You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিদেশী প্রতিবেদনে তথ্য ভ্রান্তি

–হাসান মুরশিদ

সম্প্রতি লনডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত মাসকারা হ্যানসের দু-পৃষ্ঠাব্যাপী পূর্ববাংলা সম্পর্কিত প্রতিবেদন একটা আলােড়নের সৃষ্টি করেছে। এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে সাংবাদিককে সপরিবারে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছে এবং প্রতিবেদনটির প্রতি বিশ্বের বহু মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। উপরন্তু সাংবাদিকদের আপাত একটা নিরপেক্ষতাও প্রশংসার দাবি করেছে। বাংলাদেশ সমর্থকেরা এটিকে আপনাদের দাবির অনুকূল বলে বিবেচনা করেছেন। কিন্তু বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে এই প্রতিবেদনটি বাঙালীদের প্রতি অত্যন্ত অবিচার করেছে এবং বাংলাদেশের কারণটি প্রায় পরাস্ত করেছে। সারা বিশ্বে বাঙালীদের প্রতি যে একটা সহানুভূতি গড়ে উঠেছিলাে এই প্রতিবেদন পাঠের পর অনেকের মধ্য থেকেই তা চলে যাওয়ার কথা। | বাহ্যত নিরপেক্ষ এই সাংবাদিক প্রথমেই বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে- ২৫ মারচের আগে- বাঙালীরা এক লক্ষ অবাঙালীকে খুন করে এবং তারপর সৈন্যরা এক লক্ষের অনেক বেশী বাঙালীকে হত্যা করে। এটা কি সত্য, না সুবিচার? ২৫ মারচের আগে পূর্ব বাংলায় অবাঙালীদের প্রতি এমন অত্যাচার হলে তা পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হতাে না? মাসকারাহ্যানস করাচির যে পত্রিকায় কাজ করতেন সে পত্রিকায় অথবা পূর্ববাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে পত্রিকায়ই এরূপ উদ্ভট কোনাে সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।

এমন কি, সরকার নিয়ন্ত্রিত বেতার ও টেলিভিশনেও এমন কোনাে খবর প্রচার করা হয়নি। ২৫ মারচের আগে পূর্ববাংলায় কোনাে সেনসর প্রথা চালু ছিলাে না। এমন কি, সেখানে দেশ বিদেশের বহু সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। এরূপ কোনাে বর্বরতা বাঙালীরা করে থাকলে রাইফেল,মেশিনগান, মরটার ইত্যাদির সহায়তায় মিলিটারি ছাড়া এক লক্ষ লােক মেরে ফেলাও প্রায় অসম্ভব কাজ— তা দেশ বিদেশে অবশ্যই প্রচারিত হতাে। ম্যাসকরাহানসের করাচিস্থ মরনিং নিউজেও প্রকাশিত হতাে। কিন্তু এমন কোনাে ঘটনা ঘটেনি বলেই এমন কোনাে সংবাদ দূরে থাক রটনাও তখন পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি। তারপর লাখ দশেক মানুষ খুন করে মিলিটারি সরকার আপনাদের অভূতপূর্ব বর্বরতা ঢাকার জন্য এমন হীন প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেছে। ম্যাসকারাহ্যানস জ্ঞাতে অথবা অজ্ঞাতে সেই সরকারের বক্তব্যকেই তুলে ধরেছেন। জঙ্গীশাহীর বর্তমান দাবি কতাে অযৌক্তিক তার আরাে প্রমাণ আছে। (১) ২৫ মারচের ভাষণে ইয়াহিয়া নামক ব্যক্তিটি এ বিষয়ে কোনাে উল্লেখ করেনি। সামান্যতম সূতা থাকলে বিষয়টি ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলা হতাে। (২) ইয়াহিয়া টিক্কার দাবি বাঙালীরা দেশের অধিকাংশ লােকেরা দেশদ্রোহী, ভ্রাতৃঘাতক নয়। বর্তমান সামরিক অভিযান ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে অবাঙালী নিধনের বিরুদ্ধে নয়। 

