You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের পত্রপত্রিকা (২)

— হাসান মুরশিদ

বামপন্থী প্রগতিবাদের ছাপমারা পত্রিকা হিসাবে সংবাদ নিজেকে পরিচিত করতে আগ্রহী। অবশ্য তার পরিচালকরা যে নীতির প্রবক্তা তার প্রতি তাদের নিজেদের বিশ্বাস কতটা দৃঢ়মূল, অথবা তাদের বিশ্বাস ও কর্মে কতটা সঙ্গতি আছে, সে সম্বন্ধে পাঠকদের মনে সন্দেহ জাগতে পারে। সংবাদের এ কনট্রাডিকশন তার পরিচালনকার্যেও প্রতিফলিত। সামাজিক সাম্য ও ন্যায়বিচারের উকিল, এ পত্রিকার কর্মীরা সবচেয়ে দুর্গত আর্থিক দিক দিয়ে । কৃষকের অভিযােগ ও অভাব অথবা ভিয়েতনাম এ পত্রিকার যতটা শ্লোগান ও ভঙ্গি, ততটা নীতি ও বিশ্বাস নয়। তদুপরি মসূকো-পিকিং-এর তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক লড়াই গণস্বার্থের সঙ্গে যেহেতু অঙ্গাঙ্গিভাবে কিংবা প্রত্যক্ষত জড়িত নয়, সে কারণে সংবাদের অনেকখানি উদ্যম অকারণে অপচিত হয়। তথাপি পূর্ব বাংলার স্বশাসন, ধর্ম নিরপেক্ষতা এবং নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির সমর্থক হিসেবে সংবাদের নিশ্চয় একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ে ইত্তেফাক ও সংবাদ যে সুবুদ্ধির পরিচয় দিয়েছে, তা অনুকরণযােগ্য এবং প্রশংসনীয়।

মরনিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তান। মরনিং নিউজ প্রথম থেকেই বাংলা ও বাঙালীদের স্বার্থবিরােধী এবং মুসলিম লীগ সমর্থক পত্রিক। ১৯৪৮ সালে উরদুর পক্ষে এবং বাংলার বিরুদ্ধে এ পত্রিকা সােচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালেও সেই ভুমিকা গ্রহণ করতে গেলে, হঠকারিতা ফলস্বরূপ, এর অফিস জনগণ পুড়িয়ে দেন-আগেই সে কথা বলা হয়েছে। আয়ুবের আমলে প্রেস ট্রাসট গঠিত হলে, এ পত্রিকাটি ট্রাসটের অন্যান্য পত্রিকার মত আইয়ুবের সরকারি দলের মুখপত্ররূপে কাজ করতে আরম্ভ করে। পূর্ববাংলায় এ পত্রিকাটির দোসর ছিল দৈনিক পাকিস্তান ট্রাসটের বাংলা পত্রিকা । দৈনিক পাকিস্তানের সম্পাদক হলেন আজাদ পত্রিকার বহু বছরের ইসলাম ও সাম্প্রদায়িকতার সেবক। আবুল কালাম শামসুদ্দীন। আহসান হাবিব ও মাহফুজ উল্লাহ-এর মত রবীন্দ্র বিরােধী কবি হলেন এ পত্রিকার সহকারী সম্পাদক। এই গােটা সাম্প্রদায়িক গােষ্ঠী মিলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের তথা বাংলার বিরুদ্ধে সােৎসাহে কাজ করতে থাকেন। মরনিং নিউজ ও দৈনিক পাকিস্তানের জনবিরােধী ভূমিকা এত স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে জনতা প্রেস ট্রাসটের অফিস ও মুদ্রাযন্ত্র পুড়িয়ে ফেলে।  অগ্নিতে শুদ্ধ এ পত্রিকা অতঃপর জনমতকে ভয় করে চলেছে। গত নির্বাচনে এরা মােটামুটি নিরপেক্ষ ছিল। হয়তাে মুসলিম লীগের প্রতি পুরানাে আনুগত্য কখনাে কখনাে প্রকাশ পেয়ে থাকবে। এই জন্যেই বােধ। 

হয় বর্তমানে টিক্কা খাঁর বিশ্বাস বর্তেছে এ পত্রিকা দুটির ওপর। আজাদ আকরাম খার অতএব মুসলিম লীগের পত্রিকা আজাদ। যেহেতু ১৯৫৪ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত মুসলীম লীগ ক্ষমতাসীন ছিল, সুতরাং সে ছিল কার্যত সরকারি পত্রিকা কিন্তু তারপরেও দেখা গেল সরাসরি সরকার বিরােধী ভূমিকা নিতে সে অনিচ্ছুক। প্রকৃতপক্ষে এ পত্রিকাটি প্রধানত ক্ষমতাসীন দলের ক্রীড়নক হিসেবে নিজেকে ব্যবহার করতে দিয়েছে। ইসলাম ও শক্তিশালী পাকিস্তানে এর বিশ্বাস অবিচল। আয়ুবের হাতে শাস্ত্রীয় ইসলাম বিপন্ন হওয়ায় এ পত্রিকাটি প্রথমবার সরকারের বিরুদ্ধে লিখতে শুরু করে।

পয়গাম প্রভু আইয়ুবের প্রেস ট্রাসট, ভৃত্য মােনেমের সম্বল “পয়গম”। গুণ্ডা বলে পরিচিত পুত্রকে সম্পাদক করে পূর্ববাংলার তদানীন্তন গভরনর মােনম খাঁ এ পত্রিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সাম্প্রদায়িকতা, আইয়ুবের অধীনে শক্তিশালী পাকিস্তান, মােনম খার মাসােহারাপ্রাপ্ত গুণ্ডা ছাত্রবাহিনী এন এস এফ প্রভৃতি পােষণের বিষয় ছিল  আলােচ্য পত্রিকাটির। উগ্র ধর্মান্ধ জামাতে ইসলামির মুখপত্র ‘সগ্রাম। সংজ্ঞা জানা না থাকলে সম্পূর্ণরূপে ইসলামি রাষ্ট্রগঠন জামাতে ইসলামির মতাে এ পত্রিকারও লক্ষ্য এবং আদর্শ। বর্তমান জীবন ও সমাজের সমস্যার প্রতি উদাসীন এবং প্রগতির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়ায় এ পত্রিকার বিশ্বাস। মানুষের পার্থিব জীবনের দুঃখকষ্টকে অবজ্ঞা করে কল্পিত পারলৌকিক মঙ্গলের কথা বলে এ গােষ্ঠী আসলে শােষকের পথকে প্রশস্ত করতেই ব্যস্ত। এ পত্রিকা ধর্মের নেশাগ্রস্ত কতিপয় লােককেই বিভ্রান্ত করতে পারে, জনজীবনের সঙ্গে এর কোনাে যােগাযােগ নেই।

দি পিপল পিপল পত্রিকাটির জন্ম হয়েছে মাত্র কয়েক মাস আগে। বাঙালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা হিসাবে বলা যেতে পরে পিপল ইত্তেফাকেরই ইংরেজী সংস্করণ। ২৫ মারচ রাত্রেই পত্রিকাটির অফিস পুড়িয়ে দেয় জঙ্গীবাহিনী। সম্প্রতি মুজিবনগর থেকে এ পত্রিকা পুনরায় প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটি দাবি করেছে এর বিশজন সাংবাদিক ২৫ মারচ রাত্রে টিকা খর ঘাতকবাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন। | ঢাকা ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে একাধিক দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়; কিন্তু সামগ্রিকভাবে পুর্ব বাংলার জনমানসে এগুলির প্রভাব সামান্যই। সাপ্তাহিক পত্রিকা পূর্ব বাংলার বিভিন্ন শহর থেকে অনেকগুলি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কোনাে না কোনাে রাজনৈতিক দল অথবা স্থানীয় বিত্তবান লােকের অর্থে পরিচালিত বলে এ পত্রিকা গুলি সে সব রাজনৈতিক দল অথবা ব্যক্তির স্বার্থকে সংরক্ষিত করতেই তৎপর, নিরপেক্ষ সংবাদ পরিবেশন এগুলির কাজ নয়। এ সমস্ত পত্রিকার মােট প্রচার সংখ্যাও অত্যন্ত নগণ্য এবং মানের দিক দিয়েও এগুলি নিতান্ত নিম্নশ্রেণীর। একারণে এমন কোনাে সাপ্তাহিক পত্রিকার নাম করা শক্ত, জনমত গঠনে যার দান উল্লেখযােগ্য।

রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত কারণে একাধিক পত্রিকা অবশ্য ভিড়ের মধ্যে সহজে চোখে পড়ে। ভাসানীপন্থী ন্যাপের পত্রিকা হিসেবে “জনতা” ও ‘স্বাধিকার’ বেশ পরিচিত। প্রচার সংখ্যাও তুলনামুলকভাবে বেশি- ৭ থেকে ১০ হাজার।  “গণশক্তি” পত্রিকাটি একাধিক কারণে উল্লেখযােগ্য। এর সম্পাদক বদরুদ্দিন উমর, তাঁর বিশেষ। রাজনৈতিক আক্রমণ সত্ত্বেও, পূর্ব বাংলার বােধ হয় সবচেয়ে সাহসী সংস্কৃতিসেবী ও প্রবন্ধলেখক। এঁর গ্রন্থ ‘সাম্প্রদায়িকতা’, ‘সংস্কৃতির সংকট,’ সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা ও পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও অকালীন রাজনীতি’ বক্তব্যও ঐতিহাসিক কারণে তুলনাহীন। গণশক্তির রাজনৈতিক পরিচয়- এটি পূর্ব বাংলার চরম বামপন্থী দলের (এম এল) মুখপত্র, বর্তমান স্বাধীনতা সংগ্রামে অথবা বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এর ভুমিকা এক প্রকার নেই বললেই চলে। প্রচার সংখ্যা প্রায় দশ হাজার।

সাময়িক পত্র সংবাদপত্র জনমত গঠনের বােধহয় সবচেয়ে কার্যকর হাতিয়ার, এ বিষয়ে সাময়িক পত্রের গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না। ‘সমকাল’ পূর্ব মেঘ’ প্রভৃতি পত্রিকার পাঠক শিক্ষিত ও বুদ্ধিমান মানুষ এবং তাদের সংখ্যা নিতান্ত নগণ্য, তথাপি পূর্ব বাংলার চিত্তজাগরণে এদের ভূমিকা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মর্তব্য। সমকাল। সমকাল মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। সিকান্দার আবু জাফরের সম্পাদনায় ঢাকা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে ১৯৫৭ সাল থেকে। প্রকৃত পক্ষে এ পত্রিকাটি পূর্ব বাংলার এক সময়কার একমাত্র সাহিত্য পত্রিকা। যদিও অনিয়মিত ভাবে প্রকাশিত হয়েছে অথবা প্রকাশিত রচনাসমূহ সর্বদা যথেষ্ট উচ্চমানের হয়নি, তবু সমকালের একটা মান। 

