You dont have javascript enabled! Please enable it!

আমারও মুক্তিযুদ্ধ

— অন্নদাশংকর রায়

প্রথম পর্যায়ে এটা ছিল ওপারের জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্ধারিত দিবসে সম্মিলিত হয়ে সংবিধান রচনায় অহেতুক বাধাদানের উত্তরে অহিংস অসহযােগ তারপর অসামরিক প্রশাসনের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা। কেউ আমাদের হস্তক্ষেপ চায়নি। আমারও অনাহূত হয়ে হস্তক্ষেপ করিনি, দূর থেকে তটস্থ হয়ে অবলােকন করেছি, মনে মনে তারিফও করেছি। | দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় স্মরণীয় পঁচিশে মারচ তারিখে। সেদিন সকালে উঠে খবরের কাগজ পড়ে আমার ধারণা হয়েছিল প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবর রহমানের কথাবার্তা সফল হতে চলেছে, আজকেই মিটমাট হয়ে যাবে। মিষ্টান্ন আনিয়ে ঘটনাটিকে সেলিব্রেট করব ভেবেছিলাম। কিন্তু রেডিও পাকিস্তান যতবার খুলি ততবার নীরব। বুঝতে পারিনে কি ব্যাপার মনটা ভরে যায় উদ্বেগের। কিন্তু কেন উদ্বেগ তাও বলতে পারিনে। রাত্রে শুতে গিয়ে ছটফট করি। কেউ আমাকে জানতে দেয় না কী প্রলয়ংকর কাণ্ড চলছে রাত ভাের ঢাকায় ও অন্যান্য শহরে। সকাল বেলায় যা পড়ি বা যা শুনি, তা সম্পূর্ণ অভাবিতপূর্ব। মিলিটারি অ্যাকশন। সেই দিনই রেডিওতে প্রচার করা হয় বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘােষণা করেছে। সেটার আর রেডিও পাকিস্তান নয়। ঢাকা বেতার কেন্দ্র। অভাবিতপূর্ব ও অভিনব সংঘটন। বিপ্লব আর কাকে বলে? বেধে যায় সহিংস সংগ্রাম। দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা কি নিষ্ক্রিয় থাকতে চাইলেও নিষ্ক্রিয় থাকতে পারি? নৈতিক সমর্থন জানাই, সীমান্তে গিয়ে সেবাশুশ্রুষার ব্যবস্থা করি। যদি কেউ সীমান্ত পার হয়ে মুক্তি সংগ্রামে অংশ নিতে চান তাতে তার সেই  ব্যক্তিগত প্রয়াস অনুমােদন করি। কিন্তু রাষ্ট্রহিসাবে অপর রাষ্ট্রের ঘরােয়া ব্যাপারে হস্তক্ষেপ অনুমােদন করি। তা করতে গেলে দেশ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বে আর যুদ্ধ জিনিসটা ঝোকের মাথায় করবার মতাে কাজ নয়।

সীমন্তের ওপারে যে সব পৈশাচিক কাণ্ড অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, তার খবর পৃথিবীময় ছড়িয়ে গেল। বিদেশী সাংবাদিকরাই প্রকাশ করে দিরেন। ওপার থেকে যারা ওপারে এলেন, সেই সব প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে। গভীর ভাবে বিচলিত হলুম। মানুষ যখন রাক্ষস হয়, তখন রাক্ষসকেও ছাড়িয়ে যায়। আমাদের মনে সন্দেহ রইল না যে সুপরিকল্পিতভাবে বাঙালী জাতিকে পাকিস্তানে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হচ্ছে। যাদের মৃত্যু অবধারিত তারা যদি পালটা মার দেয়, সেটা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়। যারা মারবেও না, মরবেও না, তাদের পালিয়ে আসাটা অস্বাভাবিক নয়। ভারত ছাড়া কোথায়ই বা তারা যাবে। দেশ ছেয়ে গেল শরণার্থীতে। গােড়ার দিকে যারা এল তাদের অধিকাংশই মুসলমান। পরে যারা এল, তাদের অধিকাংশই হিন্দু। বােঝা গেল বাংলাদেশকে হিন্দুশূন্য করে পাঞ্জাবের অনুরূপ করা হচ্ছে।

পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হস্তক্ষেপ করব না, সেটা ঠিক । তা বলে এটাও কি ঠিক যে, পাকিস্তানে বাঙালী মাত্রেই হবে সংখ্যালঘু, হিন্দুমাত্রেই হবে নির্মূল? এ ধরনের ব্যাপার জারমানিতে ঘটলে দুনিয়ার লােক প্রতিকার করতে ছুটে যায়, কিন্তু শত আবেদন নিবেদনের পরও দেখা গেল বিশ্ববিবেক অকর্মক । সকর্মক তা হলে হবে কে? ভারত, আবার কে! কিন্তু কীভাবে সকর্মক হবে? এই জিজ্ঞাসা আমাদের সবাইকে প্রতিনিয়ত অস্থির কোরে তােলে। গান্ধীবাদীরাও বলতে আরম্ভ করেন যে, শুধুমাত্র সেবাশুশ্রষা করে কোনাে ফল হবে। ওপারে গিয়ে লড়তে হবে। অহিংসভাবে সম্ভব না হলে সহিংসভাবে। কি লড়বে কে? কোথায় অস্ত্র? কোথায় তালিম? কোথায় সংগঠন?

ধীরে ধীরে উপলব্ধি করা গেল যে, বাংলাদেশের মুক্তি যােদ্ধাদেরই অস্ত্র জোগাতে হবে, তালিম করতে হবে। সংগঠিত করতে হবে। এসব কাজ ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে করা যায় না। করতে হবে রাষ্ট্রগত ভাবে। হ্যা দরকার হলে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে ভারতকে। এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে মাসের পর মাস কেটে যায়। ততদিনে কয়েক লক্ষ লােক নিপাত। ষাট সত্তর লক্ষ লােক উৎখাত। এমন সময় শােনা গেল পাকিস্তান বলছে সে যুদ্ধে নামবে, তার পেছনে নাকি অন্যেরা আছে, সে নিঃসঙ্গ একথা শােনার পর কে নিশ্চিন্ত থাকতে পারে। রাতারাতি সােভিয়েটের সঙ্গে চুক্তি করতে হলাে। না করলে ভারত যুদ্ধ করতে অনিচ্ছুক হতাে। পাকিস্তান তার সুযােগ নিয়ে আরও কয়েক লক্ষকে নিপাত করত, আরও চল্লিশ পঞ্চাশ লক্ষকে উৎখাত করত। 

রাজনৈতিক সমাধানের আশা অনেক দিন পর্যন্ত দুনিয়াকে নিশ্চেষ্ট রাখে। ক্রমে বােঝা গেল রাজনৈতিক সমাধান বলতে বােঝায় সংখ্যাগুরু রাজনৈতিক দলকে সংখ্যালঘুতে পরিণত করা ও সংখ্যালঘু রাজনৈতিক দলগুলিকে একত্র করে সংখ্যা গুরুতে পরিণত করা। তার জন্যে বহু লােকের নাম কেটে দিয়ে উপনির্বাচনের উদ্যোগ হলাে, পরে দেখা গেল উপনির্বাচন মাত্রই একতরফা। নতুন লােকেদের নিয়ে যে সরকার গঠন করা হবে সেটা অসামরিক হতে পারে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘু দলগুলির সরকার। এমনতর সরকার কি শরণার্থীদের অভয় দিতে পারে। বিশেষত যে সব সাম্প্রদায়িকতাবাদী দল হিন্দুদের উৎসাদনে সহায়তা করেছে ও ভিন্ন পন্থী মুসলমানদেরও দেশ থেকে তাড়িয়েছে। | কেবল ভারতের মতে নয়, আরও অনেকের মতে রাজনৈতিক সমাধানের অর্থ শেখ মুজিবরের প্রাণরক্ষা ও মুক্তি, তারপরে তার সঙ্গে কথাবার্তা ও বােঝাপড়া। অন্যান্য দেশের সঙ্গে ভারতের তফাৎ এইখানে যে ভারতের মতে এটা জরুরি। আর একটা দিনও সবুর করা চলে না। রাশিয়াও ভারতের সঙ্গে একমত হয়, তবে যুদ্ধে নামতে উৎসাহ দেয় না, বরঞ্চ বেশ কিছু দেরি করিয়ে দেয়। তার যথেষ্ট কারণ ছিল। যুদ্ধ বাধলে বিশ্বযুদ্ধে পরিণত হতে পারে। এতবড় দায়িত্ব কি চোখ বুজে নেওয়া যায়?

