিক্ষেয় বেরােতে হয় । | কত লােক খুন হয়েছে এ তল্লাটে? কে হিসেব রাখে তার? ওয়াপদার যে রেস্টহাউসে আমরা ছিলাম, সেখানকার ঝাড়ুদার সুখলাল ডােম বলল,-তা কম করে সাত হাজার তাে হবেই। মড়া ফেলার কাজ তাকেও করতে হয়েছে। তবে পয়সা দেয়নি। মড়া ফেলার জন্যে দিয়েছে আটা আর তেল। | রাজাকার কত ছিল? এক সাতক্ষীরা মহকুমাতেই পঁচিশ হাজার। বাড়িতে চাল টাকা ঘুষ দিয়ে লােক জোটানাে হত । কেউ এসেছে অভাবে, কেউ লােভে, কেউবা বাড়ির লােকদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচতে পারার আশায়। মাস মাইনে নব্বই টাকা। কিন্তু অনেকেই এই মওকায় কামিয়ে নেবার জন্যে লুটপাট করে মাসে পাঁচ-ছশাে টাকা রােজগার করেছে। আর পাক সেপাইরা? সাতক্ষীরার কাছে এক বাঙ্কারের ধারে মুক্তিফৌজের হাতে নিহত এক পাক সেপাইয়ের পকেটে পাওয়া গিয়েছিল নগদ সতেরাে হাজার টাকা। আর সেই দয়েলপাখি? |বড় হৃদয়হীন একটা ব্যাপার ঘটে গেল আমার জীবনে। আমি কি আর আমার কবিতায় কোনদিন। শান্তভাবে দয়েল পাখির কথা বলতে পারব?
১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা