You dont have javascript enabled! Please enable it!

নেতজী, মুসলিম সমাজ ও বাংলাদেশ

—  অধ্যাপক সমর গুহ এমপি

নেতাজী-ভবন আজ বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের একটি পরম বিপ্লব তীর্থে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যে সকল মুক্তিযােদ্ধা ও স্বদেশ প্রেমিক কখনও কলকাতা আসছেন তারা যাচ্ছেন নেতাজী-ভবন দর্শনে। অপলক নয়নে দেখেছেন ওখানে আজাদ হিন্দ সরকারও আজাদ হিন্দ মুক্তিফৌজের বীর্যদীপ্ত চিত্রাবলী। শুনছেন তারা হিন্দু মুসলিম শহীদদের সম্মিলিত আত্মত্যাগের সাগ্নেয় কাহিনী। সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে দেখছেন সামরিক সজ্জায় শােভিত নেতাজী সুভাষচন্দ্রের রণাঙ্গণের তেজদৃপ্ত প্রতিকৃতি। শেষে দাঁড়াচ্ছেন এসে মহানায়কের শয়নকক্ষে,- যে কক্ষ থেকে তিনি নিষ্ক্রান্ত হয়েছিলেন বিপ্লব-যাত্রার দুরূহ অভিযানে। আজও এই অগ্নিপুরুষের শযাপার্শ্বে রয়েছে একখণ্ড চণ্ডী ও একটি রুদ্রাক্ষ মালা; এবং তারই সামনে টাঙানাে রয়েছে একজন মুসলিম ফকিরের ধ্যান-নিমগ্ন চিত্র। বিস্মিত হয়ে যাচ্ছেন মানবাত্মার এই দিব্য সময় দেখে । আত্মা ও শক্তির এই যুগ অভিব্যক্তির অগ্নিহােত্রীকে অভিবাদন জানিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের নতুন প্রেরণা নিয়ে বেরিয়ে আসছেন তারা নেতাজী-ভবনের বিপ্লব তীর্থ থেকে। মুক্তিযােদ্ধাদের বহু রণাঙ্গন ও শিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়েছি, সেখানেও দেখেছি নেতাজীর জীবন ও বাণী এবং তার নেতৃত্বে পরিচালিত আজাদ হিন্দ মুক্তিযুদ্ধের কীর্তি-কাহিনী সম্বন্ধে জানবার ও বােঝবার বিপুল আগ্রহ। নেতাজী ও আজাদ হিন্দ মুক্তিযুদ্ধ সম্বন্ধে লেখা বই চাইছেন ওঁরা। বাঙালী সুভাষচন্দ্র আজ বাংলাদেশের মুক্তিযযাদ্ধাদের কাছে এক সাগ্নেয় প্রেরণা। | বিভাগ-পূর্ব প্রায় সব ভারতীয় নেতাদের স্মৃতি পাকিস্তানী যুগের বাংলাদেশের মানস পট থেকে মুছে  গেছে। কিন্তু সুভাষচন্দ্রের অগ্নিহােত্রী রূপ আজও অম্লান রয়েছে বাংলাদেশের সকল সম্প্রদায়ের মনে।। এই ব্যতিক্রমের কারণ কি? কারণ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র সাম্প্রদায়িকতা ও হিন্দু-মুসলিম দ্বিজাতিতত্ত্বের | বিরুদ্ধে এক অপরাজেয় বিদ্রোহের প্রতিমূর্তি। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সে যুগে হিন্দু মুসলিম ঐক্যের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হয়েছে, সে সময়েও নেতাজীর সহযােগিরূপে এই মহানায়কের ডাকে অগণিত হিন্দু-মুসলিম মুক্তিযােদ্ধা বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রাণ দিয়েছেন তাঁর প্রতি অপূর্ব শ্রদ্ধা ও আনুগত্যে সাম্প্রদায়িকতার রাজনীতিকে পর্যদস্ত করেছেন। নেতাজীই একমাত্র ভারতীয় নেতা যিনি জীবনদর্শন ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ঐতিহ্য সকল সম্প্রদায়ের কাছে এক অখণ্ড ঐক্যের ভাবমূর্তি।