দেশের লােক হাজারবার বললেও ভারত সরকার পেছপা হন। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ইউরােপ আমেরিকায় গিয়ে সমস্যাটার প্রতি দৃষ্টি আকষর্ণ করেন। কিন্তু সফল হলেন কতদূর তা বলা যায় না। তবে লাভ এইটুকু হলাে যে ফ্রানসকে ও ব্রিটেনকে নিরাপত্তা পরিষদে নিরপেক্ষ ভূমিকা নিতে দেখা গেল। আজকের খবর ফ্রান্স  ও ব্রিটেন রাষ্ট্র সংঘের সাধারণ পরিষদেও নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছেন। ইতিমধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেছে। পঁচিশে মারচের মতাে স্মরণীয় দিবস ছ ডিসেম্বর। এই তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী সমাজবাদী ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ ভারতের স্বীকৃতি লাভ করেছে। এখন থেকে তৃতীয় পর্যায় শুরু। এখন এটা আর পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার নয়। রীতিমত আন্তর্জাতিক ব্যাপার। ভারত ও পাকিস্তান নামক দুই রাষ্ট্রের যুদ্ধ তাে বটেই, উপরন্তু পাকিস্তান ও বাংলাদেশ নামক দুই রাষ্ট্রের যুদ্ধ ।

রাষ্ট্রসজ্ঞে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব পাস করা হয়েছে। এ প্রস্তাব মান্য করা উচিত, কিন্তু ভারত পাকিস্তান মান্য করলেও বাংলাদেশ মান্য করবে না। কারণ সে তাে রাষ্ট্র সম্মের সদস্য বা স্বীকৃত রাষ্ট্র নয়। যুদ্ধবিরতির পরের ধাপ তাে শান্তি বৈঠক। সে বৈঠকে বাংলাদেশ থাকবে না, শেখ মুজিবর থাকবেন না, সে বৈঠক আদৌ বসবে কিনা সন্দেহ। কারণ ভারত একবার বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবার পর আর ফিরিয়ে নিতে পারবে না। এটা এমন একটা পদক্ষেপ যা প্রত্যাহার করা অসম্ভব। প্রথম তথা দ্বিতীয় পর্যায় যেমন সরল ছিল তৃতীয় পর্যায়ে তেমন নয়। পাকিস্তান ইচ্ছা করেই পশ্চিম প্রান্তে আর একটা ফ্রন্ট খুলেছে, যাতে কাশ্মীরকে বাংলাদেশের সঙ্গে জড়ানাে যায়। ভারত যদি বাংলাদেশে এগিয়ে যায় সেও কাশ্মীরে এগিয়ে যাবে। তাকে সেখান থেকে হটাতে না পারলে যুদ্ধবিরতিটা তারপক্ষে লাভজনক হবে। শান্তি বৈঠকে তার হাতে তুরুপের তাস থাকবে। সে বলবে বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয় কাশ্মীরও স্বাধীন হবে। বাংলাদেশ যদি প্লেবিসাইট হয় কাশ্মীরেও প্লেবিসাইট হবে।  তৃতীয় পর্যায়ই কি শেষ পর্যায়, না এর পরে চতুর্থ পর্যায় আসছে? যে পর্যায়ে ভারত পাকিস্তানের বাইরে যারা আছেন, তাঁরাও এই যুদ্ধে জড়িয়ে পড়বেন? কে জানে, কার সঙ্গে পাকিস্তান কী গােপন চুক্তি করেছে। চুক্তিবদ্ধ মানে অঙ্গীকার বন্ধ। পাকিস্তানের বিপক্ষে তার দোস্তরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সাধারণ পরিষদে ১০৪টি ভােট পাইয়ে দিয়েছেন। আর ভারতের বন্ধুরা ভারতকে পাইয়ে দিয়েছেন মাত্র ১১টি। দশটি দেশ ভােটদানে বিরত। পাঁচটি অনুপস্থিত। এর থেকে বােঝা যাচ্ছে যে তারা জাতীয় স্বার্থে চুক্তিবদ্ধ হয় ও চুক্তিঅনুসারে কাজ করে। যুক্তি অনুসারে নয়। বিবেক অনুসারে নয়।

