নৈতিকতার প্রশ্নে বাংলাদেশ
— রেজা আলি
বাংলাদেশের নির্যাতিত নাগরিক এবং মুক্তিফৌজের সামনে একটি প্রশ্ন বার বার খাড়া হয়। তাদের স্বাধীনতা আন্দোলন ন্যায় অথবা অন্যায়। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম অনেকেই সুনজরে দেখেনা। পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট প্রতিদিনই শােনা যায় ? পবিত্র ইসলাম জাতীয় সংহতি এবং পাকিস্তানী নাগরিকদের কল্যাণে পাক-সামরিক বাহিনী যুদ্ধে লিপ্ত। তারই প্রতিধ্বনি মেলে এমন কি চীনের প্রধান মন্ত্রীর পত্রে, “জাতীয় উন্নতির জন্য পাকিস্তানের অখণ্ডতা অপরিহার্য।” অন্য কেউ এই কথা উচ্চারণ করলে নৈতিকতার কোন সমস্যা থাকত না বা তার বিচার অনেক সহজ হতাে। কিন্তু সর্বহারাদের অধিনায়ক এবং জঙ্গী ‘জুনটা’র পরিচালকের মিল সমস্যা অনেক জটিল করে তুলেছে। নৈতিকতার প্রশ্নে দুই বিপরীত শিবিরের প্রধান একই জায়গায় পৌঁছেছেন। এক রাষ্ট্রের বুনিয়াদ ধর্মের উপর প্রতিষ্ঠিত। অপর রাষ্ট্রের ধর্ম “জনসাধারণের আফিম, কিন্তু রাজনৈতিক প্রশ্নে দেখা যাচ্ছে, দু’য়ের মধ্যে কোন বিরােধ নেই। বিভিন্ন যাত্রাবিন্দু থেকে অবশ্য একই গন্তব্যে পৌছানাে যায়। কিন্তু খট্রা সহজে এসে পড়ে। | জঙ্গীশাহীর আচরণ, মতলব, কীর্তি গত তিন মাসে বিশ্ববাসীর কাছে এত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে তার পুনরুক্তি অবান্তর। পাকিস্তানের মূল বিরােধ জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার নিয়ে। এই সমস্যার রুশ দেশের বিপ্লবীদের একদা গভীরভাবে আলােড়িত করেছিল। তারাই জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে প্রথম স্বীকৃতি দেন। ফিনল্যান্ড যে আজ স্বাধীন তা তাদেরই বিপ্লবােত্তর প্রথম কীর্তি। প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আছে। এই সদম্ভ ঘােষণা করেছিলেন লেনিন। অথচ সমাজতন্ত্রী আর এক দেশ বর্তমানে অন্য কথা বলছে। আবার খট্কা সহজে এসে পড়ে। যদি কেবল খটকাতেই সীমাবদ্ধ থাকত, কারও বলার কিছু ছিল না।
কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সমাজতন্ত্রী দেশের নৈতিক সমর্থনের পরিণতি অতি স্পষ্ট এবং জাজ্জল্যমান। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে প্রায় কুড়ি লক্ষ লােক নিহত, আটহাজার গ্রাম ভস্মীভূত, পঞ্চাশ লক্ষ শরণার্থী এবং দু’কোটি লােক দেশের অভ্যন্তরে নিজ নিজ এলাকা ও বাস্তুভিটাচ্যুত। লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, গৃহদাহ, বেআইনী হত্যা, আটক ইত্যাদি বর্বরতার হিসাব নেপথ্যে থাক। ইয়াহিয়াশাহীর পিছনে যাদের সমর্থন আছে তারা প্রত্যেকেই লুটতরাজ, নারীধর্ষণ, গণহত্যা। প্রভৃতির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে জড়িত না হলেও নৈতিক অপরাধে অপরাধী- যদি দেখা যায়, নারীধর্ষণ, নিরস্ত্রকে হত্যা প্রভৃতি কাজ নীতিসম্মত না হয়। এইখানে নীতিশাস্ত্রের সেই জটিল জিজ্ঞাসা এসে পড়েঃ প্রত্যেক আচরণের কি স্বয়ষ্ণু রূপ আছে? নারীধর্ষণ কি গণহত্যার ক্ষেত্রে সমাজতন্ত্রী অসমাজতন্ত্রীর প্রশ্ন নেই। কাজটা খারাপ, তা যে কেউ করুক।
এমন সব প্রশ্ন মনে ওঠার নানা কারণ আছে। চীন দেশ সম্পর্কে প্রত্যেক অনুন্নত দেশের দুর্বলতা খুব স্বাভাবিক। উপায় নিয়ে নানা মতভেদ থাকতে পারে, কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যে মহাচীন যে অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধির সূত্রপাত করেছে তা কেবল পারিসংখ্যানের দিক থেকে শুধু বিস্ময়কর নয়, কৃতিত্বের দিক থেকেও অভাবনীয় । সেই দেশ থেকে যখন ফ্যাসিস্ট রক্তপিপাসু শাসকদের জন্য সহযােগিতা আসে, তখন বাংলাদেশের দরিদ্র নাগরিকদের বার বার চোখ রগড়াতে হয়। এ কি সম্ভব? মন সহজে মেনে নিতে গররাজি। সর্বহারাদের রাষ্ট্রের পক্ষে এই আচরণ কি সম্ভব? যে কোন সৎ মানুষ এই প্রশ্নের সম্মুখে নাজেহাল হতে বাধ্য। হয়ত চৈনিক নেতাদের কাছে বর্তমানে বাংলাদেশের প্রকৃত ছবি গিয়ে পৌঁছায়নি। যার ফলে, বর্তমান সমর্থন। কৃষক এবং মজুর সর্বহারাদের দুই প্রধান স্তম্ভ। জঙ্গীশাহীর হামলায় এই দুই শ্রেণী সব চেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত। পঁচিশে মার্চের কালরাত্রে ইয়াহিয়ার খাকী মােড়া জন্তুদের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ? গণহত্যা এবং আতঙ্কবিস্তার। এই দুই ঢিলে। তারা বাংলার চিড়িয়াদের দুরস্ত করে ফেলবে। পাঁয়তারার প্রথম শিকার হল শ্রমিক শ্রেণী। মজুর বস্তিতে সৈন্যরা প্রথমে আগুনে বােমা নিক্ষেপ মারফৎ অগ্নিদাহ শুরু করল। স্বভাবতই আর্তনাদ তুলে প্রাণভীত মজুর নরনারী শিশু দলে দলে নিজের কুঁড়েঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে লাগল। তখন শুরু হলাে মেশিনগান থেকে গুলি বর্ষণ। এই ভাবে ঢাকার চৌধুরী পাড়া, নাখালপাড়া ও অন্যান্য বস্তি অঞ্চলে কতাে হাজার হাজার অসহায় নিরস্ত্র প্রাণ যে বলি হােয়ে গেল, তার সঠিক হিসাব পরে সম্ভব। প্রথম দুইদিন ইসলামের ধারক ও বাহক সৈন্যরা এই পর্যায় অব্যাহত রাখলাে বেপােরােয়া লুটতরাজ সহযােগে।
তিরিশে মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ অরডার দিলাে, ঢাকা শহরে রাস্তার পাশে যত বস্তি আছে তার অধিবাসীরা যেন চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে তা ভেঙে ফেলে। তেইশ বছর স্বাধীনতার পর পাকিস্তানে একশ্রেণীর মানুষ কী পশুসূলভ অবস্থার মধ্যে বাস করে তা চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। রেললাইনের ধারে, পতিত জায়গায়, ডােবা নর্দমার পাশে হাজার হাজার মানুষ কোন রকমে মাথাগোঁজা একটা ঝুপড়ি তােলে। এখানে বাসস্থান তৈরীর উপাদান বাঁশের দরমা, কাটা কেরােসিন টিন, পিচবাের্ড, কঞ্চি, সিনেমার পুরাতন বড় পােস্টার- এই রকম আজব মালমশলা। কোন রকম রৌদ্রনিবারণ। তাই মােটা কাগজই যথেষ্ট। বৃষ্টির দিনের কথাও ভাবে না গ্রীষ্মকালে। সামরিক কর্তৃপক্ষের ফরমান ঃ বস্তি হঠাও। ভয় পেয়েছিল জঙ্গী জন্তুরা । গেরিলাদের রাইফেলের ছররা উৎস হতে পারে ওই সব ওৎ-অনুকূল জায়গা। পাঁচদিন কেটে গেছে। চৈনিক মেশিনগানের ভাষা আর ঢাকার মজুরদের কাছে অজানা নয়। তাই দলে দলে এই-যাযাবার শ্রেণী নিজেদের বাসভূমি পরিত্যাগ করতে লাগল, নতুন কোন আস্তানার সন্ধানে। এদের মালপত্র কম। মাটির বাসন, কটা গামছা, লুংগি, ছােটখাট যন্ত্রপাতি যথা কাস্তে, কুড়াল, ইত্যাদি। অনেকে সব ফেলে কেবল কেরােসিন টিনে তৈরী চাল-দুতিন-খানা-মাথায় নিয়েছে। একই বােঝা মরদ-মেয়ের মাথায়। যাদের কচি ছেলেপিলে আছে, তারা শিশু হলেও যদ্র বহন-সক্ষম ঐ গৃহমশলা মাথায় নিয়েছে। শত শত