আজ যারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অগ্রসারির নেতা তাদের অনেকেই তরুণ বয়সে প্রেরণা লাভ করেছেন সে যুগের দেশগৌরব সুভাষচন্দ্রের কাছ থেকে। ১৯৪০ সালে হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণের অভিযানে মুসলিম লীগের বাধা নিষেধ অগ্রাহ্য করে হাজারে হাজারে কলকাতার মুসলিম ছাত্রসমাজ যােগ দিয়েছিলেন। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার বিরুদ্ধে অনুরূপ হত্যার কলঙ্ক আরােপের সামাজ্যবাদী চক্রান্তকে পর্যদুস্ত করেছিলেন তাঁরা বিপ্লবী নায়ক সুভাষচন্দ্রের ডাকে। আজকের বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরাও  অনেকেই ছিলেন সেদিন কলকাতার ছাত্র। সবাই তারা ঝাপিয়ে পড়েছিলেন সুভাষচন্দ্রের সগ্রামী আহ্বানে। সুভাষচন্দ্রের সেই অগ্নি-স্পর্শ যে আজও সঞ্জীবিত রয়েছে তাঁদের ধমনীতে,- আজকের মুক্তি যুদ্ধের সাগ্নেয় অভিযান তার ঐতিহাসিক স্বাক্ষর। নেতাজীর সঙ্গে শেখ সাহেবের সাক্ষাৎ হয়েছিল ১৯৪০ সালে-ফরিদপুরে। | দেশবিভাগের পরেও সেদিনকার পূর্ব-পাকিস্তানে ছিলাম কয়েক বছর। সেদিনেও বিস্মিত হয়েছি। নেতাজীর প্রতি মুসলিম নেতা ও জনতার শ্রদ্ধা দেখে।

১৯৪৮ সালে শহীদ সাহেবের সঙ্গে মুনসিগঞ্জে একটি শান্তি-সভা করে লঞ্চে করে ফিরছিলাম নারায়ণগঞ্জে। শহীদ সাহেবের সঙ্গে ছিলেন সেদিনের তরুণ নেতা শেখ মুজিবর রহমান, স্বর্গত শ্রীশচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং আরও অনেকে। লঞ্চের ছাদে বসে দেশ বিভাগের নেপথ্যের অনেক কাহিনী বলতে বলতে হঠাৎ শহীদ সাহেব বললেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে গান্ধীজীর অসহায়তার কথা। শহীদ সাহেবের গৃহে অনশনের সময়ে দেশবিভাগের যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে গান্ধীজী খেদোক্তি করে বলেছিলেনঃ “আমি এখন কেউ নই। আমাকে মই হিসেবে ব্যবহার করে সেই মইকে সবাই এখন ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। আজ সুভাষ যদি আমাদের মধ্যে থাকত, একমাত্র সুভাষই দেশকে বাঁচাতে পারতাে- ওনলি সুভাষ কুড সেভ দি কান্ট্রি টু ডে।’ | শহীদ সাহেব আরও বললেন ঃ “শরত্যাবু ও আমি অন্তত বাংলার শেষ রক্ষার চেষ্টা করেছিলাম । গান্ধীজী ও মিঃ জিন্না- দুজনেই আমাদের স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ গঠনের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন কিন্তু নেহেরু প্যাটেলকে রাজী করানাে সম্ভব হয়নি।” বলতে বলতে অত্যন্ত উত্তেজিত কণ্ঠে এক বিস্ময়কর উক্তি করলেন সুরাবর্দী সাহেব ও ‘মিঃ জিন্না হ্যাড নাইদার হেড নর হার্ট।’ কথাটি শুনে সবাই আমরা তাজ্জব হয়ে চেয়ে রইলাম শহীদ সাহেবের মুখের দিকে। কে বলছেন এ কথা, শহীদ সুরাবর্দী। সে যুগের যুক্ত বাংলার। সর্বোচ্চ মুসলিম নায়ক সুরাবর্দী। আমাদের বিস্ময় নিরসন করে তিনি আবার বললেন ঃ “ইয়েস মিঃ জিন্না হ্যাজ বিন ডিফিটেড বাই সরদার প্যাটেল। আমরা যথার্থই ভারত-ভাগ চাইনি, চেয়েছিলাম কেন্দ্রীয় আইন সভায় সংখ্যানুপাতের চেয়ে মুসলিমদের জন্য কিছু বেশি আসন। ভারত ভাগের অর্থ ভারতীয় মুসলিমদের সর্বনাশ। সরদার প্যাটেল ভেবেছিলেন, পাকিস্তান বেশি দিন চলবে না। বাধ্য হয়েই আবার পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে এক হবে। মিঃ জিন্নাও যথার্থই দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন না। বাট দি গেমস অব পলিটিকস আলটিমেটলি প্রভড দি টেরিবল।”