আগাগােড়া ছিলাে। পূর্ববাংলার আজকের খ্যাত অনেক সাহিত্যিকই প্রথমে সমকালে লিখেছেন। সরকার যখন ইসলামি সাংস্কৃতির নামে উন্মত্ত, তখনাে সমকাল ধর্মনিরপেক্ষ বাঙালী সংস্কৃতি সেবায় নিয়ােজিত থেকেছে। পূর্বমেঘ। একাধিক কারণে ‘পূর্ব মেঘ’ সমকালের থেকে বেশি প্রশংসার অধিকারী। কেননা সমকাল প্রধানত সাহিত্যের মধ্যে গণ্ডিবদ্ধ ছিলাে। এমনকি তার রচনাসমূহে সমাজচেতনা সুদূর প্রসারী। পূর্ব মেঘে কেবল সমাজ বিষয়ক রচনা প্রকাশিত হয়নি, তার সাহিত্যিক প্রবন্ধেও সমাজচেতনা অনেক বেশি স্পষ্ট। বদরুদ্দীন উমরের মতাে লেখকের অধিকাংশ রচনা পূর্ব মেঘে প্রকাশিত হওয়ায় একদিকে পত্রিকাটি যেমন বিতর্কমূলক বলে পরিচিত হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি পাকিস্তানের ভিত্তিমূল সাম্প্রদায়িকতাকে আঘাত দিয়ে মুক্তি চিন্তার পথকে সে প্রশস্ত করেছে। বক্তব্যের চেয়েও উমরের প্রবন্ধ সৎসাহসের জন্যে অধিক শ্রদ্ধার দাবি করতে পারে। একদিন পূর্ববাংলার বুদ্ধিজীবীরা যখন সরকারি নির্যাতনের ভয়ে স্বাধীন চিন্তাকে প্রকাশ করতে ভীত ছিলেন, সে কালে উমর লেখেন এবং পূর্ব মেঘ’ সে লেখা প্রকাশ করে বরফ ভেঙে ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কে পূর্বমেঘের নীতিও এই বলিষ্ঠতা ও সৎসাহসের প্রমাণ দেয়। পূর্বমেঘের পাতাই প্রথম হাসান আজিজুল হকের ছােট গল্প এবং সনৎ সাহার প্রবন্ধ প্রকাশ পায়।

রাজশাহী থেকে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী ও মুস্তাফা নূরউল ইসলামের সম্পাদনায় ১৩৬৭ সাল থেকে পূর্ব মেঘ প্রকাশিত হচ্ছে। উত্তর অন্বেষা সমকাল ও পূর্ব মেঘ থেকে উত্তর অন্বেষা একটি কারণে স্বতন্ত্র। উত্তর অন্বেষা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতি সেবার সঙ্গে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছে এবং এ বিষয়ে প্রবল প্রতিকূলতার মুখে যথেষ্ট সৎসাহস দেখিয়েছে। রচনার মানের জন্য যতটা নয়, তার চেয়ে বক্তব্যের জন্যে উত্তর অন্বেষা অধিকতর উল্লেখযােগ্য। মাহারুল ইসলামের সম্পাদায় রাজশাহী থেকে ১৯৬৭ সালে এ পত্রিকা প্রথম প্রকাশিত হয়। 

কণ্ঠস্বর ‘কণ্ঠস্বর’ এ্যাংগ্রি জেনারেশনের পত্রিকা। সাহিত্য সেবা এবং উদ্দেশ্য যতটা, সমাজচেতনা ততটা মর্যাদা পায়নি। তবু ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যে কণ্ঠস্বর প্রশংসার দাবি রাখে। এ পত্রিকাগুলি ব্যতীত নানা সময়ে পূর্ব বাংলা থেকে বহু ক্ষণজীবী সাংস্কৃতিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। হয়তাে সামগ্রিকভাবে তাদের অদানও কম নয়। এছাড়া ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থান থেকে বিশেষত তরুণদের প্রচেষ্টায় কতগুলাে অনিয়মিত সাহিত্য সংকলন প্রকাশিত হয়। স্বাভাবিক ভাবেই তরুণদের আশাআকাথা তথা প্রগতিবাদী সমাজের আদর্শও পত্রিকা গুলিতে প্রতিফলিত।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাহিত্য পত্রিকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যিালয়ের বাংলা বিভাগের ‘সাহিত্যকী’, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের পাণ্ডুলিপি’, বাংলা অ্যাকাডেমীর বাংলা অ্যাকাডেমী পত্রিকা’, কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বােরডের ‘বাংলা উন্নয়ন বােরড-পত্রিকা’, এবং নজরুল অ্যাকাডেমীর নজরুল অ্যাকাডেমি পত্রিকা’ গবেষণা পত্রিকা হিসেবে বিশেষ উল্লেখযােগ্য। সাহিত্য পত্রিকার মতাে উচ্চমানের গবেষণা পত্রিকা পশ্চিমবঙ্গেও বােধহয় দ্বিতীয়টি নেই। তবে এ পত্রিকাগুলির দান যতটা সাহিত্য ক্ষেত্রে, সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে ততটা নয়।

২৯ জুন, ১৯৭১

সূত্র:  গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!