নরনারী শিশুর সেই মিছিল কেবল আদিম যুগের বনাগ্নি-ভীত জীবজন্তুদের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। বৃদ্ধবৃদ্ধাও আছে এই কাতারে। একটা ভাইকে কোলে নিয়ে এগােচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর বিজ্ঞানপৃষ্ট ঢাকা নগরীর বুকে আদিম অরণ্যের অবতারণা। এমন ক্ষেত্রে চোখে দেখা দৃশ্যের উপর আস্থা রাখা দায়। মনে হবে বুঝি দৃষ্ট্রিভ্রম। একি সম্ভব? কিন্তু সবই বাস্তব ঘটনা। দুর্ভাগ্যের পেয়ালা পূর্ণ করতে সেদিন দুরন্ত বৃষ্টি নেমেছিল। এই মিছিল ফলে আরাে মূক হয়ে গেল । নিঃশব্দ একদল অসহায় নরনারী শিশু পরিত্যক্ত রেল লাইন ধরে হেঁটে যেতে লাগল। ঢাকা নগরীর মজুর নয় কেবল। ইয়াহিয়ার কবন্ধ চামুণ্ডারা যখন মফস্বল শহরে গঞ্জে ছড়িয়ে পড়ে, তারা একই দৃশ্যের অবতারণা করেছিলেন। একুনে কত লক্ষ লক্ষ মজুর প্রাণ দেয় বা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ে, তার হিসাব একদিন হবে বৈকি। বর্তমানে বাংলাদেশে কলকারখানা যে অচল তার প্রধান কারণ, জনসাধারণের অসহযােগিতা ছাড়াও, দক্ষ মজুরের অভাব। তাদের অধিকাংশ মৃত অথবা আতঙ্কে ফেরার।
এই গেল মজুরদের দৃশ্য। কৃষকদের দুর্দশার খতিয়ানের পুনরাবৃত্তি নিষ্প্রয়ােজন। পূর্বে উল্লেখিত আট হাজার গ্রাম ভস্মীভূত, দু কোটি কৃষক বাস্তুচ্যুত ।ইয়াহিয়া খান কিন্তু কোন ভুল করেননি কৃষক মজুর শ্রেণীর প্রতি তার কি মােহ থাকতে পারে? এই দুই শ্রেণী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সমর্থন দিয়েছিল অতি জঙ্গী ভাবে। কৃষক মজুর কোন ভুল করেনি। ঔপনিবেশিক গােলামি থেকে মুক্তি পাওয়ার পর না অন্যান্য সামাজিক বিপ্লবের প্রশ্ন আসে। শেখ মুজিব কৃষক-মজুরদের নেতা নন। কিন্তু তিনি মুক্তি আন্দোলনের নেতা। সেইজন্য সর্বশ্রেণীর সমর্থন তিনি পেয়েছেন, এবং তিনি এত জনপ্রিয়। অথচ যেহেতু মুজিব কৃষক-মজুরদের নেতা নন, সুতরাং অস্পৃশ্য। তেইশ বছর বহু পরীক্ষার পর দেখা গেল, পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হিসাবেই পূর্ব পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে। যদি রাষ্ট্র একীভূত থাকে। আর যে-শর্তে দুই জঙ্গী পাকিস্তান একাঙ্গ হয়ে বজায় থাকতে পারে, তার জন্য সম্ভবত সমাজতন্ত্র প্রয়ােজন। জাপানী স্যামুরাই শ্রেণীর অনুরূপ সমাজতান্ত্রিক ভাবধারাপুত পাঞ্জাবের ফ্যাসিস্ট শাসকগােষ্ঠী এবং আইয়ুব খানের পালিত পুত্র ও তার সঙ্গে সাত বছর জোটবাধা জুলফিকার আলি ভুট্টোকে যদি কেউ সমাজতন্ত্রীতে পরিণত করার বাসনা রাখেন, তাহলে বুঝতে হবে, মর্কটকে মান্দারীন বানানাের অলৌকিক ক্ষমতা তাদের আছে। | বঙ্গবন্ধু মুজিবের নেতৃত্বেই কি আপত্তি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জাপানী আক্রমণের সময় চীনা কমুনিস্ট পার্টি চিয়াং কাইশেকের নেতৃত্ব মেনে কি জাতীয় সরকার গঠন করেন নি? তখন যুক্তি ছিল ঃ যেহেতু জাপান উভয়ের শত্রু, অতএব জাতীয় স্বার্থেই তাদের জোট বাঁধা উচিত। সে যুক্তির প্রয়ােগ আজ বাংলাদেশ সম্পর্কেও খাটে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বও ইতিহাসের একটা পর্যায় মাত্র। ইতিহাস কি অনড় বসে থাকবে?
২২ জুন ১৯৭১
সূত্র: গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ খন্ড -০৭ , আনন্দবাজার পত্রিকা