আবার একটু থেমে বললেনঃ “গান্ধীজী ঠিকই বলেছেন। এ সময় সুভাষবাবুই দেশকে বাঁচাতে পারতেন। পরবর্তী বক্তব্যে আরােও আশ্চর্য করে দিয়ে তিনি বললেনঃ “জানাে আমি বিশ্বাস করি সুভাষবাবু  মারা যায়নি। আমি বেনারসের ভণ্ড জ্যোতিষীদের দিয়ে সুভাষবাবুর কোষ্ঠি বিচার করিয়েছিলাম। তারা বলেছেন, সুভাষ বাবু বেঁচে আছেন এবং তিনি আসবেন।” | নেতাজী হিন্দু-মুসলিম তথা সকল সম্প্রদায়ের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কে এক আমূল বিপ্লব সাধন করেছিলেন। আজাদ হিন্দ মুক্তিফৌজের সকল সম্প্রদায়ের সেনারা একই শিবিরে একত্রে বাস করেছেন, একই . রান্নাঘরে একই পংক্তিতে একই আহার গ্রহণ করেছেন। দৈনন্দিন আচার-আচরণ ও পারস্পরিকতায় এক অপূর্ব সৌহার্দ্য স্বজনবােধ গড়ে উঠেছিল নেতাজীর মুক্তিবাহিনীতে। তিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন। আজাদ হিন্দু বিপ্লবের পটভূমিতে মন্দির, মসজিদ, গীর্জা, গুরুদ্বার উন্মুক্ত করে গিয়েছিলেন, হিন্দু, মুসলিম, শিখই ইসই তথ্য সকল সম্প্রদায়ের জন্য। সাম্প্রদায়িকতা নির্মূলের এমন অবিশ্বাস্য বিপ্লব সম্ভব করেছিলেন। তিনি সেই যুগে, যে যুগে মুসলিম লীগ হিন্দু-মুসলিম দ্বি-জাতিতত্ত্বের তীব্র হলাহলে ভারতের জীবন-মানস বিষাক্ত করে দিয়েছিল।  নেতাজীর অপূর্ণ স্বপ্নকে বহুলাংশে পূর্ণ করার অগ্নিসংকেত আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। ইতিহাস ১৯৪৭ সালের আগের অধ্যায়ে আর ফিরে যাবে না। কিন্তু স্বাধীন বাংলা এক গুণগত পরিবর্তনের সূচনা করবে ভারতীয় উপমহাদেশে। এই যুগান্তরের পরে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশের বিপ্লবী। মুসলিম সমাজ। এ জন্যেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ নতুন দিগদর্শনের দিশারী-তিনিই আজ নেতাজী সুভাসচন্দ্রের যােগ্য উত্তরাধিকারী।

২১ অক্টোবর, ১৯৭১

 

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!