বাঙালী-অবাঙালীদের মধ্যে পূর্ববাংলায় কোনাে অপ্রীতিকর সম্পর্ক ছিলাে না, তা নয়। অবাঙালীরা পূর্ব বাংলাতে বাঙালীদের মধ্যে বাস করতেন কিন্তু তারা কখনাে বাঙালীদের সঙ্গে নিজেদের এক করে দেখেননি। সব সময়ে একটা সুপিরিঅরিটি নিয়ে তারা বাস করতেন। নিজেদের ভাবতেন শাসক সম্প্রদায়রূপে। ব্যবসাবাণিজ্য ও চাকুরীক্ষেত্রে তারা সগােত্রায় আমলাতন্ত্রের সহায়তায় গ্রহণ করতেন বহু অন্যায় সুযােগ । বাঙালীরা একে খুব শ্রদ্ধা ও প্রীতির চোখে স্বাভাবিক ভাবেই দেখতে পারেন নি। তদুপরি বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে যখন অসহযােগ আন্দোলন পালিত হচ্ছিল, তখন এরা তার সঙ্গে সহযােগীতা করতে অস্বীকার করেন এবং সংক্ষেপে গুপ্ত সংবাদ সংগ্রহের কাজে মেতে ওঠেন। এসব ব্যাপারকে কেন্দ্র করেই, মারচের প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় কয়েকটি অবাঙালী দোকান লুট হয়। কিন্তু অবাঙালী খুন হয়নি। তারপর আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবকরা নিষ্ঠা ও তৎপরতার সঙ্গে এই অরাজকতা সম্পূর্ণরূপে আয়ত্তে আনেন। বঙ্গবন্ধু ৭ মারচের ভাষণে পরিষ্কারভাবে ঘােষণা করেন যে, পূর্ববাংলায় যারা বাস করেন তারা সবাই বাঙালী- যে ভাষায়ই তারা কথা বলুন না কেন, অথবা যে স্থান থেকেই তারা এসে থাকুক না কেন, বাঙালীরা সবাই ভাই ভাই।

বাস্তবিক পক্ষে সৈয়দপুর অঞ্চলে বাঙালী-অবাঙালীদের মধ্যে মারচের তৃতীয় সপ্তাহে একটি দাঙ্গার সূচনা হয় । মিলিটারিরা ওৎ পেতেছিলাে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই তারা ১৭ জন বাঙালীকে গুলি করে মেরে ফেলে।  এটা পাকিস্তানের পত্রিকাসমূহে প্রকাশিত সংবাদ। ঈশ্বরদিতে গােলযােগের আশঙ্কায় অবাঙালীদের মধ্যে নাকি সাড়ে তিন শ রাইফেল ও এল-এম-জি বিতরণ করা হয়। | বাঙালী অবাঙালী দাঙ্গা পূর্ববাংলাতে হয়েছিলাে ১৯৬৭ সালে। যে শদুয়েক মানুষ মরেছিলাে তারা প্রায় সবাই বাঙালী । মহম্মদপুরের যে অঞ্চলে দাঙ্গা বাধে, সেটা অবাঙালী প্রধান, তাছাড়া অবাঙালী মিলিটারিরা সক্রিয়ভাবে বাঙালী নিধনে সাহায্য করেছিলাে। হাইকোরটের একজন বিচারকের নেতৃত্বে একটি কমিশন বসলাে তদন্ত করতে। যখন দেখা গেল দোষটা অবাঙালীদের এবং তাদের সাহায্য করেছে শান্তিরক্ষক পুলিশ ও মিলিটারি বাহিনী, তখন আর তদন্তের প্রতিবেদন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হলাে না। সেবার মিলিটারি নয়। শান্তি ফিরিয়ে এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান। শেখ সাহেব চিরদিন বাঙালী-অবাঙালীদের সম্প্রীতির কথা বলে এসেছেন। | সাম্প্রদায়িক প্রশ্ন তুলে ইয়াহিয়া শাহী অথবা ম্যাসকারাহ্যানসরা বাঙালীদের প্রতি যে সীমাহীন শােষণ করা হয়েছে এবং বাঙালীরা যে তার থেকে মুক্তি চান-এ প্রশ্নকে ধামাচাপা দিতে পারবেন না। ম্যাসকারহ্যানসের প্রতিবেদনের এই ক্ষতিকারক দিকটার কথা সারা বিশ্বে প্রচারিত হওয়া প্রয়ােজন।

১ জুলাই, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!