You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাঙালী, বাঙালীত্ব-জাতি ও সংস্কৃতি

— সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

অনেক রক্তপাত অনেক চোখের জল আছে এর পেছনে। তবু ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের স্বীকৃতিতে আমাদের ধ্যান ধারণার বাংলার যে চিন্ময়ী রূপটি ছিল তার সম্মান প্রতিষ্ঠা হয়ে গেল। একদিন রবীন্দ্রনাথ সারা পৃথিবীর কাছে বাংলাদেশের কথা পৌছে দিয়েছিলেন, আজ মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী তরুণরা পৃথিবীর কাছ থেকে বাঙালী জাতির জন্য অন্য একরকমের সম্মান আদায় করে নিল। | এই জাতটার ওপর দিয়ে কম ঝঞা-দুর্দিন যায়নি। বিদেশী শক্তির চক্রান্তে কয়েকশতাব্দীর মধ্যে দুটো বিশাল দুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তাতে মারা গেছে লক্ষ-নিযুত মানুষ। বৃটিশ আমলে ভয়ংকর ভাবে শােষিত ও অত্যাচারিত এই ভুখণ্ড। ১৯০৫ সালে বাংলাকে দু’ভাগ করে দেবার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সত্যিই দু’ভাগ হয়ে গেল। বাংলা বিভাগের দুঃখ হয়তাে আমাদের কোনদিন ঘুচবে না; কিন্তু এতদিন পর তার একটি খণ্ড যে বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন রাজ্য হতে পারলাে- এ আনন্দের অবধি নেই । ধর্মের প্রশ্নে দেশ ভাগ হয়েছিল, আজ স্বাধীন বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, যেখানে জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে নারী পুরুষের সমান অধিকার। 

আর্যসভ্যতার প্রথম যুগে অবজ্ঞাত এই বাঙালীরা বিভিন্ন আদিবাসী কৌমের সংযােগে গড়ে উঠেছে, তৈরী করেছে নিজেদের আলাদা সংস্কৃতি। পরবর্তীকালে আর্য ও ইসলাম সংস্কৃতির প্রভাব পড়েছে কিন্তু বাঙালী তা আত্মসাৎ করেছে। তারমধ্যে হারিয়ে যায়নি। আদি অষ্ট্রেলিয় বা বেডিডড, মঙ্গোলীয় শাখার প্যারােইয়ান, ইন্দো-আর্য ও শক-পামিরীয় উপাদান এবং মালয়-ইন্দোনেশীয়দের সংমিশ্রণে তৈরি হলাে যে জাত তারা খুব। বেশী লম্বাও নয়, বেঁটেও নয়, মাথার গড়ন দীর্ঘও নয়, গােলও নয়, নাক খুব টিকোলােও নয়, থ্যাবড়াও নয়, গায়ের রং খুব ফর্সাও নয়, ঘাের কৃষ্ণবর্ণও নয়। এই জাত সম্পর্কে বিদেশীরা নানারকম ধাঁধায় পড়েছে। কেউ বলছে এই জাত অতি বুদ্ধিমান। কিন্তু ভীরু, খুব খেতে ভালােবাসে, অথচ কাজ করে না। অতিরিক্ত বাক্যবাগীশ কিন্তু পরাধীনতা মানে না। রণ-দুর্মম জাতি হিসেবে বাঙালীদের কোনাে প্রসিদ্ধি নেই, যদিও দশাননজয়ী রামচন্দ্রের প্রপিতামহের সঙ্গে নাকি বাঙালী সৈন্যরা সজ্জিত চতুরঙ্গে যুদ্ধ করেছিল, দ্রৌপদীর স্বয়ম্বর সভায় পাণিপ্রার্থী ছিলেন তিনজন বাঙালী রাজা- যুদ্ধ করেছিলেন কৃষ্ণার্জুনের বিরুদ্ধে। টলেমি লিখেছেন গঙ্গাহৃদি (গংগারিডি) জাতির ঐরাবত বাহিনীর প্রতাপেই নাকি আলেকজান্দার ভারত পরিত্যাগ করেন। তবু গৌরব হয়নি বাঙালীর ভেতাে বাঙালী বলেই পরিচিতি। তিতুমীর, সুর্যসেন প্রভৃতির বীরত্ব অনেকটা বক্তিগত কীর্তি হিসাবে চিহ্নিত,- হঠাৎ ১৯৭১ সালে বাঙালীরা দেখিয়ে দিল নিছক সন্ত্রাস সৃষ্টিই নয়, সঙ্বদ্ধভাবে তারা কী অসম সাহসীকতার সঙ্গে লড়াই। 