সেইজন্য জোর করে বলতে পারা যাচ্ছে না। চতুর্থ পর্যায়ে কী আসছে। বৃহত্তর যুদ্ধ না চূড়ান্ত মীমাংসা। এমনও হতে পারে যে, কোনােটাই আসছে না, আসছে অচল অবস্থা। সামরিক ও রাজনৈতিক সেটলমেনট। পাকিস্তানের হাতে আরও একখানা তুরুপের তাস আছে, সেটা সে দেখবে কাশ্মীর না পেলেও বাংলাদেশ হারাবে। সে তার নিজের দখলী জায়গায় বিদেশী ঘাঁটি গেড়ে বসতে দেবে। সেটা হবে তার ঘরােয়া ব্যাপার। ঘরােয়া ব্যাপারে কেই বা হস্তক্ষেপ করতে যাচ্ছে? গেলে নতুন এক যুদ্ধ। আমি যতদূর দেখতে পাচ্ছি পাকিস্তানের সামরিক গােষ্ঠী ও তাদের বিভিন্ন মিত্রগােষ্ঠী ভারতকে শান্তিতে থাকতে দেবে না। বাংলাদেশকেও নিষ্কণ্টক হতে দেবে না। আর একটা যুদ্ধ হয় বাধবে না, কিন্তু ঠাণ্ডা লড়াই বহুকাল ধরে চলবে। একমাত্র সুখের কথা ভারত আর বাংলাদেশ এখন থেকে অভিন্ন হৃদয় বন্ধু । এ বন্ধুতা অটুট ঃ বাংলাদেশের দুর্দিনে ভারত তার জন্যে যা করেছে, আর কেউ তা করেনি। করতে পারত না। পাকিস্তানীরা আর কিছুকাল থাকলে, আরও কত হাজার লােক মারত, আরাে কত হাজার নারীর সম্মানহানি করত। আরও কত লক্ষ লােককে নির্বাসনে পাঠাতাে। ভারত এইসব পুরুষকে প্রাণে বাঁচিয়েছে, এই সব নারীর মান বাঁচিয়েছে। এইসব মানুষ ঘরবাড়ি জমি জমা ফেলে নির্বাসনে যাবার দুর্ভাগ্য থেকে বাঁচিয়েছে। | উপরন্তু বাঁচিয়েছে তার-নিজের রাষ্ট্রের সংখ্যা লঘুদের সাম্প্রদায়িকতবাদী জনতার হাত থেকে। জনতা আর বেশী দিন ধৈৰ্য্য ধরত বলে মনে হয় না। সাম্প্রদায়িকতা এখন চিরতরে গেল। আর সে অধ্যায়ের। পুনরাবৃত্তি হবে না। এই নিয়ে আমার প্রবন্ধ লেখাও ফুরােল। গান্ধী হত্যার পর স্বেচ্ছায় আমি নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলাম। আজ আমি সে দায় থেকে মুক্ত। এ যুদ্ধ আমারও মুক্তি যুদ্ধ ।।

১৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!