করতে পারে। পঁচিশে মার্চ পূর্ব বাংলায় শুরু হলাে তাণ্ডব, তার পরদিন থেকেই তৈরী হয়ে গেল প্রতিরােধ বাহিনী। সুশৃঙ্খল এবং আধুনিকতম অস্ত্রে সজ্জিত নিষ্ঠুর পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রায় নিরস্ত্র বাঙালীজাতির এই রুখে দাঁড়ানাে পৃথিবীর ইতিহাসে নতুন দৃষ্টান্ত হয়ে রইলাে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন আমি নিজের চোখে দেখতে গিয়েছি কয়েকবার দেখেছি কী অসীম মনােবল তাদের, অসম্ভব কষ্ট সহ্য করেও প্রতিজ্ঞা পালনের কি অদ্ভুত দৃঢ়তা। বাঙালী হিসেবে তখন গর্ব অনুভব করেছি। ঠোট কাটা বিদেশী সাংবাদিকেরাও মুক্তিবাহিনীর প্রশংসা না করে পারেনি। বিলেতি পত্র পত্রিকায় প্রতিবেদন বেড়িয়েছে যে, কোনাে কোনাে দিকে বাঙালী গেরিলারা ভিয়েনামী গেরিলাদের থেকেও বেশী সার্থক। বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন করছে। বাংলা দু’ভাগ হবার দুঃখ আমরা অনেকেই কোনদিন ভুলবাে না, কিন্তু মেনে নেব। ইতিহাসের গতি আঁকাবাকা হলেও জোর করে বদলানাে যায় না। খণ্ডিত বাংলার এক অংশ বাংলাদেশ নামে স্বাধীন হলাে। এ পাশে পড়ে রইলাে যে পশ্চিম বাংলা, সে কি আর তা হলে বাংলা নয়, সেখানকার মানুষ নয় বাঙালী? বৃটিশ আমলে যা ছিল বাংলাদেশ বা বেঙ্গল, ইতিহাসে কোনদিনই তা স্থায়ী ভাবে এক রাজ্যের অধীন ছিল না, অনেক সময় নামও বদলেছে, পুন্ড্র, গৌড়, রাঢ়, সুহ্ম, বজ্র, সমতট ইত্যাদি আঞ্চলিক নাম উদ্ভূত হয়েছে।  

বরং ইতিহাসের সাক্ষ্য প্রমাণ থেকে পাওয়া যায়, পূর্ব বাংলারই বাংলাদেশ নামের ওপর অধিকার বেশী। আকবরের আমলে পূর্ব পশ্চিম ভূখণ্ড সুবে বাংলা নামে চিহ্নিত হওয়ায় গৌড় জনবাসীরাও বাঙালী হয়েছিল। যাই হােক ১৯৪৭ এর পর আমরা মর্মে মর্মে বুঝেছি, বাঙালী কোনাে ভৌগােলিক সীমানার ওপর নির্ভরশীল নয়- ধর্মের প্রশ্নে নয়, সাংস্কৃতিক মিলেই আমরা বাঙালী। এবং এর পরেও তাই থাকবাে। | একথাও ঠিক, বাঙালী সংস্কৃতিকে অধুনা উজ্জীবিত করেছে পূর্ব বাংলার মানুষই বেশী । দেশ বিভাগের পর, উভয় দেশের রেষারেষির ফলে পূর্ববাংলার মানুষ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল পশ্চিম বাংলা থেকে। কিন্তু অত্যাচারী পাকিস্তানীদের সঙ্গে তাদের রুচি ও সংস্কৃতির এতই অমিল যে ধর্মের দোহাই দিয়েও তারা মিশে যেতে পারেনি শাসকদের সঙ্গে। আত্মরক্ষার জন্যই তারা সংস্কৃতির দিক থেকে সুসংহত হয়েছে, তারা নতুন ভাবে আবিষ্কার করেছে রবীন্দ্রনাথ নজরুল-জীবনানন্দকে। পশ্চিম পাকিস্তানীদের অত্যাচার তাদের কাছে শাপে বর হয়েছে, তারা কৃত্রিমভাব পাকিস্তানী হয়নি, বেশী করে বাঙালী হয়েছে। এদিকে, পশ্চিমবঙ্গের দিকে সমগ্র উত্তর ভারত খােলা, সেখানকার ঢেউ মাঝে মাঝে ঝাপটা দিয়েছে এদিকে হিন্দী ফিলমের কুরুচি ঢুকে গেছে অনেক গভীরে, আমাদের অনেকের কাছেই বাংলার সংস্কৃতি ঝাপসা।

স্বাধীন গণতান্ত্রিক প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হলাে। বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচনের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার চেয়েছিল, পাকিস্তানী শাসকরা বর্বর উপায়ে তা দমন করতে চেয়েছিল। বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রী দেশ হিসেবে ভারত প্রতিবেশী রাজ্যের এই গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে এসেছে। গণতন্ত্রের চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ঘােষণাকারী আমেরিকা এই সময়ে নিয়েছে ঘৃণিত ভূমিকা। ব্রিটিশের ভূমিকা ক্লীবের মতন। বিশ্বের শােষিত জনগণের নেতা হিসেবে গণ্য হতে চায় যে প্রজাতন্ত্রী চীন বাংলাদেশের মানুষের ওপর ইতিহসের জঘন্যতম অত্যাচারের কথা জেনেও মুখ ফিরিয়ে রইলাে কোন যুক্তিতে জানি না। রাশিয়া অপ্রত্যক্ষ সাহায্য করেছে বলে আমরা কৃতজ্ঞ। ভারত এই ঐতিহাসিক ভূমিকা না নিয়ে যদি কোনরকম বিচ্যুতি দেখাতাে- আমাদের লজ্জা রাখবার জায়গা থাকতাে না। এই বিবেকসম্মত ভুমিকা নিতে পেরেছে বলে আজ আমাদের অসম্ভব গর্ব।

৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!